Episode 51057 words0 views

পঞ্চম অধ্যায় : মধুর অবসানের দিন

দশমীর সকালটা একটা ভারী, বিষণ্ণ চাদর মুড়ি দিয়ে আসে। আকাশে-বাতাসে বিদায়ের সুর। অরুণ ঘুম থেকে উঠেছিল ঢাকের এক অন্যরকম বোলে। নবমীর রাতের সেই উন্মত্ত, দ্রুত লয়ের বাদ্যি আজ আর নেই। তার বদলে বাজছে এক ধীর, বিষণ্ণ সুর—বিসর্জনের সুর। সেই সুরটা যেন গোটা পাড়ার মনের কথা বলছে। উৎসব শেষের বেদনা। অরুণের বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা লাগছিল। আজই সব শেষ। কাল ভোরেই তার ফ্লাইট। তার গোছানো সুটকেসটা ঘরের কোণে রাখা, যেন এক নিষ্ঠুর প্রহরী, তাকে তার কঠোর বাস্তবতার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। সে উঠে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। গঙ্গার জল শান্ত, আকাশটা মেঘলা। তার মনে হলো, এই শহর, এই বাড়ি, এমনকি এই আকাশটাও যেন তাকে বিদায় জানাতে প্রস্তুত। সে আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল। গত রাতের আবেগের কারণে তার মুখটা ক্লান্ত দেখাচ্ছে। পরনের পাঞ্জাবিটা সামান্য কুঁচকে গেছে। তার হাতে বাঁধা দামী সুইস ঘড়িটা লন্ডনের সময় দেখাচ্ছে। সে ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে ভাবল—একই পৃথিবীতে দুটো ভিন্ন সময়, দুটো ভিন্ন জগৎ। সে কোন জগতের বাসিন্দা? তার প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে সে নিজেকেই চিনতে পারছিল না। এই কি সেই অরুণ মিত্র, যে জে.পি. মরগ্যানের বোর্ডরুমে মিলিয়ন পাউন্ডের ডিল নিয়ে আলোচনা করে? নাকি এই সেই অরুণ, যার মনটা গত চারদিনে এক অচেনা মেয়ের হাসিতে, কথায় আর নাচে বাঁধা পড়ে গেছে? ঠিক তখনই তার ফোনটা বেজে উঠল। ক্যাথরিনের ফোন। লন্ডনে এখন মাঝরাত। “Arun, you awake?” ক্যাথরিনের গলাটা আগের মতোই শান্ত, আবেগহীন। “হ্যাঁ, বলো,” অরুণ উত্তর দিল। “Just wanted to remind you about the Henderson project meeting on Monday morning. I’ve sent you the updated slides. Please go through them on your flight.” অরুণ চুপ করে রইল। Henderson project, Monday meeting—এই শব্দগুলো তার কাছে ভিনগ্রহের ভাষা বলে মনে হচ্ছিল। “Arun? Are you there?” “হ্যাঁ, আছি। আমি দেখে নেব।” “Good. And how’s the family festival? Hope you’re getting it over with.” “Getting it over with…”—এই কথাগুলো অরুণের কানে শেলের মতো বিঁধল। ক্যাথরিনের কাছে এটা শুধু একটা দায়িত্ব, যা শেষ করে ফিরতে হবে। সে বোঝেনি, এই চারটে দিন অরুণের জীবনের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে। “হ্যাঁ, প্রায় শেষ,” অরুণ শুধু এইটুকুই বলতে পারল। ফোনটা রেখে সে দেখল, তার বাবা দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। অনিরুদ্ধবাবু ভেতরে এসে তার কাঁধে হাত রাখলেন। “মন খারাপ?” অরুণ অবাক হলো। তার বাবা কোনোদিনও তার মনের কথা জিজ্ঞেস করেননি। সে শুধু মাথা নাড়ল। অনিরুদ্ধবাবু বললেন, “আমি জানি, আমি সারাজীবন তোকে শুধু সফল হওয়ার জন্য চাপ দিয়েছি। চেয়েছিলাম, আমি যা হতে পারিনি, তুই তাই হবি। কিন্তু লন্ডনে তুই শুধু টাকা রোজগার করেছিস, সুখী হতে পারিসনি, তাই না?” অরুণ তার বাবার চোখের দিকে তাকাল। সেই চোখে আজ কোনো প্রত্যাশার চাপ নেই, আছে শুধু এক বাবার আর্তি। “তোর মা বলছিল, তুই নাকি রিয়ার সাথে খুব মিশেছিস। মেয়েটা খুব ভালো।” অনিরুদ্ধবাবু একটু থামলেন। “তোর জীবন, তোর সিদ্ধান্ত। শুধু এটুকু বলব, এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিস না, যার জন্য বাকি জীবনটা আফসোস করতে হয়।” বাবার এই কথাগুলো অরুণের মনের দ্বিধার মেঘটাকে অনেকটাই সরিয়ে দিল। সকালের সিঁদুর খেলা: মণ্ডপে তখন এক অন্য জগৎ। দেবী বরণের পর শুরু হয়েছে সিঁদুর খেলা। অরুণ এক পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিল। এটা মূলত বিবাহিত মহিলাদের উৎসব, তাই সে ছিল একজন বহিরাগত দর্শক। ঠাকুরদালানের বাতাস তখন সিঁদুর, আবির, মিষ্টি আর নারকেল নাড়ুর গন্ধে ম ম করছে। সাদা শাড়ি পরা মহিলারা একে অপরের মুখে, সিঁথিতে সিঁদুর মাখিয়ে দিচ্ছে। তাদের হাসির শব্দ, উলুধ্বনি আর ঢাকের বিদায়ী বোলে চারপাশটা কেমন মেতে উঠেছে। এই আনন্দের মধ্যেও লুকিয়ে আছে এক বিষণ্ণতা—মায়ের বিদায়ের বেদনা। অরুণ দেখল, রিয়াও এই আনন্দের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। তার সাদা শাড়ির জমিন, তার মুখ, তার চুল—সবই সিঁদুরের লাল রঙে রাঙা। তার চোখে জল, কিন্তু ঠোঁটে হাসি। এই দৃশ্যটা দেখে অরুণের মনে হলো, রিয়া যেন এই উৎসবের প্রতিমূর্তি—একই সাথে আনন্দময়ী এবং বিষণ্ণ। ঠিক সেই মুহূর্তে, এই সিঁদুরের লাল আভার মধ্যেই তার ফোনটা আবার বেজে উঠল। এবার হেড অফিস থেকে, সংস্থার সিইও, মিস্টার হ্যারিসন। “Arun, my boy! Congratulations! The board has approved your promotion. You are now the Vice President for the Asian market. Your new salary will be double what you get now. We expect you back on Monday to sign the papers.” যে খবরটা শোনার জন্য অরুণ গত দশ বছর ধরে রক্ত জল করেছে, সেই খবরটা আজ তার কাছে একটা ফাঁসির আদেশের মতো মনে হলো। একপাশে ছিল তার এতদিনের স্বপ্ন, তার গড়া সাম্রাজ্য। আর অন্যপাশে ছিল এই চারদিনে খুঁজে পাওয়া এক নতুন জীবন, এক নতুন ভালোবাসা। চূড়ান্ত মুহূর্ত: ফোনটা কেটে দিয়ে সে যখন ঘুরল, দেখল রিয়া তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখটা সিঁদুরে মাখা, চোখ দুটো ভেজা। সে অরুণের পাঞ্জাবির হাতায় তার সিঁদুর মাখা আঙুল দিয়ে একটা লম্বা দাগ টেনে দিল। তারপর কান্নাভেজা গলায় জিজ্ঞেস করল, “সবকিছু কি এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়, অরুণদা? আপনি কথা দিন, আবার আসবেন।” এই সহজ প্রশ্নটার মধ্যে লুকিয়ে ছিল সমস্ত ভালোবাসা, সমস্ত অধিকার, সমস্ত আকুতি। অরুণের সমস্ত দ্বিধা, সমস্ত দ্বন্দ্ব এক মুহূর্তে উড়ে গেল। সে রিয়ার হাতটা শক্ত করে ধরল। “আমি আর কোথাও যাব না, রিয়া। আমি এখানেই থাকব।” রিয়া অবাক চোখে তার দিকে তাকাল। অরুণ বলল, “লন্ডনের ওই জীবনটা, ওই প্রমোশন, ওগুলো সব একটা সুন্দর করে সাজানো ফাঁকা ঘর। সেখানে সব আছে, শুধু প্রাণ নেই। আর এই যে বিশৃঙ্খলা, এই কোলাহল, এই আবেগ—এটাই তো জীবন। আমি গত দশ বছর ধরে একটা ভূতের মতো বেঁচে ছিলাম, রিয়া। এই চারদিনে তুমি আমাকে আবার মানুষ করে তুলেছো।” সে রিয়ার আরও কাছে এগিয়ে এল। “এটা শুধু পুজোর জন্য নয়, রিয়া। এটা তোমার জন্য। তুমি যেভাবে শিল্প নিয়ে তর্ক করো, যেভাবে আগুন নিয়ে নাচো, যেভাবে একজন অচেনা মানুষের চোখের একাকীত্ব পড়ে ফেলো—আমি সেই সবকিছুর প্রেমে পড়ে গেছি। তুমি এই শহরের আত্মা। তুমি আমার আত্মা।” রিয়ার চোখ দিয়ে এবার আনন্দের অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। অরুণ আলতো করে তার গাল থেকে এক ফোঁটা জল মুছে দিল। সেই জলের সাথে রিয়ার গালের সিঁদুর মিশে গিয়ে অরুণের আঙুলটাও লাল হয়ে গেল। সে রিয়ার মুখটা দুই হাতে ধরে নিজের দিকে ফেরাল। চারপাশের ঢাকের আওয়াজ, মানুষের কোলাহল—সবকিছুকে উপেক্ষা করে, অরুণ রিয়ার ঠোঁটে আলতো করে চুমু খেল। সেটা কোনো আবেগের চুম্বন ছিল না, ছিল এক পবিত্র প্রতিশ্রুতি। ঘরে ফেরার চুম্বন। এক দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসানের চুম্বন। রিয়া প্রথমে কেঁপে উঠলেও, পরক্ষণেই অরুণের ভালোবাসায় নিজেকে সঁপে দিল। বিকেলের বিসর্জন: প্রতিমা বিসর্জনের শোভাযাত্রায় অরুণ আর রিয়া একসাথে হেঁটেছিল। “আসছে বছর আবার হবে”—এই ধ্বনির মধ্যে অরুণ খুঁজে পেয়েছিল তার নিজের জীবনের প্রতিশ্রুতি। গঙ্গার ঘাটে দাঁড়িয়ে, যখন দেবী প্রতিমা ধীরে ধীরে জলের গভীরে মিলিয়ে যাচ্ছিল, তখন অরুণ রিয়ার হাতটা শক্ত করে ধরেছিল। সে জানত, তার পুরোনো জীবনের বিসর্জন হয়ে গেছে। আজ থেকে শুরু হলো এক নতুন জীবন—ভালোবাসা, বিশ্বাস আর শিকড়ের সাথে জুড়ে থাকার জীবন। সে রিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার আর কোনোদিনও মনের নির্বাসনে থাকতে হবে না, রিয়া। কারণ আমি আমার দেশ খুঁজে পেয়েছি।” রিয়া তার কাঁধে মাথা রেখে বলল, “দেশে তো আপনি আগেই ফিরেছিলেন, অরুণ। আজ বাড়ি ফিরলেন।” গঙ্গার জলে তখন দিনের শেষ আলো প্রতিফলিত হচ্ছিল, আর দুটি মানুষ খুঁজে পাচ্ছিল তাদের ভালোবাসার অনন্ত আকাশ। (চলবে)

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion