Episode 4613 words0 views

ফিসফিসানির আর্কাইভ : চতুর্থ অধ্যায়

জ্ঞানের অন্ধকার দিক ও সন্দেহের জাল অরুণের জগৎটা ক্রমশ ছোট হয়ে আসছিল। তার দিনগুলো কাটত আর্কাইভের ধুলোমাখা নীরবতায় আর রাতগুলো কাটত বিনিদ্র আতঙ্কে। সে বুঝতে পারছিল, সে এক অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে লড়ছে, যার উৎস ক্যাপ্টেন ডেভিসের ওই অভিশপ্ত ডায়েরিগুলো। কিন্তু সেগুলো থেকে দূরে থাকার কথাও সে ভাবতে পারছিল না। এক অমোঘ আকর্ষণ তাকে টেনে নিয়ে যেত সেই হলদে হয়ে যাওয়া পাতাগুলোর দিকে। ডেভিসের লেখাগুলো তখন প্রায় পাগলের প্রলাপের মতো। তিনি বারবার লিখছিলেন এক ‘শব্দ-বন্ধন’ আচারের কথা। অঘোরনাথ বিশ্বাস করত, মানুষের আত্মাকে শব্দের জালে বন্দী করা সম্ভব। তার জন্য প্রয়োজন হয় সেই মানুষটির ব্যবহার করা কোনো লেখা বা তার কণ্ঠস্বর। “March 15, 1889. He has taken something of mine. A letter I wrote to my mother. My words… he will use my own words against me. He will weave them into his cursed scripture and bind me to it. I can feel him pulling at the threads of my soul. I am becoming a character in a story he is writing, and I do not know how it will end.” এই অংশটা পড়ার পর অরুণ নিজের ডেস্কের দিকে তাকাল। তার নিজের লেখা নোট, তার রিপোর্ট, তার অসমাপ্ত গবেষণাপত্র। তার মনে হলো, এই শব্দগুলোও আর নিরাপদ নয়। সে কি নিজের ফাঁদ নিজেই তৈরি করছে? তার সন্দেহ গিয়ে পড়ল ধীরেনবাবুর ওপর। একদিন সে সাহস করে ধীরেনবাবুর কেবিনে গেল। ধীরেনবাবু তখন একটা পুরনো পুঁথি নিয়ে ঝুঁকে পড়েছিলেন। অরুণকে দেখে তিনি চমকে উঠলেন। “আমি ক্যাপ্টেন ডেভিসের ব্যাপারে আরও কিছু জানতে চাই,” অরুণ সরাসরি বলল। “আপনি কিছু একটা জানেন, কিন্তু বলছেন না।” ধীরেনবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তিনি চশমাটা খুলে টেবিলের ওপর রেখে বললেন, “বসো, অরুণ। তোমাকে কিছু কথা বলার সময় शायद (perhaps) হয়েছে।” তিনি বলতে শুরু করলেন। প্রায় চল্লিশ বছর আগে, যখন তিনি এই লাইব্রেরিতে নতুন এসেছিলেন, তিনিও ওই ট্রাঙ্কটা খুঁজে পেয়েছিলেন। তিনিও ডেভিসের ডায়েরি পড়তে শুরু করেছিলেন এবং তার সাথেও একই রকম অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে শুরু করেছিল। তিনি এতটাই ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন যে, তিনি ডায়েরিগুলো আবার ট্রাঙ্কে ভরে ওটাকে শেলফের সবচেয়ে দুর্গম কোণে লুকিয়ে রেখেছিলেন, এই আশায় যে আর কেউ ওটা খুঁজে পাবে না। “এটা একটা অভিশাপ, অরুণ,” ধীরেনবাবু বললেন, তার কণ্ঠস্বর কাঁপছিল। “ওই তান্ত্রিক, অঘোরনাথ, সে কোনো সাধারণ মানুষ ছিল না। সে তার আত্মাকে ওই লেখাগুলোর সাথে বেঁধে দিয়ে গেছে। যে ওই ডায়েরি পড়বে, তার মন ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়বে এবং একসময় অঘোরনাথের শক্তি তাকে গ্রাস করবে। ক্যাপ্টেন ডেভিস ছিলেন তার প্রথম শিকার। আমি প্রায় দ্বিতীয় শিকার হতে গিয়েছিলাম।” “তাহলে আপনি ওগুলো নষ্ট করে ফেলেননি কেন?” অরুণ প্রায় চিৎকার করে উঠল। “চেষ্টা করেছিলাম,” ধীরেনবাবু ক্লান্ত গলায় বললেন। “পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কাগজগুলো পোড়েনি। একটা অক্ষরও নষ্ট হয়নি। এগুলো সাধারণ কাগজ নয়। এগুলো শক্তি দিয়ে তৈরি।” অরুণের পায়ের তলার মাটি সরে গেল। তাহলে বাঁচার কোনো উপায় নেই? সে কি সারাজীবনের জন্য এই অভিশাপের বোঝা বয়ে বেড়াবে? “একটা উপায় আছে,” ধীরেনবাবু বললেন। “তোমাকে ওই চক্রটা সম্পূর্ণ করতে হবে। ডেভিস যা শেষ করতে পারেনি, সেটা তোমাকে করতে হবে। তোমাকে অঘোরনাথের শক্তির উৎস খুঁজে বের করতে হবে এবং সেটাকে ধ্বংস করতে হবে।” ডেভিসের শেষ ডায়েরিটা, যেটা অরুণ ভয়ে এখনো খুলে দেখেনি, সেটার দিকে ইঙ্গিত করলেন ধীরেনবাবু। “এর মধ্যেই হয়তো কোনো সূত্র আছে। কিন্তু খুব সাবধান, অরুণ। ওই ডায়েরিটা সবচেয়ে বিপজ্জনক। ওটা পড়ার জন্য যে মানসিক শক্তির প্রয়োজন, তা হয়তো তোমার নেই।” ধীরেনবাবুর ঘর থেকে বেরিয়ে আসার পথে অরুণের দেখা হলো মিস্টার জ্যাকবের সাথে। জ্যাকব তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। “ধীরেনবাবু একজন ভীতু মানুষ, অরুণ। তিনি বিপদ থেকে পালিয়ে থাকতে ভালোবাসেন। কিন্তু সব বিপদ পালিয়ে যাওয়ার মতো নয়। কিছু বিপদের মুখোমুখি হতে হয়।” এই কথাগুলো অরুণের মনে সন্দেহের নতুন বীজ বপন করল। ধীরেনবাবু কি সত্যিই তাকে সাহায্য করতে চাইছেন, নাকি ভয় পেয়ে তাকে আরও বড় বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন? আর মিস্টার জ্যাকব? তার উদ্দেশ্য কী? তিনি কি মিত্র, নাকি আরও ভয়ঙ্কর কোনো শত্রু? অরুণ বুঝতে পারছিল, সে এক জটিল ষড়যন্ত্রের জালে জড়িয়ে পড়েছে, যেখানে কাউকেই পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায় না। (চলবে)

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion