শব্দ-বন্ধনের চক্র ও নিয়তির পরিহাস
অরুণ বুঝতে পারছিল, সে এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। সে হয় ভয়ে পিছিয়ে যেতে পারে এবং সারাজীবন এই ছায়ার ভয়ে বাঁচতে পারে, অথবা সে এই রহস্যের গভীরে গিয়ে শেষটা দেখতে পারে। সে দ্বিতীয় পথটাই বেছে নিল। তার মনে হলো, এটাই তার নিয়তি।
সেদিন রাতে, যখন লাইব্রেরি খালি হয়ে গেছে, চারদিকে শুধু নৈঃশব্দ্য আর অন্ধকার, অরুণ ক্যাপ্টেন ডেভিসের শেষ ডায়েরিটা হাতে তুলে নিল। তার হাত কাঁপছিল, কিন্তু তার চোখ ছিল স্থির। সে জানত, এই পাতাগুলোর মধ্যেই লুকিয়ে আছে তার মুক্তির পথ, অথবা তার সম্পূর্ণ ধ্বংস।
শেষ ডায়েরিটার চামড়ার মলাটটা ছিল খসখসে এবং বিবর্ণ। অরুণ যখন সেটা খুলল, একটা তীব্র কর্পূরের মতো গন্ধ তার নাকে এসে লাগল, যার সাথে মিশে ছিল শুকনো রক্তের হালকা আঘ্রাণ। ভেতরের পাতাগুলো ছিল অন্য ডায়েরিগুলোর চেয়ে আলাদা। এখানে ক্যাপ্টেন ডেভিসের পেঁচানো লেখার পাশে কালির আঁচড়ে আঁকা ছিল অদ্ভুত সব জ্যামিতিক নকশা আর চিহ্ন, যা অরুণ আগে কখনো দেখেনি।
ডেভিসের লেখাগুলো ছিল চূড়ান্ত হতাশা আর আতঙ্কে ভরা। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে অঘোরনাথের ফাঁদ থেকে তার মুক্তি নেই।
“April 5, 1889. The binding is almost complete. My thoughts are no longer my own. His whispers have become my inner voice. He showed me a vision last night—a vision of this very journal, preserved for a century, waiting for another curious mind. He does not seek immortality of the body, but of influence. He will live on through his words, infecting reader after reader, turning them into extensions of his own will.”
অরুণ শিউরে উঠল। তাহলে এটাই অঘোরনাথের উদ্দেশ্য! সে কোনো ভৌতিক উপদ্রব নয়, সে এক मानसिक (mental) সংক্রামক। সে জ্ঞানপিপাসু মনকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে নিজের প্রভাবকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। লাইব্রেরি, জ্ঞানের এই মন্দির, আসলে তার শিকারক্ষেত্র।
ডায়েরির শেষ পাতাগুলোতে ডেভিস মরিয়া হয়ে বাঁচার একটা পথ খুঁজেছিলেন। তিনি অঘোরনাথের ডেরায়, সেই ছাপাখানার নিচের গোপন কুঠুরিতে আবার গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি তান্ত্রিকের মূল مخطوطہ (manuscript) খুঁজে পেয়েছিলেন—একটা পুঁথি, যা মানুষের চামড়া দিয়ে বাঁধানো এবং কালির বদলে মানুষের রক্ত দিয়ে লেখা। ওটাই ছিল অঘোরনাথের শক্তির উৎস। ওটাই ছিল সেই ‘ছায়ার অভিধান’, ‘হতাশার শাস্ত্র’।
“April 20, 1889. I have found the book. It is a thing of pure evil. The symbols on its pages seem to writhe before my eyes. I know what I must do. I cannot destroy it, for it is protected by forces I cannot comprehend. But I can break the cycle. The binding ritual requires a final, spoken word—a name that seals the connection between the master and the vessel. He believes my name is Arthur Davies. But I will not give him that name. I will give him another.”
ডায়েরির শেষ লাইনটা ছিল প্রায় অস্পষ্ট, যেন লেখার শক্তিটুকুও লেখকের আর ছিল না।
“I will give him the name of the one who comes after me. The one who will read these words and understand. The one who will have the strength to end this. I give him the name… Arun.”
অরুণের হাত থেকে ডায়েরিটা পড়ে গেল। তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এটা অসম্ভব! একশো বছরেরও বেশি আগে লেখা একটা ডায়েরিতে তার নাম কী করে থাকতে পারে? এটা কি কোনো ছলনা, নাকি সময় আর নিয়তির এক ভয়ঙ্কর খেলা?
হঠাৎ আর্কাইভের অন্য প্রান্ত থেকে একটা মৃদু শব্দ ভেসে এল। একটা বই শেলফ থেকে মেঝেতে পড়ার শব্দ। কিন্তু এবার অরুণ ভয় পেল না। তার ভয়কে ছাপিয়ে উঠেছিল এক তীব্র ক্রোধ আর দৃঢ় সংকল্প। খেলাটা अब (now) ব্যক্তিগত হয়ে গিয়েছিল।
ধীরেনবাবু ঠিকই বলেছিলেন। তাকে এই চক্রটা সম্পূর্ণ করতে হবে। সে বুঝতে পারছিল, ক্যাপ্টেন ডেভিস আত্মহত্যা করেননি। তিনি নিজের আত্মাকে একটা শেষ মরিয়া চেষ্টায় অরুণের জন্য বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। তিনি অরুণকে একটা সুযোগ দিয়েছিলেন, একটা অস্ত্র দিয়েছিলেন।
অরুণ জানত তাকে কোথায় যেতে হবে। উত্তর কলকাতার কোনো এক পুরনো গলিতে সেই ছাপাখানাটা হয়তো এখনো আছে। তাকে অঘোরনাথের সেই চামড়ায় বাঁধানো পুঁথিটা খুঁজে বের করতে হবে। তারপর? তারপর কী করতে হবে, সেটা সে জানত না। কিন্তু সে জানত, তাকে যেতেই হবে।
সে লাইব্রেরি থেকে বেরোনোর জন্য পা বাড়াল। কিন্তু দরজার কাছে এসে সে থমকে দাঁড়াল। আবছা আলোয় সে দেখল, দরজার কাঁচের ওপর বাষ্প জমে আছে, আর সেই বাষ্পের ওপর কেউ যেন আঙুল দিয়ে একটা শব্দ লিখেছে—
‘অপেক্ষা করছি’
অভিশাপটা আর শুধু ডায়েরির পাতায় বা তার মনের ভেতরে সীমাবদ্ধ ছিল না। সেটা এখন তার বাস্তব জগতে নেমে এসেছে। এবং সেটা তার জন্য অপেক্ষা করছে।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion