নবমীর দিনটা শুরু হয়েছিল এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি দিয়ে। একদিকে ছিল উৎসবের শেষ মুহূর্তগুলোকে পুরোপুরি উপভোগ করার এক বাঁধনছাড়া আনন্দ, অন্যদিকে ছিল আগামীকালই যে সব শেষ হয়ে যাবে, তার এক প্রচ্ছন্ন বিষাদ। বাতাসটা ছিল ভারী—শিউলি ফুলের গন্ধ, ধুনোর ধোঁয়া, খিচুড়ির ভোগের পবিত্র গন্ধের সাথে মিশে যাওয়া তেলেভাজার লোভনীয় সুবাস আর হাজারো মানুষের পারফিউমের এক জটিল মিশ্রণে। মণ্ডপে আজ তিল ধারণের জায়গা নেই। মানুষের কোলাহল, ঢাকের উন্মত্ত বোল আর মাইকের শব্দ—সবকিছু মিলেমিশে একাকার। অরুণ, যে কিনা কয়েকদিন আগেও এই বিশৃঙ্খলা থেকে পালাতে চেয়েছিল, সে আজ এই জনসমুদ্রের মধ্যে দাঁড়িয়ে নিজেকে স্ট্রেঞ্জলি শান্ত অনুভব করছিল। রিয়ার হাত ধরে সে শিখে গিয়েছিল, কীভাবে এই কোলাহলের মধ্যেও নিজের একটা শান্তির দ্বীপ খুঁজে নিতে হয়।
সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে মণ্ডপের চেহারাটাই বদলে গেল। হাজারো টুনি লাইট আর চন্দননগরের ঝাড়বাতির আলোয় চারপাশটা যেন এক স্বপ্নপুরী হয়ে উঠল। অরুণ আর রিয়া ভিড়ের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। রিয়া হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে একটা ফুচকার দোকানের দিকে ইশারা করল। “চলুন, ফুচকা খাবেন।”
অরুণ ইতস্তত করে বলল, “এখানে? মানে, হাইজিন…”
রিয়া হেসে ফেলল। “আরে ধুর! পুজোর সময় হাইজিন নিয়ে ভাবলে চলে? কলকাতার আত্মাকে পেতে হলে তার রাস্তার খাবার খেতেই হবে।”
রিয়ার এই সহজ সরল যুক্তির কাছে অরুণের লন্ডনের পরিশীলিত লজিক হেরে গেল। সে দেখল, কীভাবে রিয়া নিপুণভাবে ফুচকাওয়ালার সাথে কথা বলে নিজের পছন্দের ঝাল-টক বানিয়ে নিচ্ছে। তাদের ফুচকা খাওয়ার দৃশ্যটা ছিল বড়ই অদ্ভুত। চারপাশে প্রচণ্ড ভিড়, ঢাকের আওয়াজ, কিন্তু তাদের দুজনের জন্য সময়টা যেন থমকে গিয়েছিল। ফুচকার টক জল খেতে গিয়ে অরুণের চোখে জল এসে গিয়েছিল, যা দেখে রিয়া খিলখিল করে হেসে উঠেছিল। সেই হাসির শব্দটা ঢাকের আওয়াজকেও ছাপিয়ে অরুণের কানে বাজছিল।
সন্ধ্যার আরতি ও হোম-যজ্ঞ:
নবমীর সন্ধ্যা আরতি ছিল এক নৈসর্গিক দৃশ্য। পাঁচজন পুরোহিত একসাথে বিশাল বড় প্রদীপ হাতে নিয়ে আরতি করছিলেন। কাঁসর, ঘণ্টা আর শাঁখের সম্মিলিত শব্দে চারপাশ মুখরিত। অরুণ আর রিয়া ভিড়ের মধ্যে পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিল। তাদের মধ্যে কোনো কথা হচ্ছিল না, কিন্তু আরতির আগুনের শিখার দিকে তাকিয়ে তারা একে অপরের চোখের দিকে তাকাচ্ছিল। সেই দৃষ্টি বিনিময়ে ছিল এক গভীর বোঝাপড়া।
আরতির পর শুরু হলো হোম-যজ্ঞ। বিশাল এক যজ্ঞকুণ্ডে আগুনের শিখা লেলিহান হয়ে জ্বলে উঠল। ঘি, কাঠ আর নানা সামগ্রী আহুতি দেওয়ার সাথে সাথে পুরোহিতের গম্ভীর মন্ত্র উচ্চারণ পরিবেশটাকে আরও পবিত্র করে তুলছিল। আগুনের তাপে আর ধোঁয়ায় অরুণের চোখ জ্বালা করছিল, কিন্তু সে তাকিয়ে ছিল রিয়ার দিকে। আগুনের আলোয় রিয়ার মুখটা এক অপার্থিব আভায় ভরে গিয়েছিল। তার চোখ দুটো ছিল বন্ধ, ঠোঁটে ছিল নিঃশব্দ প্রার্থনা। অরুণের মনে হলো, এই মেয়েটির বিশ্বাস এতটাই গভীর যে তা নাস্তিকের মনেও ভক্তির জন্ম দিতে পারে।
ধুনুচি নাচ:
হোম শেষ হওয়ার পর হঠাৎ করেই ঢাকের বাদ্যি বদলে গেল। শুরু হলো সেই আদিম, উন্মত্ত বোল, যা ধুনুচি নাচের আহ্বান জানায়। পাড়ার ছেলেরা ধুনুচি হাতে নিয়ে নাচতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পর শুভঙ্করদা মাইকে ঘোষণা করলেন, “এবার আমাদের সামনে ধুনুচি নাচ নিয়ে আসছে আমাদের পাড়ার সবার আদরের রিয়া।”
চিত্রের ক্যানভাস: শক্তির রূপ
ক্যানভাসটা ছিল গতিময়। কেন্দ্রে ছিল রিয়া, তার পরনে গাঢ় লাল রঙের ঢাকাই জামদানি শাড়ি। সে যখন দুটো জ্বলন্ত ধুনুচি হাতে তুলে নিল, তখন তার সেই শান্ত, স্নিগ্ধ রূপটা মুহূর্তে বদলে গেল। ঢাকের প্রত্যেকটা বোলের সাথে তার শরীরটা যেন বিদ্যুতের মতো নেচে উঠল। তার পা দুটো মাটি থেকে প্রায় উড়ছিল, শাড়ির আঁচল উড়ছে, খোলা চুল পিঠের ওপর সাপের মতো দুলছে। ধুনুচির আগুন এবং ধোঁয়ার কুণ্ডলী তাকে ঘিরে রেখেছিল, যেন সে কোনো ঐশ্বরিক শক্তির আবেশে রয়েছে। তার মুখটা ছিল দৃঢ়, চোখ দুটো ছিল আবেগে উজ্জ্বল—যেন সে সাধারণ মেয়ে নয়, স্বয়ং দেবী। তার শরীরী ভাষায় ছিল ছন্দ, শক্তি এবং এক অদ্ভুত সমর্পন । দর্শকদের ভিড়ের মধ্যে অরুণের মুখটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। তার চোখে ছিল অপার বিস্ময়, শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা। সে শুধু রিয়ার নাচ দেখছিল না, দেখছিল এক নারীর ভেতরের শক্তির প্রকাশ।
অরুণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইল। সে বুঝতে পারল, সে রিয়ার প্রেমে পড়ে গেছে। এই অনুভূতিটা আর শুধু মুগ্ধতা নয়, এর চেয়েও গভীর কিছু। সে শুধু রিয়ার সারল্য বা বুদ্ধিমত্তাকে ভালোবাসেনি, সে ভালোবেসেছে তার এই প্রচণ্ড শক্তিকেও।
নাচ শেষে রিয়া যখন হাঁপাতে হাঁপাতে একপাশে সরে এল, তখন অরুণ ভিড় ঠেলে তার কাছে পৌঁছাল। তার হাতে ছিল জলের বোতল। “রিয়া,”—তার গলা দিয়ে শুধু এইটুকুই বের হলো। রিয়া তার দিকে তাকিয়ে হাসল। সেই হাসিতে ছিল ক্লান্তি, কিন্তু তার চেয়েও বেশি ছিল আনন্দ। জলের বোতলটা নেওয়ার সময় রিয়ার আঙুলগুলো অরুণের আঙুলকে আলতো করে ছুঁয়ে গেল। সেই সামান্য স্পর্শে দুজনের শরীরেই এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল।
রাতের নিস্তব্ধতা ও অসমাপ্ত মুহূর্ত:
অনেক রাতে, যখন মণ্ডপের কোলাহল থেমে গেছে, তখন তারা দুজনে মণ্ডপের সিঁড়িতে এসে বসল। চারপাশে তখন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, শুধু ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক আর শিউলি ফুলের তীব্র, মাতাল করা গন্ধ।
অরুণ বলল, “আজ তোমাকে দেখে আমি সত্যিই অবাক হয়ে গেছি। তোমার মধ্যে যেন আগুন আর জল দুটোই আছে।”
রিয়া তার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল, “প্রত্যেক মেয়ের মধ্যেই থাকে, অরুণদা। শুধু দেখার মতো চোখ লাগে।”
সেই রাতে অরুণ তার সব কথা রিয়াকে খুলে বলল—অদিতি, তার নির্বাসন, তার শূন্যতা। রিয়া সবটা শুনে তার হাতের ওপর আলতো করে নিজের হাতটা রাখল। সেই স্পর্শে ছিল আশ্রয়। অরুণ রিয়ার দিকে ঝুঁকেছিল তার জীবনের প্রথম স্বতঃস্ফূর্ত আবেগঘন মুহূর্তে, কিন্তু একটা ফোন কল সেই মুহূর্তটাকে অসমাপ্ত রেখে দিয়েছিল। কিন্তু অরুণ জানত, কিছু জিনিস অসমাপ্ত থাকলেও সম্পূর্ণ হয়ে যায়। তাদের ভালোবাসার গল্পটাও সেদিন রাতেই সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion