রাতটা গভীর। বাইরের পৃথিবীটা শান্ত, কিন্তু আমার ভেতরের জগৎটা তোলপাড়। অরুণ আমার পাশে শুয়ে আছে, ওর নিঃশ্বাস গভীর এবং নিয়মিত। ও হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে, কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই। আমি নিঃশব্দে পাশ ফিরে ওর দিকে তাকালাম। জানালার কাঁচ দিয়ে চুইয়ে আসা চাঁদের আলোয় ওর মুখটা আবছা দেখা যাচ্ছে। এই মুখটা গত তিন বছরে আমার সবচেয়ে চেনা, সবচেয়ে প্রিয় আশ্রয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু আজ রাতে, অদিতির কথা শোনার পর, আমার মনে হচ্ছে আমি যেন এই মানুষটার একটা অচেনা অংশকে দেখছি।
অরুণ যখন আমাকে সবটা খুলে বলছিল, তখন আমি খুব শান্তভাবে শুনেছি। আমার মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাইনি, কারণ আমি জানি অরুণ আমার কাছে সততা আশা করে। সে চেয়েছিল, আমি তাকে বিশ্বাস করি। আমি তাকে সেই বিশ্বাসটা দেখিয়েছি। কিন্তু সে যখন তার অতীতের কথা বলছিল, আমি, একজন সাহিত্যের ছাত্রী হিসেবে, আমার মনের অজান্তেই চরিত্রগুলোকে বিশ্লেষণ করছিলাম।
'অদিতি রায়'—এই নামটা শুধু একজন মহিলার নাম নয়, এটা একটা ধারণার নাম। অদিতি হলো সেই পৃথিবীর প্রতীক, যে পৃথিবী অরুণ ছেড়ে এসেছে। সে হলো আকাশছোঁয়া সাফল্য, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা আর বাস্তববাদী যুক্তির প্রতিমূর্তি। তার জগৎটা হলো সিঙ্গাপুর, নিউ ইয়র্ক, জুরিখ। আর আমার জগৎ? উত্তরপাড়ার এই পুরোনো বাড়ি, গঙ্গার ঘাট, আর যাদবপুরের লাইব্রেরি। সে সাম্রাজ্য গড়তে চায়, আর আমি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় শান্তি খুঁজি।
একটা সূক্ষ্ম, শীতল ভয় আমার শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে গেল। আমি কি অরুণের জন্য যথেষ্ট? যে মানুষটা বিশ্বের দরবারে নিজেকে প্রমাণ করেছে, তার কাছে কি আমার এই ছোট, আটপৌরে জগৎটা একদিন একঘেয়ে হয়ে যাবে? এই ভয়টা ঈর্ষা নয়, এটা আমার নিজের insecurity। আমি অদিতির মতো সুন্দরী বা সফল নই, আমি শুধু একজন সাধারণ অধ্যাপিকা। আমার ভালোবাসা, আমার এই শান্ত জীবন—এটা কি যথেষ্ট একজন মানুষকে ধরে রাখার জন্য, যার ওড়ার জন্য গোটা আকাশটা খোলা ছিল?
অরুণ ঘুমের মধ্যে সামান্য নড়ে উঠল। ওর হাতটা আমার দিকে এগিয়ে এল। আমি আলতো করে ওর আঙুলগুলো ধরলাম। ওর হাতের স্পর্শে আমার ভেতরের ভয়টা ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এলো। আমার মনে পড়ল, অরুণ তো অদিতির ওই জগৎটাকেই ছেড়ে আমার কাছে এসেছে। সে সংখ্যা ছেড়ে কবিতার কাছে আশ্রয় চেয়েছে। সে যদি ওই জীবনেই সুখী থাকত, তাহলে তো কোনোদিন ফিরত না।
আমার বিশ্বাসটা আবার দৃঢ় হলো। আমাদের সম্পর্কটা কোনো ব্যবসায়িক চুক্তি নয়, এটা বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এই বিশ্বাসকে আমি কোনো অতীতের ছায়া দিয়ে ম্লান হতে দেব না। আমি অরুণের বর্তমান, তার ভবিষ্যৎ। আর সেটাই সবচেয়ে বড় সত্যি। কিন্তু এই বিশ্বাসে পৌঁছানোর আগে, আমার মনটা বারবার ফিরে যাচ্ছিল তিন বছর আগের সেই পুজোর দিনগুলোতে, যখন আমাদের গল্পের শুরু হয়েছিল।
সপ্তমীর সন্ধ্যায় যখন আমি প্রথমবার অরুণের সাথে কথা বলেছিলাম, তখন আমার ওকে এক কথায় 'অহংকারী' বলে মনে হয়েছিল। আমাদের হাতে গড়া আলপনার পাশে রাখা LED স্ক্রিনটা নিয়ে ওর সেই তাচ্ছিল্যের মন্তব্যটা আমার আত্মসম্মানে লেগেছিল। কিন্তু ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আমার ধারণা বদলে গিয়েছিল। সেই চোখে অহংকার ছিল না, ছিল এক গভীর একাকীত্ব। মনে হয়েছিল, ও যেন এক নির্বাসিত রাজা, যে তার হারানো রাজ্যের জন্য হাহাকার করছে। আমি ওর সাথে তর্ক করেছিলাম, কিন্তু সেটা ওকে হারাবার জন্য নয়, ওকে এটা বোঝানোর জন্য যে ঐতিহ্য মানে শুধু অতীতকে আঁকড়ে ধরে থাকা নয়, ঐতিহ্য সময়ের সাথে সাথে জীবন্ত হয়ে ওঠে।
অষ্টমীর সকালটা ছিল অন্যরকম। আমি যখন অঞ্জলি দিচ্ছিলাম, তখন চোখ বন্ধ করেও আমি অনুভব করছিলাম, কেউ একজন আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। একটা অদ্ভুত শিহরণ আমার সারা শরীরে খেলে গিয়েছিল। অঞ্জলি শেষে চোখ খুলে আমি অরুণকে দেখেছিলাম। থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মানুষটার চোখে ছিল এক অপার্থিব মুগ্ধতা। সেই দৃষ্টিতে কোনো বাসনা ছিল না, ছিল এক নির্মল শ্রদ্ধা। সেই মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিল, এই মানুষটা শুধু আমার বাইরের রূপটা দেখছে না, সে যেন আমার আত্মার গভীরে প্রবেশ করার চেষ্টা করছে। আমার বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠেছিল।
নবমীর রাতে গঙ্গার ঘাটে বসে যখন ও নিজের জীবনের কথা বলছিল, তখন আমি আর থাকতে পারিনি। আমি ওর হাতটা ধরেছিলাম। আমি চেয়েছিলাম, ও বুঝুক যে ও একা নয়। ওর প্রত্যেকটা কথায় যে যন্ত্রণা ছিল, তা আমি নিজের মতো করে অনুভব করতে পারছিলাম। আমার গবেষণার বিষয় তো এটাই—নির্বাসন আর বিচ্ছিন্নতাবোধ। কিন্তু বইয়ের পাতায় পড়া তত্ত্বের সাথে বাস্তবের এই জীবন্ত উদাহরণকে মেলানো কত কঠিন!
আর তারপর... সেই ধুনুচি নাচ। আমি যখন নাচছিলাম, তখন আমি অন্য এক জগতে চলে গিয়েছিলাম। ঢাকের প্রত্যেকটা বোল আমার হৃদস্পন্দনের সাথে মিশে গিয়েছিল। আমি যখন চোখ খুলেছিলাম, তখন দেখেছিলাম অরুণ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর চোখে ছিল অপার বিস্ময়। সেই দৃষ্টি আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, ও আমাকে দেখেছে। শুধু রিয়া হিসেবে নয়, এক নারী হিসেবে, যার মধ্যে একই সাথে সারল্য আর শক্তি দুই-ই আছে।
আর তারপর সেই অসমাপ্ত মুহূর্তটা... সিঁড়িতে বসে ওর সেই এগিয়ে আসা, ওর উষ্ণ নিঃশ্বাস... আমার হৃদপিণ্ডটা যেন গলার কাছে চলে এসেছিল। আমি চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলাম। আমার সারা শরীর, মন—সবই যেন সেই মুহূর্তটার জন্য অপেক্ষা করছিল। কিন্তু ফোনটা বেজে উঠেছিল। হয়তো ভালোই হয়েছিল। কিছু জিনিস সহজে পেয়ে গেলে তার মূল্য থাকে না। সেই রাতের অসমাপ্ত চুম্বনটা আমাদের মধ্যে এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছিল, যা দশমীর সকালে পূর্ণতা পেয়েছিল।
এই স্মৃতিগুলো ভাবতে ভাবতে আমার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। অরুণ আমাকে ভালোবেসেছে আমার আমিটাকে। আমার সাধারণত্বকে, আমার জ্ঞানকে, আমার শক্তিকে। অদিতির সাথে আমার কোনো প্রতিযোগিতা নেই। কারণ আমরা দুজন দুই ভিন্ন জগতের মানুষ।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর আমি বুঝতে পারলাম, আমাদের দুজনের মধ্যেই একটা অস্বস্তিকর নীরবতা কাজ করছে। আমরা একসাথে চা খাচ্ছিলাম, কিন্তু কথা বলছিলাম না। অরুণ বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছিল, কিছু একটা বলতে গিয়েও বলতে পারছিল না।
আমিই নীরবতা ভাঙলাম। "অরুণ, তুমি কি কিছু নিয়ে ভাবছ?"
অরুণ আমার হাতটা ধরল। "রিয়া, আমি দুঃখিত। কাল রাতে অদিতির কথা বলে হয়তো তোমাকে কষ্ট দিয়েছি।"
আমি হাসলাম। "কষ্ট পাইনি। তবে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দেবে?"
"বলো।"
"কাল অদিতিকে দেখার পর, তার সাফল্যের কথা শোনার পর, তোমার কি একবারের জন্যও মনে হয়েছিল যে তুমি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে? মনে হয়েছিল কি, কলকাতাতে ফিরে এসে তুমি তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় সুযোগটা হারিয়ে ফেলেছো?"
আমার প্রশ্নটা শুনে অরুণ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। সে আমার চোখের দিকে সরাসরি তাকাল। তার দৃষ্টি ছিল শান্ত এবং স্থির।
"না, রিয়া। একবারের জন্যও না।" সে বলল। "বরং অদিতিকে দেখে আমার মনে হলো, আমি কত সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ওর জগৎটা বাইরে থেকে দেখতে খুব আকর্ষণীয়, কিন্তু ভেতরটা ঠিক আমার লন্ডনের ফ্ল্যাটটার মতোই—নিখুঁত, কিন্তু প্রাণহীন। ও যখন সাফল্যের কথা বলছিল, তখন ওর চোখে আমি কোনো আনন্দ দেখিনি, দেখেছি শুধু আরও ওপরে ওঠার খিদে। আর আমি যখন তোমার কথা ভাবি, তখন আমার মনে শান্তি আসে।"
সে আমার আরও কাছে এগিয়ে এল। "অদিতি ছিল আমার অতীত, রিয়া। যে অতীত আমাকে শিখিয়েছে, সাফল্য মানে কী নয়। আর তুমি হলে আমার বর্তমান আর ভবিষ্যৎ, যে আমাকে শিখিয়েছে, ভালোবাসা আর শান্তি মানে কী। তুমি কি বুঝতে পারছ, তোমাদের দুজনের মধ্যে কোনো তুলনাই হতে পারে না?"
অরুণের এই কথাগুলো আমার ভেতরের সমস্ত ভয়, সমস্ত insecurity ধুইয়ে দিল। আমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। এটা দুঃখের নয়, ছিল স্বস্তির, ভালোবাসার।
অরুণ আলতো করে আমার চোখের জল মুছিয়ে দিল। তারপর আমাকে জড়িয়ে ধরল। সেই আলিঙ্গনে ছিল অগাধ বিশ্বাস, নির্ভরতা আর ভালোবাসা।
আমি বুঝতে পারলাম, অতীতের ছায়া আমাদের ছুঁতে পারবে না। কারণ আমাদের বর্তমানটা ভালোবাসার আলোয় এতটাই উজ্জ্বল।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion