অধ্যাপিকা শমিতা সেনের সাথে বৈঠকের পর কয়েকটা দিন ছিল তীব্র মানসিক চাপের। অনির্বাণের টিম লালবাজারের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে যেন ইতিহাসের এক অন্ধকার সুড়ঙ্গে প্রবেশ করেছিল। চারদিকে ছড়িয়ে ছিল পুরনো দলিলের ফটোকপি, বংশলতিকার জটিল নকশা আর ব্রিটিশ আমলের গেজেটিয়ারের পাতা। অনির্বাণের ঝকঝকে ডিজিটাল বোর্ডের ওপর মার্কারের কালিতে লেখা হচ্ছিল পলাশীর যুদ্ধ, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত—এসব শব্দ, যা এতদিন তার কাছে শুধু স্কুলজীবনের পরীক্ষার বিষয় ছিল, এখন সেগুলোই হয়ে উঠেছিল এক ভয়ঙ্কর সিরিয়াল কিলারের অস্ত্র।
তদন্তের সূত্র ধরে একটা নাম বারবার কাঁটার মতো উঠে আসছিল—ডঃ অর্কপ্রভ সেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের এই অধ্যাপক ছিলেন শহরের বুদ্ধিজীবী মহলের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, কিন্তু তার ঔজ্জ্বল্য ছিল আগুনের মতো—যা আলো দেওয়ার পাশাপাশি পুড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতাও রাখত। অনির্বাণ ইউটিউবে তার একটা সাম্প্রতিক পাবলিক লেকচারের ভিডিও দেখছিল। দর্শকাসনে তিল ধারণের জায়গা নেই। মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে অর্কপ্রভ সেন তার জোরালো, সম্মোহনী কণ্ঠে বলছিলেন, “আমরা এমন এক শহরে বাস করি, যার প্রতিটা ইঁটের নিচে লুকিয়ে আছে শোষণ আর বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস। আমাদের বড়লোকদের ক্লাব, তাদের স্কুল, তাদের হাসপাতাল—সবকিছু তৈরি হয়েছে সাধারণ মানুষের রক্ত আর ঘামের ওপর। ইতিহাস এদের ক্ষমা করেনি, কিন্তু আমরা এদের মাথায় তুলে নাচি। সময় এসেছে এই ঐতিহাসিক পাপের হিসেব নেওয়ার।”
তার কথাগুলো ছিল বিদ্যুতের মতো। অনির্বাণের মনে হলো, এই মানুষটা শুধু কথা বলছে না, সে যেন একটা আদর্শের বীজ বপন করছে। খুনি বা ‘ঐতিহাসিক’ কি সেই উর্বর জমিতেই জন্মানো ফসল?
ইন্সপেক্টর বিক্রম রাঠোর প্রায় নিশ্চিত ছিলেন। “আমি বলেছিলাম না, বক্সী! এই লোকটাই সবকিছুর পেছনে। নিজে হয়তো আঙুল নোংরা করছে না, কিন্তু তার চেলারা কাজটা করে দিচ্ছে। ওকে তুলে আনো। আমার পদ্ধতিতে জেরা করলেই দেখবে, গড়গড় করে সব বলে দেবে।”
অর্কপ্রভ সেনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য লালবাজারে ডেকে পাঠানো হলো। লালবাজারের দশ নম্বর ইন্টেরোগেশন রুম -টা ছিল কুখ্যাত। দেওয়ালের বিবর্ণ রঙ, মাথার ওপর একটা মাত্র বাল্বের হলদে আলো আর ভারী লোহার দরজা—সব মিলিয়ে পরিবেশটাই এমন যে শক্ত মনের মানুষও ভেঙে পড়ে। কিন্তু ডঃ অর্কপ্রভ সেন যখন ঘরে ঢুকলেন, তখন তার মুখে বা শরীরে ভয়ের লেশমাত্র ছিল না। বরং তার চোখে ছিল এক ধরনের কৌতুক মেশানো তাচ্ছিল্য।
“তাহলে কলকাতা পুলিশ ফিনালমেন্টে ইতিহাস বইয়ের পাতা ওল্টানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে,” অর্কপ্রভ সেন অনির্বাণের দিকে তাকিয়ে তার প্রথম কথাটা বললেন। তার পরনে ছিল সাধারণ খদ্দরের পাঞ্জাবি আর কাঁধে ঝোলানো একটা শান্তিনিকেতনি ঝোলা।
“আপনার লেখা এবং বক্তৃতার সাথে শহরে ঘটে চলা খুনগুলোর পদ্ধতির অদ্ভুত মিল পাওয়া যাচ্ছে, ডক্টর সেন,” অনির্বাণ শান্তভাবে শুরু করল।
অর্কপ্রভ সেন একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন। “মিল তো থাকবেই, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার। সত্য একটাই। আমি সেটা কলম দিয়ে লিখি, আর আপনাদের ‘ঐতিহাসিক’ সেটা রক্ত দিয়ে লিখছে। মাধ্যমটা ভিন্ন, কিন্তু বার্তাটা একই।”
“আপনি কি এই বার্তাকে সমর্থন করেন?”
“আমি সত্যকে সমর্থন করি,” অর্কপ্রভ সেনের গলায় ধার বেড়ে গেল। “আমি সমর্থন করি সেই ইডিয়াকে, যেখানে ইতিহাস তার নিজের বিচার নিজে করে। অভিনব চ্যাটার্জীর পূর্বপুরুষ হাজার হাজার গরিব চাষিকে শোষণ করে ধনী হয়েছিল। বিমল মিত্রের পরিবার দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। এদের উত্তরসূরীরা সেই পাপের টাকায় বিলাসবহুল জীবন কাটাচ্ছে। আইন এদের কিছু করতে পেরেছে? পারেনি। তাই বলে আমি খুনকে সমর্থন করছি না, কিন্তু আমি এর পেছনের কারণটাকে বুঝতে পারছি। আপনারা কারণটা না খুঁজে শুধু কার্যের পেছনে ছুটছেন।”
রাঠোর আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। “নাটক বন্ধ করুন, প্রফেসর! সোজা কথায় বলুন, আপনি বা আপনার কোনো ছাত্র এই খুনের সাথে জড়িত কিনা?”
অর্কপ্রভ সেন রাঠোরের দিকে এমনভাবে তাকালেন, যেন তিনি কোনো অবুঝ শিশুকে দেখছেন। “ইন্সপেক্টর, আপনার সমস্যা হলো, আপনারা বিশ্বটাকে সাদা আর কালোয় দেখেন। কিন্তু ইতিহাস ধূসর। আমি ধারণার জন্ম দিই, ঘাতকের নয়। আমার ছাত্ররা বই পড়ে, ছোরা চালায় না।”
জিজ্ঞাসাবাদ চলছিল। অর্কপ্রভ সেনের প্রতিটি উত্তর ছিল দুর্ভেদ্য। তিনি আইনিভাবে নিজেকে বাঁচানোর সমস্ত পথ খোলা রাখছিলেন। অনির্বাণ বুঝতে পারছিল, এই মানুষটাকে ভাঙা যাবে না। সে একটা ভিন্ন পথ নিল।
“ডক্টর সেন, আপনি কি একবারও ভেবে দেখেছেন, আপনার এই incendiary কথাগুলোর ফল কী হতে পারে? কোনো বিভ্রান্ত, আবেগপ্রবণ মানুষ যদি আপনার কথাকে অনুপ্রেরণা হিসেবে নিয়ে এই জঘন্য কাজগুলো করে থাকে, তাহলে তার দায় কি আপনার ওপরও বর্তায় না?”
এই প্রথমবার অর্কপ্রভ সেনের শান্ত মুখে একটা চিন্তার রেখা ফুটে উঠল। তিনি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, “শব্দের নিজস্ব কোনো উদ্দেশ্য থাকে না, মিস্টার বক্সী। মানুষ তার নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী শব্দের অর্থ খুঁজে নেয়।”
প্রমাণের অভাবে তাকে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। কিন্তু রাঠোর তার বাড়ির সামনে এবং ফোনের ওপর কড়া নজরদারির ব্যবস্থা করলেন।
পুলিশ যখন ডঃ অর্কপ্রভ সেনের ছায়ার পেছনে দৌড়াচ্ছে, ঠিক তখনই, সেই রাতেই, ‘ঐতিহাসিক’ তার তৃতীয় চালটা দিল। শহর থেকে কিছুটা দূরে, গঙ্গার ধারে বিশাল বাগানবাড়ি ‘ঘোষ লজ’-এ। শিকারের নাম শান্তনু ঘোষ, একজন রাশভারী পাট ব্যবসায়ী।
অনির্বাণ যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছাল, তখন ভোরের আলো সবে গঙ্গার জলে রুপোলি রঙ ধরিয়েছে। কিন্তু ‘ঘোষ লজ’-এর দৃশ্যটা ছিল নিকষ কালো অন্ধকারের চেয়েও ভয়ঙ্কর। শান্তনু ঘোষের বিশাল, অলিম্পিক সাইজের সুইমিং পুলের টলটলে নীল জল এখন পরিণত হয়েছে এক গাঢ়, প্রায় কালচে নীল রঙের তরলে। বাতাসে একটা তীব্র রাসায়নিক গন্ধ। সেই জমাট বাঁধা নীল জলের মধ্যে ভাসছিল শান্তনু ঘোষের ফুলে ওঠা, বিবর্ণ দেহ।
অনির্বাণ পুলের ধারে হাঁটু গেড়ে বসল। দৃশ্যটা ছিল পরাবাস্তব এবং বীভৎস। খুনি শুধু তাকে ডুবিয়ে মারেনি; সে অত্যন্ত পরিকল্পনা করে পুলের ফিল্টারেশন সিস্টেমে কয়েকশো লিটার ইন্ডাস্ট্রিয়াল নীল ডাই মিশিয়ে দিয়েছে। সে একটা সুইমিং পুলকে উনিশ শতকের নীলকুঠির চৌবাচ্চার রূপ দিয়েছে।
শান্তনু ঘোষের ফোলা দেহের ওপর, তার ভেজা টি-শার্টের সাথে লেপ্টে ছিল এক মুঠো ধবধবে সাদা, কাঁচা তুলো। যেন নীল জলের সমুদ্রে এক টুকরো সাদা মেঘ।
অনির্বাণ পকেট থেকে ফোন বের করে শমিতা সেনকে ফোন করল। তিনি ফোনটা ধরতেই অনির্বাণ শুধু বলল, “ম্যাডাম, তৃতীয় খুন। শান্তনু ঘোষ। নীল জলে ডোবানো, বুকের ওপর কাঁচা তুলো।”
ফোনের ওপার থেকে শমিতা সেনের দীর্ঘশ্বাসের শব্দ পাওয়া গেল। “নীল বিদ্রোহ, মিস্টার বক্সী… উনিশ শতকের মাঝামাঝি। বাংলার সবচেয়ে রক্তাক্ত কৃষক বিদ্রোহগুলোর মধ্যে একটি। শান্তনু ঘোষের পূর্বপুরুষ, দুর্যোধন ঘোষ, ছিলেন কুখ্যাত নীলকর সাহেব কেনেডি সাহেবের দেওয়ান। তার অত্যাচারের গল্প এখনও গ্রামের মানুষ লোকগাথার মতো করে বলে। আর তুলো… তুলো হলো প্রতিবাদের প্রতীক। চাষিরা সেদিন নীল চাষের বিরুদ্ধে ধান আর তুলোর মতো ফসল চাষের অধিকার চেয়েছিল।”
অনির্বাণ ফোনটা কেটে দিল। তার মাথা ভোঁ ভোঁ করছিল। ডঃ অর্কপ্রভ সেন তখন পুলিশের কড়া নজরদারিতে তার নিজের বাড়িতেই ছিলেন। তার পক্ষে এই খুন করা শারীরিকভাবে অসম্ভব। অনির্বাণ বুঝতে পারল, তারা একটা বিরাট ভুল করেছে। তারা যখন একটা সম্ভাব্য বুদ্ধিদাতাকে নিয়ে ব্যস্ত ছিল, আসল ঘাতক তখন নিঃশব্দে তার তৃতীয় শিকারকে ইতিহাসের পাতায় পরিণত করে দিয়েছে।
খবরটা শহরে ছড়িয়ে পড়তেই মিডিয়াতে যেন সুনামি এসে গেল। রিয়া চৌধুরী তার চ্যানেলে লাইভ টেলিকাস্ট করছিল, তার উত্তেজনাপূর্ণ কণ্ঠস্বর কাঁপছিল, “শহরে তৃতীয় খুন! খুনি এবার আরও ভয়ংকর, আরও প্রতীকী। কলকাতা পুলিশ যখন ভুল পথে চালিত, তখন শহরের বুকে অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক ‘ঐতিহাসিক’!”
"ঐতিহাসিক"। রিয়া চৌধুরীর দেওয়া নামটা মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে গেল। খুনি अब আর শুধু একজন অজানা আততায়ী রইল না; সে একটা পরিচয় পেল, একটা মিথ হয়ে উঠল। অনির্বাণ বুঝতে পারছিল, এই পরিচিতি খুনিকে আরও উৎসাহিত করবে, আরও বেপরোয়া করে তুলবে। খেলাটা अब আর শুধু পুলিশ আর খুনির মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল না; পুরো শহরটাই এখন এই খেলার দর্শক।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion