ছায়ার অনুসরণ ও একটি সতর্কবার্তা
ক্যাপ্টেন ডেভিসের ডায়েরিটা অরুণের কাছে একটা নেশার মতো হয়ে গিয়েছিল। সে জানত, এটা তার মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলছে, কিন্তু সে নিজেকে থামাতে পারছিল না। ডেভিসের গল্পটা তাকে শেষ পর্যন্ত জানতে হবে।
ডায়েরির পাতা যত উল্টোচ্ছিল, ডেভিসের মানসিক অবস্থার অবনতি তত স্পষ্ট হচ্ছিল। তার লেখাগুলো ক্রমশ অসংলগ্ন হয়ে উঠছিল। তিনি অঘোরনাথের ওপর প্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন। তিনি রাতের পর রাত জেগে থাকতেন, তার চারপাশে অদ্ভুত শব্দ শুনতেন এবং ছায়া দেখতেন।
“January 10, 1889. He knows I am watching him. I can feel his eyes on me, even when I am in the safety of my own quarters. Last night, a crow sat on my windowsill and stared at me with what I can only describe as human intelligence. It did not move until dawn. I am certain he sent it. This is not a man I am dealing with; it is a demon in human form.”
অরুণের নিজের অভিজ্ঞতাগুলোও বাড়তে লাগল। লাইব্রেরিতে বইগুলো নিজে থেকেই শেলফ থেকে পড়ে যেত। সে প্রায়ই তার নামের ফিসফিসানি শুনতে পেত, কিন্তু ঘুরে তাকালে কাউকেই দেখতে পেত না। একদিন সে আর্কাইভের একটা পুরনো আয়নায় মুহূর্তের জন্য তার নিজের প্রতিবিম্বের পাশে একটা লম্বা, কালো ছায়ামূর্তি দেখেছিল। ভয়ে তার রক্ত জল হয়ে গিয়েছিল।
সে তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু প্রিয়াকে ব্যাপারটা বলার চেষ্টা করেছিল। প্রিয়া, একজন সাংবাদিক, প্রথমে হেসে উড়িয়ে দিলেও অরুণের চোখের নিচের কালি আর তার বিধ্বস্ত চেহারা দেখে চিন্তিত হয়ে পড়ল।
“তুই ঠিক আছিস তো, অরুণ?” সে বলেছিল, তার গলায় উদ্বেগের সুর। “তোর কি খুব স্ট্রেস যাচ্ছে? ঠিক আছে, আমি তোর ওই ক্যাপ্টেন ডেভিসকে নিয়ে একটু খোঁজখবর নেব। দেখি যদি পুরনো কোনো পুলিশ রিপোর্টে বা আর্কাইভের অন্য কোথাও কিছু পাওয়া যায়।” প্রিয়ার যুক্তিবাদী মন অলৌকিকতায় বিশ্বাস করত না, কিন্তু সে একজন ভালো সাংবাদিকের মতো তথ্যের পেছনে ছুটতে ভালোবাসত।
অরুণ বুঝতে পারছিল, কেউ তার কথা বিশ্বাস করবে না। সে নিজেই কি পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছিল? সে একাই এই লড়াই লড়ছিল, ঠিক যেমন একশো বছরেরও বেশি আগে ক্যাপ্টেন ডেভিস লড়েছিলেন।
একদিন অরুণ যখন তার ‘পাতালঘরে’ কাজ করছিল, তখন সেই রহস্যময় ভদ্রলোক সেখানে এসে হাজির হলেন। অরুণ চমকে উঠল। আর্কাইভের এই অংশে সাধারণ পাঠকদের প্রবেশ নিষেধ।
“কিছু মনে কোরো না, যুবক,” ভদ্রলোক নরম কিন্তু কর্তৃত্বপূর্ণ গলায় বললেন। “আমি মিস্টার জ্যাকব। পুরনো বইয়ের একজন সংগ্রাহক। ধীরেনবাবু আমার পুরনো বন্ধু, তাই মাঝে মাঝে এদিকে আসার অনুমতি পাই।”
অরুণ কী বলবে বুঝতে পারছিল না। মিস্টার জ্যাকবের চোখ তার টেবিলের ওপর রাখা ডায়েরিটার ওপর স্থির।
“ক্যাপ্টেন আর্থার ডেভিস,” জ্যাকব যেন নিজের মনেই বললেন। “একজন দুর্ভাগ্যবান আত্মা। কিছু কিছু জ্ঞান মানুষকে বিনাশের দিকে ঠেলে দেয়।”
অরুণের বুকটা কেঁপে উঠল। “আপনি… আপনি এনার সম্পর্কে জানেন?”
জ্যাকব মৃদু হাসলেন। তার হাসিটা ছিল রহস্যময়। “এই লাইব্রেরি একটা সাগরের মতো, অরুণ। এর গভীরে অনেক কিছুই তলিয়ে আছে। কিছু মুক্তো, আর কিছু অভিশাপ। কোনটা তুলে আনতে হবে, সেটা জানা খুব জরুরি।” তিনি অরুণের কাঁধে হাত রেখে বললেন, “সব শব্দ উচ্চারণ করার জন্য নয়। কিছু শব্দ নীরব থাকাই শ্রেয়।”
এই বলে তিনি যেমন এসেছিলেন, তেমনই নিঃশব্দে চলে গেলেন। অরুণের মনে হলো, তার পায়ের তলার মাটি কাঁপছে। মিস্টার জ্যাকব কে? তিনি এতকিছু কী করে জানেন? তিনি কি তাকে সাহায্য করতে চাইছেন, নাকি সতর্ক করছেন? নাকি এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে?
ধীরেনবাবু, তার বয়স্ক সুপারভাইজার, ইদানিং অরুণকে অদ্ভুত চোখে দেখছিলেন। একদিন তিনি অরুণের ডেস্কে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “কী নিয়ে এত ব্যস্ত, অরুণ? তোমাকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে।”
অরুণ তাকে ডেভিসের ট্রাঙ্কটার কথা বলল। সবটা শুনে ধীরেনবাবুর মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তিনি নিচু গলায় বললেন, “কিছু কিছু জিনিস খুঁজে না পাওয়াই ভালো। পুরনো পাপকে বেশি ঘাঁটাতে নেই।”
এই বলে তিনি দ্রুত সেখান থেকে চলে গেলেন, অরুণের মনে একরাশ প্রশ্ন রেখে। ধীরেনবাবু কি কিছু জানেন? এই লাইব্রেরিতে কি এমন কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে যা সবাই এড়িয়ে চলতে চায়?
ডেভিসের ডায়েরি থেকে অরুণ জানতে পারল, অঘোরনাথ এক বিশেষ ধরনের তন্ত্র সাধনা করত, যেখানে শব্দের মাধ্যমে শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা হতো। সে বিশ্বাস করত, কিছু বিশেষ শব্দ বা মন্ত্র যদি সঠিকভাবে উচ্চারণ করা যায়, তবে তা দিয়ে মানুষের মনকে নিয়ন্ত্রণ করা, এমনকি তার আত্মাকেও বন্দী করা সম্ভব।
“February 2, 1889. I have found his sanctum. It is not in a temple, but in a hidden chamber beneath a printing press in the native town. The air there is thick with the smell of ink and something else… something ancient and foul. The walls are covered in symbols I have never seen before. He is not just a sorcerer; he is a scholar of the forbidden arts. He believes that words, when written or printed with a certain intent, can carry a curse across generations. He is creating a lexicon of shadows, a scripture of despair.”
এই লেখাটা পড়ার পর অরুণের মনে হলো, সে আর নিছক একজন পাঠক নয়। সে এই অভিশপ্ত আখ্যানের একটি অংশ হয়ে উঠেছে। এই ডায়েরিগুলো শুধু কাগজ নয়, এগুলো এক ভয়ঙ্কর ফাঁদ। আর সে সেই ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছে। তার সন্দেহ হতে লাগল লাইব্রেরির প্রতিটি কোণ, প্রতিটি বই, এমনকি নিজের সহকর্মীদেরও। কেউ কি তাকে চালনা করছে? নাকি এই গোটা লাইব্রেরিটাই সেই প্রাচীন তান্ত্রিকের শক্তির এক বিশাল আধার?
সেদিন রাতে অরুণ একটা দুঃস্বপ্ন দেখল। সে দেখল, সে লাইব্রেরির এক অন্তহীন গোলকধাঁধায় হারিয়ে গেছে। শেলফগুলো জীবন্ত হয়ে উঠেছে এবং তাকে চারপাশ থেকে চেপে ধরছে। আর দূর থেকে ভেসে আসছে একটা গম্ভীর, মন্ত্রের মতো কণ্ঠস্বর, যা বারবার তার নাম ধরে ডাকছে। ঘুম ভাঙার পর সে দেখল, তার সারা শরীর ভয়ে ঠান্ডা হয়ে গেছে, আর ঘরের কোণে অন্ধকারটা যেন আগের চেয়ে অনেক বেশি জীবন্ত।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion