Episode 10612 words0 views

দশম অধ্যায়: মুখোশের আড়ালে

অনির্বাণের দল যখন উত্তর কলকাতার প্রতিটি অলিগলি, প্রতিটি পরিত্যক্ত গুদামের নকশা নিয়ে চিরুনি তল্লাশি চালাচ্ছিল, তখন শমিতা সেন তার বালিগঞ্জের বাড়ির পড়ার ঘরে বসে তার গবেষণার শেষ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপে পৌঁছে গিয়েছিলেন। তার মাথায় তখন ঘুরছিল একটাই প্রশ্ন—"নবজাগরণ সমিতি"র এই আধুনিক, ভয়ঙ্কর সংস্করণটা কে চালাচ্ছে? কে এই নতুন নেতা, যে এত বুদ্ধিমান, এত সংগঠিত এবং এত নির্মম? তিনি বহিষ্কৃত সদস্যদের তালিকাটা একপাশে সরিয়ে রেখে, এবার মূল সমিতির প্রতিষ্ঠাতাদের তালিকাটা নিয়ে বসলেন। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন একজন অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং ব্রিটিশ সরকারের আস্থাভাজন জমিদার, আশুতোষ রায়চৌধুরী। তিনি ছিলেন এক জটিল চরিত্র—একদিকে ব্রিটিশদের অনুগত, অন্যদিকে বাংলার শিল্প-সাহিত্যের একজন বড় পৃষ্ঠপোষক। শমিতা সেন আনমনে আশুতোষ রায়চৌধুরীর বংশলতিকাটা ইন্টারনেটে সার্চ করতে লাগলেন। বর্তমান প্রজন্মের একজনের নামে এসে তার চোখ আটকে গেল। শ্রীকান্ত রায়চৌধুরী। শহরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পপতি এবং শ্রদ্ধেয় সমাজসেবী। তার পরিচিতি ছিল একজন সংস্কৃতি প্রেমী এবং মানবদরদী হিসেবে। বাংলার পুরনো স্থাপত্য, পটচিত্র, শাস্ত্রীয় সংগীত —সবকিছু বাঁচিয়ে রাখার জন্য তিনি কোটি কোটি টাকা দান করেছেন। তাকে সবাই একবাক্যে শ্রদ্ধা করত। তার নামটা সন্দেহের তালিকার কয়েক হাজার মাইলের মধ্যেও ছিল না। শমিতা সেনের বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। একটা অসম্ভব চিন্তা তার মাথায় বিদ্যুতের মতো খেলে গেল। তিনি দ্রুত সাইবার সেলের খুঁজে পাওয়া সেই অ্যানোনিমাস ব্লগটার কথা ভাবলেন। ব্লগটার সার্ভার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যে অর্থ প্রদান করা হয়েছিল, তা একটা শেল কর্পোরেশনের মাধ্যমে করা হয়েছিল। কর্পোরেশনটার নাম ছিল ‘এআরসি হেরিটেজ ফাউন্ডেশন’। ARC. Ashutosh Roy Chowdhury. শমিতা সেনের হাত কাঁপছিল। তিনি দ্রুত শ্রীকান্ত রায়চৌধুরীর প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন চ্যারিটেবল ট্রাস্টের তালিকা দেখতে লাগলেন। তার মধ্যে একটির নাম ছিল ‘বেঙ্গল সানরাইজ ফাউন্ডেশন’। প্রতীক—উদীয়মান সূর্য। সবকিছু একটা ভয়ঙ্কর ছবিতে রূপান্তরিত হলো। শ্রীকান্ত রায়চৌধুরী, যিনি বাইরে থেকে বাংলার ঐতিহ্য বাঁচানোর অভিনয় করছেন, তিনিই আড়ালে থেকে তার পূর্বপুরুষের কলঙ্কিত, গুপ্ত সমিতিকে পুনর্জীবিত করেছেন। তার সমাজসেবা ছিল একটা নিখুঁত, দুর্ভেদ্য মুখোশ। তিনি বিশ্বাস করতেন, তার পূর্বপুরুষের ‘বিশুদ্ধ’ সমিতিকে যারা কলঙ্কিত করেছিল, তাদের বংশধরদের শেষ করে দিয়েই তিনি বাংলার আসল ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে পারবেন। তিনি কাঁপা কাঁপা হাতে অনির্বাণকে ফোন করলেন। "অনির্বাণ, আমি মাস্টারমাইন্ডকে খুঁজে পেয়েছি। নামটা শুনলে তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না।" অনির্বাণ যখন শ্রীকান্ত রায়চৌধুরীর নামটা শুনল, সে এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। "It's impossible, madam! আমি ওনাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি। উনি আমাদের পুলিশ ফান্ডেও ডোনেট করেন।" "তিনিই সেই ব্যক্তি, অনির্বাণ," শমিতা সেন দৃঢ় গলায় বললেন। "ARC Heritage Foundation, Bengal Sunrise Foundation—সবকিছু মিলে যাচ্ছে।" ঠিক সেই সময়েই অনির্বাণের টেক-টিমও একটা চূড়ান্ত ব্রেকথ্রু নিয়ে এল। তারা ‘এআরসি হেরিটেজ ফাউন্ডেশন’-এর নামে রেজিস্টার করা একটা সম্পত্তির ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে, যা কয়েক বছর আগে হেরিটেজ বিল্ডিং সংরক্ষণের নামে কেনা হয়েছিল। ঠিকানাটা হলো—আর্মেনিয়ান ঘাটের কাছে একটা পরিত্যক্ত পাটকলের গুদাম। সেই গুদামের পাশ দিয়েই একসময় কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টের ট্রামলাইন যেত। সব সূত্র একটা বিন্দুতে এসে মিলে গেল। শমিতা সেনের ইতিহাস, অনির্বাণের প্রযুক্তি—সবকিছুই একজনের দিকে আঙুল তুলছিল। "We have him," অনির্বাণ তার ওয়াকিটকিতে শীতল গলায় বলল। "We have the location. We have the target." যুদ্ধক্ষেত্রের কন্ট্রোল রুমে, প্রকাণ্ড স্ক্রিনে শ্রীকান্ত রায়চৌধুরীর হাসিমুখ, সৌম্যকান্তি ছবিটা ভেসে উঠছিল। মুখোশের আড়ালের আসল মুখটা ছিল আরও অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। অনির্বাণ জানত, সে একজন সাধারণ অপরাধীকে ধরতে যাচ্ছে না। সে যাচ্ছে একজন আদর্শবাদী, অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং নির্মম দৈত্যের গুহায়। সেখানে সামান্যতম ভুল করারও কোনো সুযোগ নেই, কারণ রিয়ার জীবনটা এখন সময়ের সাথে বাঁধা। সে তার সেরা কম্যান্ডোদের নিয়ে একটা স্ট্রাইক টিম তৈরি করল। তাদের প্রত্যেকের পরনে ছিল কালো পোশাক, চোখে নাইট-ভিশন গগলস, হাতে অত্যাধুনিক সাইলেন্সার লাগানো অস্ত্র। “আমাদের দুটো লক্ষ্য,” অনির্বাণ তার টিমকে শেষবারের মতো ব্রিফ করল, তার কণ্ঠস্বর ছিল শান্ত কিন্তু তাতে ছিল এক ভয়ঙ্কর দৃঢ়তা। “এক, রিয়া চৌধুরীকে অক্ষত অবস্থায় বের করে আনা। এটা আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। দুই, শ্রীকান্ত রায়চৌধুরী এবং তার দলের সবাইকে জীবিত ধরা। আমরা আইন নিজের হাতে তুলে নেব না। No casualties on our side. Understood?" টিমটা নিঃশব্দে মাথা নাড়ল। মধ্যরাতের অন্ধকারে, গঙ্গার ধার দিয়ে নিঃশব্দে এগিয়ে চলল পুলিশের কালো, বৈদ্যুতিক গাড়িগুলোর কনভয়। কলকাতা শহরের বুকে আধুনিক আইন এবং অন্ধকার ইতিহাসের মধ্যে শেষ এবং সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যুদ্ধের জন্য মঞ্চ প্রস্তুত হচ্ছিল। (চলবে)

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion