পরদিন সকালটা ছিল আগের রাতের মতোই বিষণ্ণ। অনির্বাণ সারারাত তার অফিসে কাটিয়েছে। কফির পর কফি খেয়ে, সে তার হোয়াইট বোর্ডের সামনে পায়চারি করছিল। বোর্ডের ওপর দুটো খুনের ছবি, ক্লু এবং সম্ভাব্য যোগসূত্রগুলো আঁকিবুকি কাটা। কিন্তু ছবিটা তখনও অসম্পূর্ণ।
সে বুঝতে পারছিল, তার একজন পথপ্রদর্শক দরকার। একজন শেরপা, যিনি তাকে ইতিহাসের এই এভারেস্টে ওঠার পথ দেখাবেন। সে তার ল্যাপটপ খুলে কলকাতা এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ওয়েবসাইট ঘাঁটতে শুরু করল। বিভিন্ন অধ্যাপকের প্রোফাইল, তাদের গবেষণাপত্র—সবকিছু খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। অনেকেই ছিলেন স্বনামধন্য, কিন্তু অনির্বাণের এমন একজনকে দরকার ছিল যার কাজ শুধু ঘটনা বা তারিখের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, যিনি ঘটনার পেছনের মনস্তত্ত্ব নিয়ে কাজ করেন।
ঘন্টাখানেক খোঁজার পর একটা নামে তার চোখ আটকে গেল—অধ্যাপিকা শমিতা সেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপিকার গবেষণার বিষয় ছিল ‘ঔপনিবেশিক বাংলার ষড়যন্ত্র, ক্ষমতার রাজনীতি এবং তার মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব’। অনির্বাণ তার লেখা একটা গবেষণাপত্রের সারাংশ পড়ল, যেখানে তিনি পলাশীর যুদ্ধের বিশ্বাসঘাতকদের শুধু রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, তাদের ব্যক্তিগত লোভ এবং নিরাপত্তাহীনতার মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকেও বিশ্লেষণ করেছেন। অনির্বাণ বুঝতে পারল, সে তার শেরপাকে খুঁজে পেয়েছে।
কলেজ স্ট্রিট চত্বরে যখন অনির্বাণ পৌঁছাল, তখন প্রায় দুপুর। চারদিকে বইয়ের দোকান, প্রেস, আর তরুণ ছাত্রছাত্রীদের ভিড়ে একটা জীবন্ত পরিবেশ। লালবাজারের ক্ষমতার করিডোর থেকে এই জগৎটা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। ইতিহাস বিভাগের পুরনো বিল্ডিংটার প্রতিটা ইঁটে যেন সময়ের ছাপ। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতেই সে খুঁজে পেল অধ্যাপিকা শমিতা সেনের ঘর।
দরজায় নক করতেই ভেতর থেকে একটা শান্ত, পরিণত কণ্ঠস্বর ভেসে এল, “ভেতরে আসুন।”
ঘরটা ছিল যেন সময়ের বাইরে হিমায়িত একটা দ্বীপ। দেওয়াল জোড়া বইয়ের তাক ছাদ পর্যন্ত উঠে গেছে, মেঝেতেও বইয়ের স্তূপ এমনভাবে রাখা যে হাঁটার জন্য সরু একটা পথ তৈরি হয়েছে। টেবিলের ওপর পুরনো পুঁথি, বিবর্ণ মানচিত্র, আতস কাঁচ আর কয়েকটা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। বাতাসে ছিল পুরনো কাগজের গন্ধ, এলাচ দেওয়া চায়ের সুবাস আর জ্ঞানের এক অপার্থিব শান্তি। এই বইয়ের দুর্গের মাঝখানে বসে ছিলেন এক সৌম্যকান্তি ভদ্রমহিলা। তার সাদা চুলে জানালার আলো পড়ে একটা রুপোলি আভা তৈরি হয়েছিল।
“আমি অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার অনির্বাণ বক্সী,” অনির্বাণ নিজের পরিচয় দিল।
“আমি আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম, মিস্টার বক্সী,” শমিতা সেন মৃদু হেসে চশমার ফাঁক দিয়ে তাকে দেখলেন। “কাল রাতে টিভিতে বিমল মিত্রের খবরটা দেখার পর এবং তার আগে অভিনব চ্যাটার্জীর মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকেই আমার মন বলছিল, কলকাতা পুলিশ ইতিহাসের দরজায় কড়া নাড়তে বাধ্য হবে।”
অনির্বাণ তার বিস্ময় গোপন করার চেষ্টা করল না। সে তার ব্যাগ থেকে ট্যাবলেটটা বের করে একে একে দুটি ক্রাইম সিনের ছবি, মুদ্রার ছবি এবং ফরেনসিক রিপোর্টের সারাংশ দেখাল। সে শুধু তথ্যগুলো দিল না, সে তার নিজের প্রাথমিক তত্ত্বটাও ব্যাখ্যা করল।
শমিতা সেন একজন মনোযোগী ছাত্রীর মতো সবটা দেখলেন এবং শুনলেন। তার মুখে ছিল গভীর চিন্তার ছাপ। সবটা দেখা শেষ হলে তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং একটা তাক থেকে একটা মোটা, চামড়ায় বাঁধানো বই বের করে আনলেন। বইটার নাম ‘Land and Revenue Records of Bengal Presidency, 1750-1850’।
“আপনার তত্ত্ব সঠিক পথেই এগোচ্ছে, মিস্টার বক্সী,” তিনি বইয়ের একটা পাতা খুলে বললেন। “অভিনব চ্যাটার্জীর প্রপিতামহ, রামরতন চ্যাটার্জী, কোম্পানির আমলে একজন কুখ্যাত লবণ ব্যবসায়ী এবং নীলকর ছিলেন। তিনি কৃত্রিম অভাব তৈরি করে সাধারণ মানুষের সর্বনাশ করে নিজের ভাগ্য গড়েছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মুদ্রাটা হলো সেই শোষণের স্বাক্ষর। আর কালকূট বিষ… সেটা ছিল সেই সময়ের নীরব ঘাতক। খুনি অভিনব চ্যাটার্জীকে তার পূর্বপুরুষের পাপের শাস্তি দিয়েছে, সেই সময়ের অস্ত্র দিয়েই।”
এরপর তিনি দাবার বোর্ডের ছবির দিকে তাকালেন। “আর এটা… এটা হলো বিশ্বাসঘাতকতার শিল্পরূপ। পলাশীর যুদ্ধ। বিমল মিত্রের পূর্বপুরুষ ছিলেন জগৎ শেঠের পরিবারের কোষাধ্যক্ষ, আনন্দরাম দাস, যিনি ষড়যন্ত্রের সমস্ত আর্থিক লেনদেনের হিসাব রাখতেন। খুনি ছোরা দিয়ে তাকে খুন করে বুঝিয়ে দিয়েছে যে সে একজন বিশ্বাসঘাতকের বংশধর।”
“আর ভাঙা গজটা?” অনির্বাণ প্রশ্ন করল, যার উত্তর সে কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিল না।
“গজ বা বিশপ ধর্ম বা পরামর্শদাতার প্রতীক। পলাশীর ষড়যন্ত্রে উমিচাঁদ নামে একজন ব্যবসায়ী ছিলেন, যিনি দ্বিমুখী খেলা খেলতে গিয়ে দুদিক থেকেই প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। হয়তো এই ভাঙা গজ সেই উমিচাঁদের প্রতীক, অথবা এমন কোনো অজানা ষড়যন্ত্রকারীর দিকে ইঙ্গিত করছে, যার কথা ইতিহাসেও লেখা নেই। খুনি শুধু প্রতিশোধ নিচ্ছে না, সে আমাদের এক একটা ঐতিহাসিক ধাঁধা দিচ্ছে, যা আমাদের সমাধান করতে হবে।”
অনির্বাণ finalmente বুঝতে পারল সে কত বড় এবং গভীর এক ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হয়েছে। তার প্রতিপক্ষ শুধু একজন বা দুজন নয়, হয়তো একটা সম্পূর্ণ দর্শন।
“আপনার সাহায্য আমার দরকার, ম্যাডাম। অফিশিয়ালি, কলকাতা পুলিশের কনসালট্যান্ট হিসেবে,” অনির্বাণ বিনীতভাবে অনুরোধ করল।
শমিতা সেন তার দিকে কিছুক্ষণ স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন। তার চোখে ছিল একাধারে জ্ঞান এবং বিষণ্ণতার ছায়া। “আমি সাহায্য করব। কারণ যে ব্যক্তি ইতিহাসকে এভাবে অস্ত্রের মতো ব্যবহার করে, সে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শত্রু। কিন্তু একটা কথা মনে রাখবেন, মিস্টার বক্সী,” তিনি যোগ করলেন, “যে মানুষ ইতিহাসকে এত গভীরভাবে জানে, সে এটাও জানে যে ইতিহাস বিজয়ীদের হাতেই লেখা হয়। সে হয়তো নিজেকে বিজয়ী হিসেবেই দেখছে। আর বিজয়ীরা শেষ পর্যন্ত যেতে পারে।”
এই সতর্কবার্তাটা অনির্বাণের শিরদাঁড়ায় একটা ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দিল। সে ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় তার কাঁধে ছিল এক বিশাল দায়িত্বের ভার, কিন্তু মনে ছিল এক নতুন দিশার আলো। সে এখন জানে তাকে কোথায় আঘাত করতে হবে।
সে সাথে সাথে রানাকে ফোন করল। তার গলা ছিল ইস্পাতের মতো কঠিন। “রানা, দুটো নাম নোট করো। রামরতন চ্যাটার্জী এবং আনন্দরাম দাস। এদের বর্তমান বংশধরদের একটা সম্পূর্ণ তালিকা আমার চাই। এবং শমিতা ম্যাডামের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী, ঔপনিবেশিক আমলে ফুলেফেঁপে ওঠা প্রত্যেকটা পরিবারের কুণ্ডলী বের করো। আমাদের শিকার এখন আর অন্ধকারে নেই। আমরা এখন ইতিহাসের ছায়াদের পেছনে দৌড়াব।”
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion