Episode 71115 words0 views

সপ্তম অধ্যায়: অতীতের পুনরাগমন

জীবনটা যখন এভাবেই নিজের ছন্দে, ভালোবাসার শান্ত নদীতে বয়ে চলছিল, ঠিক তখনই এক শীতের সন্ধ্যায় অতীতের একটা ছায়া এসে পড়ল তাদের জীবনে। উপলক্ষ্য ছিল কলকাতার এক পাঁচতারা হোটেলে আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক বিজনেস সামিট। অরুণের সংস্থা ছিল এই সামিটের অন্যতম প্রধান স্পনসর, এবং তাকেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ভারতীয় অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা নিয়ে একটি প্রেজেন্টেশন দেওয়ার। সামিটের আগের দিন রাতে অরুণ তার পুরোনো জীবনের বর্মটা আবার পরছিল। আলমারির গভীর থেকে সে বের করেছিল তার লন্ডনের কেনা একটি দামি আরমানি স্যুট, একটা সিল্কের টাই আর তার অতি প্রিয় সুইস ঘড়িটা। এই জিনিসগুলো সে গত দু বছরে একবারও ছুঁয়ে দেখেনি। রিয়া ঘরে ঢুকে দেখল, অরুণ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টাইয়ের নটটা ঠিক করার চেষ্টা করছে। তার মুখে এক অদ্ভুত গাম্ভীর্য। রিয়া পেছন থেকে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। "বাহ্! মিস্টার মিত্রকে তো একেবারে অচেনা লাগছে। আবার দশ বছর আগের অরুণ মিত্র হয়ে যাচ্ছ না তো?" তার গলায় ছিল আদরের সুর, কিন্তু তার সাথে মিশে ছিল এক সূক্ষ্ম আশঙ্কা। অরুণ আয়নায় রিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে হাসল। "এটা শুধু একটা মিটিংয়ের জন্য। এই বর্মটা কালকেই আবার খুলে রাখব।" সে ঘুরে দাঁড়িয়ে রিয়ার কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল, "আমার জগৎ এখন তুমি। এই স্যুট-টাই শুধু বাইরের আবরণ।" রিয়া তাকে সাহায্য করল টাইটা ঠিক করে দিতে। তার আঙুলগুলো যখন অরুণের শার্টের কলারে ছুঁয়ে যাচ্ছিল, তখন সে বুঝতে পারছিল, এই মানুষটা তার, কিন্তু এই মানুষটার একটা অতীতও আছে, যা সে কোনোদিন দেখেনি। পরদিন সকালে সামিটের ভেন্যুতে পৌঁছে অরুণের মনে হলো, সে যেন একটা টাইম মেশিনে করে তার পুরোনো জীবনে ফিরে গেছে। হোটেলের কনফারেন্স হলের হিমশীতল তাপমাত্রা, দামী পারফিউমের গন্ধ, মৃদু ইংরেজিতে চলতে থাকা নেটওয়ার্কিং আর কাঁটা-চামচের টুং-টাং শব্দ—সবকিছুই তার কাছে বড্ড বেশি চেনা, আবার বড্ড বেশি অচেনা। সে দেখছিল, কীভাবে সবাই একটা কৃত্রিম হাসি মুখে লাগিয়ে একে অপরের সাথে কথা বলছে, বিজনেস কার্ড বিনিময় করছে, যেন এটা কোনো মানবিক সম্পর্ক নয়, একটা ব্যবসায়িক লেনদেন। তারপর এলো তার প্রেজেন্টেশনের সময়। সে যখন স্টেজে উঠল, তখন তার মধ্যে আর কোনো দ্বিধা ছিল না। সংখ্যা, ডেটা আর অ্যানালিসিস ছিল তার নিজস্ব খেলার মাঠ। সে অবলীলায় ভারতীয় অর্থনীতির জটিল বিষয়গুলোকে সহজ করে তুলে ধরছিল। তার আত্মবিশ্বাস, তার বাচনভঙ্গি আর তার জ্ঞানের গভীরতা দিয়ে সে গোটা হলকে মুগ্ধ করে দিল। প্রেজেন্টেশন শেষে যখন হাততালির ঝড় উঠল, তখন অরুণ দেখল, অনেক বড় বড় সংস্থার সিইও তার সাথে কথা বলার জন্য এগিয়ে আসছেন। সে তাদের সাথে হাত মেলাচ্ছিল, বিজনেস কার্ড নিচ্ছিল, আর ভাবছিল—এই তো সেই জীবন, যার জন্য সে একদিন হাহাকার করত! কিন্তু আজ এই সাফল্যের মুহূর্তে তার মনে কোনো আনন্দ হচ্ছিল না। তার শুধু মনে হচ্ছিল, কখন সে এখান থেকে বেরিয়ে রিয়ার কাছে ফিরে যাবে। ককটেল পার্টি যখন পুরোদমে চলছে, তখন সামিটের শেষ বক্তা, অর্থাৎ 'কি-নোট স্পিকার', স্টেজে উঠলেন। অরুণ একপাশে দাঁড়িয়ে ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিল। সে বক্তার দিকে তেমন মনোযোগ দেয়নি। কিন্তু যখন সেই কণ্ঠস্বরটা ভেসে এলো, তখন তার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। এই কণ্ঠস্বর তার অতি চেনা। সে স্টেজের দিকে তাকাল। পরনে একটা নিখুঁত ধূসর রঙের প্যান্টস্যুট, চোখে দামী চশমা, আর ঠোঁটে সেই চিরচেনা আত্মবিশ্বাসী হাসি। অদিতি রায়। সিঙ্গাপুর-ভিত্তিক এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রধান হয়ে সে এই সামিটে এসেছে। বারো বছরে সে আরও তীক্ষ্ণ, আরও সফল হয়েছে। সে যখন বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে কথা বলছিল, তখন তার প্রত্যেকটা শব্দে ঝরে পড়ছিল আত্মবিশ্বাস আর ক্ষমতা। অরুণের বুকের ভেতরটা এক মুহূর্তের জন্য হিম হয়ে গেল। যে অতীতকে সে বহু কষ্টে পেছনে ফেলে এসেছিল, সেই অতীত আজ তার সামনে সশরীরে দাঁড়িয়ে। সে ভিড়ের মধ্যে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। অদিতির বক্তব্য শেষ হওয়ার পর, সে স্টেজ থেকে নেমেই অরুণকে দেখতে পেয়েছিল। অদিতি এগিয়ে এল। তার হাঁটাচলার মধ্যে এখনও সেই একই রাজকীয় ভঙ্গি। "Arun Mitra? I can't believe it's you!" অরুণ হাসার চেষ্টা করল। "অদিতি! তুমি এখানে? What a surprise!" অদিতি হাসল। "পৃথিবীটা খুব ছোট, তাই না? আমি তো শুনেছিলাম তুমি লন্ডনে আছো। এখানে কী করছ? ছুটিতে এসেছো?" "না, আমি এখানেই থাকি। কলকাতাতেই কাজ করি।" অরুণের উত্তরটা শুনে অদিতির চোখে এক ঝলক বিস্ময় ফুটে উঠল, সাথে কিছুটা তাচ্ছিল্যও। "Really? Kolkata? After reaching the pinnacle in London? Arun, you were meant for Wall Street, not College Street. What happened?" অরুণ শান্তভাবে বলল, "হয়তো আমি যা চেয়েছিলাম, তা খুঁজে পেয়েছি। কিছু জিনিস বোঝার জন্য হিসেবের খাতার বাইরেও তাকাতে হয়, অদিতি।" তাদের কথোপকথনের মধ্যেই বেশ কয়েকজন লোক অদিতির সাথে কথা বলার জন্য এগিয়ে এল। অদিতি খুব দক্ষতার সাথে তাদের সামলে নিয়ে আবার অরুণের দিকে ফিরল। "Listen, Arun. It's great to see you. We have a lot to catch up on. Are you married?" অরুণের মুখটা এই প্রশ্নে নরম হয়ে গেল। তার চোখের কোণে এক অদ্ভুত আলো জ্বলে উঠল। "হ্যাঁ। আমার স্ত্রী রিয়া, ও যাদবপুরে পড়ায়।" অরুণের এই পরিবর্তনটা অদিতির চোখ এড়াল না। সে একটু অবাক হয়ে বলল, "An academic? Interesting choice for you." "She reads poetry," অরুণ মৃদু হেসে বলল। "She reminds me what's real." এই কথাটার মধ্যে লুকিয়ে থাকা গভীরতা অদিতি হয়তো পুরোপুরি বুঝতে পারল না, কিন্তু সে অনুভব করল, এই অরুণ আর বারো বছর আগের সেই অরুণ নয়। এই অরুণের জগৎটা এখন সম্পূর্ণ আলাদা। পার্টি শেষে অদিতি অরুণের হাতে তার বিজনেস কার্ডটা দিয়ে বলল, "We should catch up sometime. For old times' sake." এই 'old times' sake' কথাটার মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন আমন্ত্রণ ছিল, একটা পুরোনো অধিকারবোধের আভাস ছিল, যা অরুণকে অস্বস্তিতে ফেলে দিল। বাড়ি ফেরার পথে গাড়িতে বসে অরুণ সম্পূর্ণ চুপচাপ ছিল। তার হাতে ছিল অদিতির বিজনেস কার্ডটা। সে কার্ডটার দিকে তাকিয়ে ভাবছিল, জীবনটা কত unpredictable! যে মেয়ের জন্য সে একদিন দেশ ছেড়েছিল, আজ সেই মেয়েই আবার তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তার মনে কোনো পুরোনো প্রেম জেগে ওঠেনি, কিন্তু একটা অদ্ভুত অস্থিরতা হচ্ছিল। অদিতি তার সেই অতীতকে মনে করিয়ে দিয়েছে, যে অতীতকে সে প্রায় ভুলতে বসেছিল—তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা, তার জেদ, তার সাফল্যের খিদে। সে যখন বাড়ি ফিরল, তখন অনেক রাত। ঘরটা অন্ধকার। সে ভাবল, রিয়া হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু শোবার ঘরে ঢুকে দেখল, রিয়া ল্যাম্পের আলোয় একটা বই হাতে নিয়ে বসে আছে। তার জন্য অপেক্ষা করছিল। "কী হলো? এত দেরি?" রিয়া জিজ্ঞেস করল। অরুণ তার পাশে বসে, কোনো ভূমিকা না করেই, সবটা খুলে বলল। অদিতির সাথে দেখা হওয়া থেকে শুরু করে তাদের সমস্ত কথোপকথন। সে কিছুই লুকালো না। এটা তাদের সম্পর্কের ভিত্তি ছিল—সম্পূর্ণ সততা। রিয়া চুপ করে সবটা শুনল। তার মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া বদলাল না। কিন্তু অরুণ দেখল, রিয়ার হাতটা তার বইয়ের পাতাটাকে শক্ত করে ধরে আছে। সব শোনার পর রিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর অরুণের হাতটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে বলল, "অতীতকে ভয় পেয়ে লাভ নেই। তুমি যদি ঠিক থাকো, কোনো ছায়া তোমার বর্তমানকে ছুঁতে পারবে না। আমার তোমার ওপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে।" রিয়ার কথায় ছিল অগাধ বিশ্বাস, কিন্তু তার পরেও সেই রাতে তাদের মধ্যে একটা অদৃশ্য দেওয়াল তৈরি হয়ে গেল। অরুণ তার অতীতের চিন্তায় মগ্ন ছিল, আর রিয়া তার ভবিষ্যতের আশঙ্কায়। তারা যখন ঘুমোতে গেল, তখন তাদের দুজনের মাঝখানে কয়েক ইঞ্চির যে দূরত্বটা ছিল, সেটা সেই রাতে কয়েক মাইলের মতো দীর্ঘ মনে হচ্ছিল। দুজনেই জেগে রইল, নিজেদের চিন্তার অন্ধকারে। অরুণ ভাবছিল সেই জীবনের কথা, যা সে ছেড়ে এসেছে। আর রিয়া ভাবছিল সেই অতীতের কথা, যা সে কোনোদিন দেখেনি, কিন্তু যা আজ তাদের দরজায় কড়া নেড়েছে। (চলবে)

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion