Episode 9941 words0 views

নবম অধ্যায়: সময়ের বিরুদ্ধে দৌড়

রিয়া চৌধুরীর নিখোঁজ হওয়ার খবরটা ছিল বারুদের স্তূপে জ্বলন্ত দেশলাই কাঠি ছুঁড়ে দেওয়ার মতো। অনির্বাণের যুদ্ধক্ষেত্র, যা এতদিন ছিল একটা শীতল, বুদ্ধিনির্ভর তদন্তের জায়গা, তা মুহূর্তে এক উত্তপ্ত, আবেগতাড়িত এবং মরিয়া উদ্ধার অভিযানের কন্ট্রোল রুমে পরিণত হলো। অনির্বাণের পেশাগত শান্তভাবে তার যে বর্মটা সে সবসময় পরে থাকত, তা যেন এক ঝটকায় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। তার চোখে ফুটে উঠল তীব্র উদ্বেগ, আত্মগ্লানি এবং এক হিমশীতল ক্রোধ। "I want her back!" অনির্বাণ তার টাস্ক ফোর্সের সামনে প্রায় চিৎকার করে উঠল। তার কণ্ঠস্বর ঘরের দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। "এখন থেকে আমাদের একটাই লক্ষ্য—রিয়া চৌধুরীকে খুঁজে বের করা।Forget protocol, forget every single rule in the book. I want every resource, every man, dedicated to this single objective." শহরের প্রতিটি ইউনিটকে সতর্ক করে দেওয়া হলো। রিয়ার ছবি, তার গাড়ির নম্বর, তার শেষ জানা অবস্থান—সবকিছু শহরের প্রতিটি নাকা চেকিং পয়েন্টে, প্রতিটি টহলদারি ভ্যানে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। কিন্তু অনির্বাণ জানত, ‘নবজাগরণ সমিতি’ এতটাই ধূর্ত এবং সংগঠিত যে তারা কোনো সাধারণ অপরাধীদের মতো ভুল করবে না। রিয়াকে খুঁজে বের করার আসল চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে তাদের একমাত্র ডিজিটাল পদচিহ্নে। “ওই ব্লগটা!” অনির্বাণ সাইবার সেলের প্রধান, সোহম সেনের দিকে ঘুরে তাকাল। তার চোখে ছিল এক ভয়ঙ্কর জেদ। “আমি জানি ওটা ট্রেস করা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু ‘প্রায়’ শব্দটা শোনার জন্য আমি এখানে বসে নেই। I need a miracle. Get me one!” সাইবার সেলের টিম তাদের সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তাদের আঙুলগুলো কি-বোর্ডের ওপর ঝড় তুলছিল। তারা শুধু আইপি ট্রেস করার চেষ্টাই করছিল না, তারা ব্লগের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য, এমনকি তার HTML কোডিং-এর মধ্যেও কোনো অসঙ্গতি বা লুকানো বার্তা খোঁজার চেষ্টা করছিল। ঘরের নিস্তব্ধতা জুড়ে ছিল শুধু সার্ভারের একটানা গুঞ্জন আর কি-বোর্ডের দ্রুতগতির খটখট শব্দ। অন্যদিকে, অধ্যাপিকা শমিতা সেন তার বালিগঞ্জের বাড়ির পড়ার ঘরে বসে নিজের লড়াইটা লড়ছিলেন। তার সামনে খোলা ছিল ‘নবজাগরণ সমিতি’র পুরনো রেকর্ড। তিনি বুঝতে পারছিলেন, রিয়াকে বাঁচানোর জন্য শুধু প্রযুক্তি যথেষ্ট নয়। তাদের খুনির মনস্তত্ত্ব বুঝতে হবে, তার পরবর্তী পদক্ষেপটা তার আদর্শের নিরিখে অনুমান করতে হবে। তিনি খুঁজছিলেন তাদের কোনো নির্দিষ্ট আস্তানা বা গোপন বৈঠকের জায়গার কথা, যা হয়তো আজও কোনো না কোনোভাবে টিকে আছে। সমিতির নথিতে বারবার একটা জায়গার উল্লেখ আসছিল—গঙ্গার ধারে তাদের পুরনো ‘শক্তি কেন্দ্র’। চব্বিশ ঘন্টা যেন চব্বিশটা শতাব্দীর মতো দীর্ঘ মনে হচ্ছিল। শহরের প্রতিটি কোণায় তল্লাশি চালিয়েও রিয়ার কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। অনির্বাণের হতাশা বাড়ছিল, নিজের ওপর রাগ বাড়ছিল। সে কি রিয়াকে আরও আগে সতর্ক করতে পারত না? তার জেদ এবং নির্ভীকতার প্রতি সে মনে মনে যেটুকু শ্রদ্ধা করত, সেটাই এখন তার কাছে আত্মগ্লানির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ঠিক সেই সময়ে, রাত ন’টার প্রাইম টাইমে, একটা অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটল। শহরের সমস্ত প্রথম সারির নিউজ চ্যানেলের সম্প্রচার হঠাৎই বন্ধ হয়ে গেল। তার জায়গায় স্ক্রিনে ভেসে উঠল ‘নবজাগরণ সমিতি’র সেই উদীয়মান সূর্যের প্রতীক। একটা গোটা শহরের সম্প্রচার ব্যবস্থাকে তারা হ্যাক করে নিয়েছিল। তারপর শুরু হলো সেই ভিডিও। একটা অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে ঘরে রিয়া চৌধুরীকে একটা চেয়ারে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে। তার মুখে কাপড় গোঁজা, কিন্তু তার চোখ দুটো আগুনের গোলার মতো জ্বলছে। তাতে ভয় নয়, ছিল তীব্র ঘৃণা এবং প্রতিবাদের আগুন। ক্যামেরার পেছনে ছিল একজন লোক, যার মুখটা অন্ধকারে ঢাকা, কিন্তু তার কণ্ঠস্বর ছিল শীতল, শিক্ষিত, মার্জিত এবং সম্মোহনী। ভয়েস মডিউলেটর ব্যবহার করে তার আসল স্বরটা বদলে দেওয়া হলেও, তার কথা বলার ভঙ্গিতে ছিল এক প্রশ্নাতীত কর্তৃত্ব। “বাংলার মানুষ,” সেই ছায়ামূর্তি বলতে শুরু করল, তার sofisticado বাংলা উচ্চারণে। “আপনারা যাকে ‘ঐতিহাসিক’ বলছেন, সে কোনো খুনি নয়। সে ইতিহাসের সেই ঋণের সুদ আদায়কারী, যা এতদিন ধরে বাকি পড়েছিল। যে পরিবারগুলো বাংলার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, বাংলার আত্মাকে শোষণ করে নিজেদের সৌধ গড়েছে, আমরা শুধু তাদের কলঙ্কমোচন করছি। এই শুদ্ধি যজ্ঞের প্রয়োজন ছিল, কারণ সমাজ যখন ভেতর থেকে পচে যায়, তখন তাকে সারিয়ে তোলার জন্য সার্জারির প্রয়োজন হয়।” এরপর ক্যামেরাটা রিয়ার দিকে ঘুরল। “এই মহিলা,” ছায়ামূর্তি বলে চলল, “সেই corrupt মিডিয়ার প্রতিনিধি, যারা সত্যিটা দেখানোর বদলে শুধু চাঞ্চল্য বিক্রি করে। যারা এই পাপী পরিবারগুলোকে সমাজের নায়ক বানিয়ে রেখেছে। তাই, ইতিহাস এবার মিডিয়ারও বিচার করবে। আগামী চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে যদি এই শহরের মানুষ আমাদের এই শুদ্ধি যজ্ঞকে প্রকাশ্যে সমর্থন না করে, যদি তারা নিজেদের ভুল স্বীকার না করে, তাহলে এই মহিলার পরিণতিও হবে তার পূর্বসূরিদের মতোই। বিচার জনতার আদালতে। সময় শুরু হলো এখন।” ভিডিওটা শেষ হয়ে গেল। স্ক্রিনটা কালো হয়ে গেল। কন্ট্রোল রুমে পিন পড়ার নিস্তব্ধতা। এটা কোনো মুক্তিপণের দাবি ছিল না। এটা ছিল একটা আদর্শগত ঘোষণা, একটা চরমপত্র। ‘নবজাগরণ সমিতি’ এবার পুরো শহরকে তাদের খেলার মধ্যে টেনে নিয়েছিল, তাদের বিচারক বানিয়ে দিয়েছিল। অনির্বাণ রাগে টেবিলে এমন একটা ঘুষি মারল যে তার হাতটা ছড়ে গেল। তারা অসহায়, সময়ের বিরুদ্ধে একটা অসম্ভব দৌড়ে নেমেছে। কিন্তু হতাশায় ভেঙে পড়ার আগেই তার ফোন বেজে উঠল। শমিতা সেন। “অনির্বাণ, ভিডিওটা আমি পনেরোবার ধরে রিপিট করে দেখছি,” অধ্যাপিকার গলা ছিল উত্তেজিত। “রিয়ার পেছনের দেওয়ালটা দেখো। ওটা সাধারণ ইঁটের দেওয়াল নয়। ওটা উনিশ শতকের শুরুর দিকের ‘ইংলিশ বন্ড’ স্টাইলের গাঁথনি, যা মূলত ব্রিটিশ ফ্যাক্টরি বা গুদামে ব্যবহার করা হতো। আর তুমি কি শব্দগুলো খেয়াল করেছ? আট সেকেন্ডের মাথায় একটা জাহাজের ভোঁ শোনা গেল, খুব ক্ষীণ। আর একুশ সেকেন্ডের মাথায় একটা হালকা ঘটাং ঘটাং শব্দ... ওটা পুরনো ট্রাম লাইনের ওপর দিয়ে মালগাড়ির চাকা যাওয়ার শব্দ হতে পারে!” অনির্বাণ ভিডিওটা আবার প্লে করল। সাউন্ড এনহ্যান্স করে শুনল। হ্যাঁ! শব্দগুলো আছে। এতদিন ধরে ক্রাইম সিনের ডিটেলে মনোযোগ দিতে গিয়ে সে নিজেই এই সূত্রগুলো এড়িয়ে গিয়েছিল। “পুরনো ইঁটের গাঁথনি, জাহাজের শব্দ, আর ট্রাম লাইন… এর মানে কী?” অনির্বাণ জিজ্ঞেস করল। “এর মানে হলো, রিয়াকে সম্ভবত গঙ্গার ধারে এমন কোনো পুরনো গুদাম বা কারখানায় রাখা হয়েছে, যার পাশ দিয়ে একসময় ট্রামের মালবাহী লাইন যেত। কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টের অধীনে উত্তর কলকাতার চিৎপুর, আর্মেনিয়ান ঘাট বা স্ট্র্যান্ড রোড অঞ্চলে এমন অনেক পরিত্যক্ত জায়গা আছে,” শমিতা সেন বললেন। একটা ক্ষীণ কিন্তু জোরালো আশার আলো। অনির্বাণ সাথে সাথে তার টিমকে নির্দেশ দিল, “Get me a map of old Calcutta's tram lines and the port trust warehouses. I want every derelict warehouse and factory on that entire stretch scouted. We are running out of time. Move!” যুদ্ধটা এখন একটা নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে এল। (চলবে)

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion