Episode 6997 words0 views

ষষ্ঠ অধ্যায় : নতুন জীবনের বুনন

ফাল্গুনের এক পড়ন্ত বিকেলে উত্তরপাড়ার চ্যাটার্জী বাড়ির সেই ঠাকুরদালানেই অরুণ আর রিয়ার বিয়ে হয়েছিল। কোনো জাঁকজমক বা আড়ম্বর ছিল না। শুধু রেজিস্ট্রি ম্যারেজের পর পাড়ার সমস্ত মানুষকে নিয়ে এক বিশাল প্রীতিভোজের আয়োজন করা হয়েছিল। শুভঙ্করদা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সব ব্যবস্থা করেছিলেন, আর সৌরভও তার বন্ধুদের সাথে হাসিমুখে সবাইকে পরিবেশন করছিল। সেই একই জায়গা, যেখানে তাদের ভালোবাসার জন্ম, সেখানেই তাদের জীবন একসূত্রে বাঁধা পড়ল। বিয়ের পর কেটে গেছে প্রায় দুটো বছর। সময়টা যেন নদীর স্রোতের মতো বয়ে গেছে, রেখে গেছে কিছু মিষ্টি পলি আর কিছু অপ্রত্যাশিত বাঁক। এই দুটো বছর ছিল অরুণের জন্য এক নতুন জন্ম, এক নতুন আত্ম-আবিষ্কারের অধ্যায়। অরুণের জীবনটা একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গিয়েছিল। লন্ডনের জে.পি. মরগ্যানের ভাইস প্রেসিডেন্টের পদ ছেড়ে সে এখন কলকাতার এক ভারতীয় ফিনান্স সংস্থার স্ট্র্যাটেজি হেড। পদটা বড়, কিন্তু কাজের ধরনটা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। লন্ডনে তার জগৎটা ছিল সংখ্যা, ডেটা আর নির্লিপ্ত পেশাদারিত্বের। সেখানে সম্পর্কগুলো ছিল আনুষ্ঠানিক, কথা হতো ইমেলে, সিদ্ধান্ত আসত বোর্ডরুম থেকে। কিন্তু কলকাতা ছিল ঠিক তার উল্টো। এখানে ব্যবসা চলত সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে। লাঞ্চে ক্লায়েন্টের সাথে ইলিশ মাছ খেতে খেতে চুক্তি পাকা হতো, আর সন্ধ্যার চায়ের আড্ডায় তৈরি হতো নতুন ব্যবসার পরিকল্পনা। প্রথম প্রথম অরুণের খুব অসুবিধা হতো। তার সোজাসাপ্টা, টু-দ্য-পয়েন্ট কথা বলার ভঙ্গিটা অনেকেই অহংকার বলে ভুল করত। একদিন তার বস, মিস্টার সেন, তাকে ডেকে বলেছিলেন, “অরুণ, তোমার অ্যানালিটিক্যাল স্কিল অসাধারণ। কিন্তু এখানে শুধু মাথা দিয়ে কাজ হয় না, মন দিয়েও করতে হয়। মানুষকে বুঝতে শেখো, তাদের সাথে মিশতে শেখো। এখানে একটা ফাইল পাশ করাতে যতটা ডেটা লাগে, তার চেয়ে বেশি লাগে দুটো মিষ্টি কথা।” এই নতুন কর্মসংস্কৃতিতে মানিয়ে নিতে অরুণকে সাহায্য করেছিল রিয়া। প্রতি রাতে খাবার টেবিলে অরুণ তার দিনের সব বিরক্তি, সব দ্বিধা উগরে দিত। রিয়া মন দিয়ে শুনত। সে হাসতে হাসতে বলত, “তুমি দশ বছর ধরে একটা যন্ত্রের মতো কাজ করেছো, অরুণ। এবার একটু মানুষ হতে শেখো। অফিসের পিয়নকে তার মেয়ের পরীক্ষার খবর জিজ্ঞেস করলে তোমার স্ট্যাটাস কমে যাবে না, বরং দেখবে সে তোমার জন্য মন দিয়ে কাজ করছে।” তাদের সংসারটা ছিল ভালোবাসার ছোট ছোট মুহূর্ত দিয়ে বোনা। অরুণের পুরোনো ঘরটাই এখন তাদের দুজনের জগৎ। রিয়ার বই, শাড়ি আর অরুণের ল্যাপটপ, ফাইল—সবকিছু মিলেমিশে একাকার। একদিন রবিবার বিকেলে তারা তাদের নতুন কেনা বইয়ের তাকটা গোছাচ্ছিল। একদিকে অরুণের ফাইন্যান্সিয়াল জার্নাল, ম্যানেজমেন্টের বই আর জন গ্রিশামের থ্রিলার। অন্যদিকে রিয়ার রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, মার্কেজ আর ভার্জিনিয়া উলফ। অরুণ রিয়ার একটা বই হাতে নিয়ে বলল, “এইসব দুর্বোধ্য কবিতা পড়ে কী পাও তুমি?” রিয়া হেসে অরুণের একটা মোটা ম্যানেজমেন্টের বই তুলে নিয়ে বলল, “আর তুমিই বা এই সব রসকষহীন বই পড়ে কী পাও? আমার বইগুলো অন্তত মনকে শান্তি দেয়।” “আর আমার বইগুলো মাসের শেষে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে শান্তি দেয়,” অরুণ হাসতে হাসতে উত্তর দিল। এইসব ছোট ছোট খুনসুটির মধ্যেই তাদের ভালোবাসা গভীর হচ্ছিল। এক বর্ষার দুপুরে ঘটল এক স্মরণীয় ঘটনা। সেদিন ছিল ছুটির দিন। সকাল থেকে মুষলধারে বৃষ্টি। গঙ্গার জল বেড়ে উঠেছে। অরুণ বারান্দায় বসে ল্যাপটপে অফিসের কাজ করছিল। রিয়া হঠাৎ দুটো প্লেটে গরম খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজা নিয়ে হাজির হলো। “এখনও কাজ?” রিয়ার গলায় কপট রাগ। “একটু পরেই রাখছি,” অরুণ মনিটর থেকে চোখ না সরিয়েই বলল। রিয়া কোনো কথা না বলে ল্যাপটপটা আলতো করে বন্ধ করে দিল। “আজ আর কোনো কাজ নয়। আজ শুধু বৃষ্টি দেখা আর খিচুড়ি খাওয়া।” অরুণের আর কিছু বলার ছিল না। তারা দুজনে বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখছিল আর খাচ্ছিল। বৃষ্টির ছাঁট এসে তাদের ভিজিয়ে দিচ্ছিল। অরুণ দেখছিল, বৃষ্টির জলে রিয়ার মুখটা কেমন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। সে রিয়ার হাতটা ধরে বলল, “জানেন রিয়া, লন্ডনেও বৃষ্টি হয়। কিন্তু সেই বৃষ্টিতে কোনো গন্ধ নেই, কোনো সুর নেই। কলকাতার বৃষ্টির একটা নিজস্ব আত্মা আছে।” রিয়া তার কাঁধে মাথা রেখে বলল, “শহরটার মতোই, তাই না?” আরেকদিন অরুণ গিয়েছিল রিয়াকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আনতে। সে একটু আগেই পৌঁছে গিয়েছিল। রিয়ার ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে সে দেখছিল, রিয়া ছাত্রছাত্রীদের সাথে মিশে গিয়ে কীভাবে পোস্ট-মডার্নিজম নিয়ে আলোচনা করছে। তার চোখেমুখে ছিল এক অদ্ভুত দীপ্তি, কথায় ছিল অগাধ জ্ঞান। অরুণ মুগ্ধ হয়ে দেখছিল। এই সেই রিয়া, যে মণ্ডপে ধুনুচি হাতে উদ্দাম নাচে, যে রান্নাঘরে নিপুণ হাতে রান্না করে, আবার সেই-ই ক্লাসরুমে জ্ঞানের দেবী। অরুণ বুঝতে পারছিল, সে শুধু একজন মানুষকে ভালোবাসেনি, সে ভালোবেসেছে এক নারীর ভেতরের সমস্ত রূপকে। অরুণ আর রিয়ার বিয়েটা শুধু দুটো মানুষের মিলন ছিল না, ছিল দুটো পরিবারেরও। মিনতি দেবী তার হারানো ছেলেকে শুধু ফিরে পাননি, সাথে পেয়েছেন রিয়ার মতো এক মিষ্টি মেয়ে। তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন, কীভাবে রিয়া তার নিজের পড়াশোনা, চাকরি সামলেও গোটা বাড়িটাকে আগলে রেখেছে। অনিরুদ্ধবাবু, যিনি একসময় ছেলেকে বিদেশে পাঠানোর জন্য সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছিলেন, তিনি এখন সম্পূর্ণ বদলে গেছেন। একদিন সন্ধ্যায় অরুণ আর তার বাবা বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিল। অনিরুদ্ধবাবু হঠাৎ বললেন, “জানিস অরুণ, তোর ওই সৌরভ ছেলেটার সাথে সেদিন বাজারে দেখা হয়েছিল। ব্যবসাটা নাকি ভালোই চালাচ্ছে। ছেলেটা অনেক বদলে গেছে।” অরুণ অবাক হয়ে তার বাবার দিকে তাকাল। তার বাবা কোনোদিনও পাড়ার খবর নিয়ে এতটা উৎসাহ দেখাননি। অনিরুদ্ধবাবু বললেন, “এই মেয়েটা আসার পর থেকে বাড়ির চেহারাটাই বদলে গেছে। তুই ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলিস।” বাবার মুখ থেকে এই স্বীকৃতিটুকু শোনার জন্য অরুণ হয়তো দশ বছর ধরে অপেক্ষা করেছিল। তার চোখটা ভিজে এল। একদিন রাতে অফিস থেকে ফিরে অরুণ খুব ক্লান্ত আর বিরক্ত ছিল। একটা বড় ডিল হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। সে সোফায় শরীরটা এলিয়ে দিল। রিয়া তার পাশে এসে বসল, কিন্তু কাজের কথা জিজ্ঞেস করে তাকে আরও বিরক্ত করল না। সে শুধু বলল, “একটু বসো, আমি আসছি।” কিছুক্ষণ পর সে ফিরে এল তার প্রিয় জীবনানন্দ দাশের কবিতার বইটা হাতে নিয়ে। সে অরুণের পাশে বসে, তার চুলে আলতো করে বিলি কাটতে কাটতে কবিতা পড়তে শুরু করল— “হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে, সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে… … চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য… ” রিয়ার শান্ত, স্নিগ্ধ গলায় কবিতা শুনতে শুনতে অরুণের সব ক্লান্তি, সব বিরক্তি যেন দূর হয়ে গেল। সে উঠে এসে রিয়ার কোলে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করল। রিয়ার শাড়ির আঁচলের চেনা গন্ধটা তাকে ঘিরে ধরল। সে রিয়ার হাতটা ধরে বলল, “তোমাকে ধন্যবাদ, রিয়া। আমাকে আমার নিজের কাছে ফিরিয়ে আনার জন্য।” রিয়া ঝুঁকে এসে তার কপালে একটা চুমু খেল। “ভালোবাসি যে।” এই দুটো বছর ছিল তাদের একে অপরকে নতুন করে চেনার, ভালোবাসার আর একে অপরের আশ্রয়ে পরিণত হওয়ার। তাদের ভালোবাসা ছিল শান্ত নদীর মতো, যা বাইরে থেকে শান্ত, কিন্তু ভেতরে তার স্রোত ছিল অত্যন্ত গভীর। তারা জানত না, এই শান্ত নদীতেই খুব শীঘ্রই অতীতের এক ঝড় এসে লাগতে চলেছে। (চলবে)

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion