গভীর রাতে শহরের ঘুমন্ত রাস্তা ধরে অনির্বাণের কালো SUV ছুটে চলেছিল। গাড়ির সাইরেনের তীক্ষ্ণ শব্দ রাতের নিস্তব্ধতাকে ফালা ফালা করে দিচ্ছিল, যেন আসন্ন বিপদের পূর্বাভাস। অনির্বাণ স্টিয়ারিং হুইলটা শক্ত করে ধরেছিল, তার চোয়াল ছিল কঠিন। তার মাথায় তখন শুধু একটাই চিন্তা—প্যাটার্ন। সে জানত, সে শুধু আরও একটা ক্রাইম সিনে যাচ্ছে না; সে যাচ্ছে এক মনোবিকলনকারী শিল্পীর তৈরি করা দ্বিতীয় প্রদর্শনী দেখতে। প্রথম খুনের পর সে বুঝেছিল, খুনি শুধু মারতে চায় না, সে কিছু বলতে চায়। এখন প্রশ্ন হলো, দ্বিতীয় লাশের মাধ্যমে সে কোন গল্পটা শোনাতে চাইছে?
বিমল মিত্রের টালিগঞ্জের বাগানবাড়িটা ছিল ক্ষমতার এক নির্লজ্জ আস্ফালন। বিশাল লোহার গেটের মাথায় বসানো সিংহের মূর্তি, সবুজ মখমলের মতো লন আর তার মাঝে ইতালীয় ভাস্কর্যের অনুকরণে তৈরি ফোয়ারা—সবকিছুই যেন চিৎকার করে নিজের প্রাচুর্যের জানান দিচ্ছিল। বাড়ির সামনে পুলিশের গাড়ি আর মিডিয়ার ভ্যানের ভিড় আগেরবারের থেকেও বেশি। অনির্বাণ গাড়ি থেকে নামতেই রিপোর্টারদের সম্মিলিত গুঞ্জন আর ক্যামেরার ফ্ল্যাশের ঝলকানি তাকে ঘিরে ধরল। সে পাথরের মতো মুখ করে ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেল।
ভেতরের দৃশ্যটা ছিল বাইরের মতোই বিশৃঙ্খল, কিন্তু তার মাঝেও ছিল এক অদ্ভুত রকমের পরিকল্পিত স্থিরতা। বিমল মিত্রকে তার ব্যক্তিগত ‘গেম রুম’-এ খুন করা হয়েছে। ঘরটা ছিল আধুনিক বিলাসিতা আর পুরনো দিনের জমিদারির এক অদ্ভুত মিশ্রণ। একদিকে ছিল কাঁচের দেওয়াল জোড়া ওয়াইন র্যাক আর একটা অত্যাধুনিক হোম থিয়েটার সিস্টেম। অন্যদিকে, দেওয়াল জুড়ে ছিল বাঘ-হরিণের মাথা, শিকার করা বন্দুক আর পুরনো দিনের অয়েল পেন্টিং। এই সবকিছুর মাঝখানে রাখা ছিল একটা দামী, হাতির দাঁতের কারুকার্য করা দাবার টেবিল।
সেই টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে ছিল বিমল মিত্রের স্থূল শরীরটা। তার পরনে ছিল দামী সিল্কের সাদা পাঞ্জাবি, যা এখন বুকের কাছ থেকে চুঁইয়ে পড়া তাজা রক্তে লাল দাগ। তার বিস্ফারিত চোখ দুটো যেন দাবার বোর্ডের দিকেই তাকিয়ে আছে, মুখে তীব্র বিস্ময় আর অবিশ্বাসের ছাপ। বুক ভেদ করে গেঁথে আছে একটা পুরনো দিনের রুপোর বাঁটওয়ালা ছোরা, যার নকশাটা মোঘল আমলের কারুকার্যের কথা মনে করিয়ে দেয়।
অনির্বাণ খুব সাবধানে, প্রায় নিঃশব্দে এগিয়ে গেল। ডক্টর প্রসূন সেনগুপ্ত তার স্বভাবসিদ্ধ গাম্ভীর্যের সাথে দেহের প্রাথমিক পরীক্ষা করছিলেন।
“কী বুঝলে, প্রসূন দা?” অনির্বাণ নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল।
“এক কোপেই কাজ শেষ। ছোরাটা সরাসরি হৃৎপিণ্ড ভেদ করে গেছে। যে মেরেছে, সে খুব ভালোভাবেই জানে মানবদেহের কোথায় আঘাত করতে হয়। জোরের চেয়েও এখানে দক্ষতার ভূমিকা বেশি,” প্রসূন বললেন। “ছোরাটা দেখে মনে হচ্ছে অ্যান্টিক, কিন্তু এটা একটা নিখুঁত রেপ্লিকা। খুনি ইতিহাসকে ভালোবাসে, কিন্তু প্রমাণ ছেড়ে যাওয়ার মতো বোকা সে নয়।”
অনির্বাণ ঝুঁকে দাবার বোর্ডটার দিকে তাকাল। তার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। এটা কোনো সাধারণ খেলা নয়, যা মাঝপথে থেমে গেছে। এটা একটা সাজানো চিত্রনাট্য। বোর্ডের ওপর ঘুঁটিগুলো এক বিশেষ ভঙ্গিমায় সাজানো, যা একপেশে যুদ্ধের ইঙ্গিত দিচ্ছে। সাদা পক্ষের রাজা (কিং) তার ঘরের কাছেই কোণঠাসা, তাকে ঘিরে ধরেছে কালো পক্ষের কয়েকটি শক্তিশালী ঘুঁটি—একটি নৌকা, একটি ঘোড়া এবং একটি গজ। সাদা পক্ষের নিজেরই মন্ত্রী (কুইন) এবং গজ বোর্ডের অন্য প্রান্তে এমনভাবে দাঁড়িয়ে, যেন তারা ইচ্ছে করেই রাজাকে অরক্ষিত রেখে দিয়েছে।
“বিশ্বাসঘাতকতা,” অনির্বাণ প্রায় নিজের অজান্তেই বিড়বিড় করে বলল। সে পকেট থেকে ফোন বের করে দ্রুত ইন্টারনেটে সার্চ করল—‘Famous betrayals in Bengal history’। প্রথম যে ফলাফলটা এল, সেটা হলো—‘পলাশীর যুদ্ধ’।
ঠিক তখনই ইন্সপেক্টর বিক্রম রাঠোর তার দলবল নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। তার মুখে বিরক্তি এবং ক্রোধ একসাথে ফুটে উঠেছিল।
“আবার নাটক! এসব কী হচ্ছে বক্সী? খুনিটা কি পুলিশকে বোকা মনে করে?” রাঠোর গর্জে উঠলেন। “কী বলছে তোমার ইতিহাস বই? এটা কি আকবর না হুমায়ূনের কাজ?”
“এটা ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত, স্যার,” অনির্বাণ শান্ত কিন্তু দৃঢ় গলায় বলল। “খুনি আমাদের কিছু বলতে চাইছে।”
“চুপ করো!” রাঠোর ধমকে উঠলেন। “সে যা বলতে চাইছে, তা হলো কলকাতা পুলিশ অকেজো! বাড়ির সিসিটিভি ফুটেজ চেক করো। কেয়ারটেকার, মালি, ড্রাইভার—সবাইকে তুলে নিয়ে যাও। থার্ড ডিগ্রি দিলেই সব গড়গড় করে বলে দেবে।”
“স্যার, বাড়ির সিসিটিভি গত দুদিন ধরে খারাপ। সার্ভিসিং-এর জন্য খোলা হয়েছিল,” রানা ভয়ার্ত গলায় রিপোর্ট দিল। “খুনি খুব পরিকল্পনা করেই ঢুকেছে।”
রাঠোর রাগে গজরাতে লাগলেন। অনির্বাণ তার কথায় কান না দিয়ে বোর্ডের পাশে পড়ে থাকা একটা জিনিসের দিকে ঝুঁকল। একটা কালো রঙের গজ, যেটা মাঝখান থেকে আড়াআড়িভাবে ভাঙা। খুনি ইচ্ছে করেই এটা এখানে ফেলে গেছে। একটা ভাঙা ঘুঁটি… একটা ভাঙা বিশ্বাস।
ঘটনাস্থল থেকে বেরিয়ে আসার সময় রিয়া চৌধুরী প্রায় পথ আটকে দাঁড়াল। তার চোখে ছিল উত্তেজনার ছাপ।
“মিস্টার বক্সী, আমি ভেতরের খবর পেয়েছি। একটা দাবার বোর্ড, একটা চেকমেট। খুনি কি নিজেকে খেলার মাস্টারমাইন্ড মনে করছে? কলকাতা কি একজন ‘চেসবোর্ড কিলার’-এর শিকার?”
অনির্বাণ এবার থামল। তার চোখেমুখে ছিল তীব্র ক্লান্তি, কিন্তু দৃষ্টি ছিল ইস্পাতের মতো ধারালো। সে রিয়ার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল, “রিয়া, তুমি ভুল লোককে ভুল প্রশ্ন করছ। খুনি খেলা খেলছে না। সে ইতিহাস বলছে, তার নিজের ভাষায়। আর তুমি যদি সেই ইতিহাসটা না জানো, তাহলে এই গল্পের একটা লাইনও কোনোদিন বুঝতে পারবে না। এটা কোনো ব্রেকিং নিউজ নয়, এটা একটা পুরনো ক্ষত যা আবার রক্তাক্ত হচ্ছে।”
কথাটা বলে অনির্বাণ আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। গাড়িতে উঠে সে সোজা নিজের অফিসের দিকে রওনা দিল। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ির ভেতরেও তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছিল। সে বুঝতে পারছিল, তার ডিজিটাল বিশ্ব, তার ডেটা এবং অ্যালগরিদম এই রহস্যের গভীরে পৌঁছানোর জন্য যথেষ্ট নয়। এই ধাঁধার সমাধান লুকিয়ে আছে পুরনো বইয়ের ধুলোমাখা পাতায়, বিস্মৃত ইতিহাসের অলিগলিতে। তাকে সেই জগতে প্রবেশ করতেই হবে।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion