তৃতীয় খুনের পর কলকাতার অভিজাত সমাজে যে ভয়টা এতদিন চাপা ছিল, তা এবার প্রকাশ্য আতঙ্কে পরিণত হলো। শহরের বড়লোকদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষীর চাহিদা তুঙ্গে উঠল। জিমখানা বা ক্যালকাটা ক্লাবের সান্ধ্য আড্ডাগুলোয় এখন গল্ফ বা শেয়ার বাজারের বদলে একটাই আলোচনা—কে হবে ‘ঐতিহাসিক’-এর পরবর্তী শিকার? খবরের কাগজের প্রথম পাতা, টেলিভিশনের প্রাইম টাইম—সবকিছুই দখল করে নিয়েছিল এই সিরিয়াল কিলার।
ইন্সপেক্টর রাঠোর জনতা এবং ওপরমহলের চাপে প্রায় দিশেহারা। ডঃ অর্কপ্রভ সেনের তত্ত্বটা ভুল প্রমাণিত হওয়ায় তিনি অনির্বাণের ওপর তার সমস্ত রাগ উগরে দিচ্ছিলেন। অনির্বাণ চুপচাপ সবটা হজম করছিল। সে জানত, এখন কথা বলার সময় নয়, কাজ করার সময়।
সে আবার গেল শমিতা সেনের কাছে। অধ্যাপিকার মুখে ছিল গভীর উদ্বেগের ছাপ।
“খুনি তার কাজের গতি বাড়াচ্ছে, অনির্বাণ,” তিনি বললেন। “সে এখন আর শুধু প্রতীকী हत्या করছে না, সে একটা আতঙ্ক তৈরি করতে চাইছে। সে চাইছে, মানুষ ভয় পাক, ভয় পেয়ে নিজেদের অতীতকে দেখুক। নীল বিদ্রোহের ঘটনা পলাশীর যুদ্ধের চেয়েও অনেক বেশি ব্যক্তিগত, অনেক বেশি গ্রামীণ। খুনি ইতিহাসের গভীরে প্রবেশ করছে।”
“কিন্তু আমরা এখনও তার নাগাল পাচ্ছি না কেন?” অনির্বাণের গলায় ছিল স্পষ্ট হতাশা।
“কারণ আমরা বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোকে দেখছি। আমাদের এমন একটা সূত্র খুঁজে বের করতে হবে, যা এই সব পরিবারকে একসাথে বেঁধে রেখেছে,” শমিতা সেন বললেন।
ঠিক সেই সময়েই একটা অপ্রত্যাশিত ফোন এল অনির্বাণের ব্যক্তিগত নম্বরে। ফোনের ওপারে ছিল একটা অল্পবয়সী মেয়ের ভীত, প্রায় কান্নাজড়ানো গলা।
“আপনি কি অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার অনির্বাণ বক্সী?”
“বলছি।”
“আমার নাম অবন্তিকা সিংহ। বিমল মিত্র আমার দাদু ছিলেন।”
এই ফোন কলটা ছিল অন্ধকারের মধ্যে এক ঝলক আলো। অনির্বাণ অবন্তিকার সাথে দেখা করার জন্য লেকের ধারে একটা নিরিবিলি ক্যাফেতে সময় ঠিক করল।
অবন্তিকা ছিল একালের মেয়ে। তার আচরণে, পোশাকে আধুনিকতার ছাপ। কিন্তু তার সুন্দর চোখ দুটোতে ছিল গভীর আতঙ্ক এবং একরাশ বিভ্রান্তি, যা সে ঢাকার চেষ্টা করছিল না।
“আমি... আমি আমার পরিবারের অতীত নিয়ে কিছুই জানতাম না, মিস্টার বক্সী,” সে কফির কাপে আঙুল বোলাতে বোলাতে বলতে শুরু করল। “আমার কাছে দাদু ছিলেন একজন সফল রাজনীতিবিদ। কিন্তু তার মৃত্যুর পর আমি খবরের কাগজে, টিভিতে আমাদের পরিবার নিয়ে যা শুনছি... পলাশীর যুদ্ধ, বিশ্বাসঘাতকতা... আমি এসবের কিছুই মেলাতে পারছি না। আমার বন্ধুরা আমাকে অন্য চোখে দেখছে।”
তার গলা ধরে এল। “আমি এই পাপের বোঝা বইতে চাই না। আমি সত্যিটা জানতে চাই। আমি চাই না, আমার পরিবার এই খুনির গল্পের একটা অধ্যায় হয়ে থেকে যাক।”
অবন্তিকা তার ব্যাগ থেকে একটা পুরনো, মরচে ধরা, কারুকার্য করা চাবি বের করে অনির্বাণের দিকে এগিয়ে দিল।
“এটা দাদুর ব্যক্তিগত স্টাডি রুমের সিন্দুকের চাবি। দাদু কাউকে ওই ঘরে ঢুকতে দিতেন না, বলতেন ওখানে পুরনো কাগজপত্র আছে। তার মৃত্যুর পর থেকে ঘরটা সিল করা। আমি আপনাদের সাহায্য করতে চাই। দয়া করে সত্যিটা খুঁজে বের করুন। হয়তো ওখানে এমন কিছু আছে যা আপনাদের কাজে লাগতে পারে।”
এটা ছিল তদন্তের প্রথম সত্যিকারের সুযোগ, যা তাদের একেবারে শত্রুর দুর্গের ভেতরে নিয়ে যেতে পারত। আইনি অনুমতি নিয়ে অনির্বাণ আর তার বিশ্বস্ত সহকারী রানা পৌঁছাল বিমল মিত্রের সেই রহস্যময় স্টাডি রুমে। শমিতা সেনকেও অনুরোধ করে নিয়ে আসা হয়েছিল।
ঘরটা খুলতেই একটা স্যাঁতসেঁতে, ধুলোমাখা গন্ধ নাকে ধাক্কা দিল। ঘরটা ছিল যেন সময়ের অতলে ফ্রোজেন একটা ক্যাপসুল। পুরনো দিনের আসবাব, দেওয়ালে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া ছবি আর তাকে তাকে সাজানো আইনি বই। ঘরের এক কোণে ছিল একটা ভারী লোহার সিন্দুক, যার ওপর ধুলোর পুরু আস্তরণ।
অবন্তিকার দেওয়া চাবি দিয়ে সেটা খুলতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একরাশ পুরনো দলিল, মোম দিয়ে সিল করা চিঠি আর চামড়ায় বাঁধানো কয়েকটা ডায়েরি। অনির্বাণ আর শমিতা সেন সেই কাগজের সমুদ্রে ডুব দিলেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে তারা প্রতিটি অক্ষর, প্রতিটি শব্দ খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন।
অবশেষে, একটা পুরনো, খয়েরি হয়ে যাওয়া ডায়েরির পাতার ভাঁজ থেকে বেরিয়ে এল একটা বিবর্ণ কাগজ। সেটা ছিল একটা সভার কার্যবিবরণী। সভার তারিখ ছিল ১১ই আগস্ট, ১৯০৫ সাল, বঙ্গভঙ্গের ঠিক আগে। সেই বিবরণে একটা সংগঠনের নামের উল্লেখ ছিল—"নবজাগরণ সমিতি"। তার নিচে ছিল সমিতির সদস্যদের নামের তালিকা, যারা ব্রিটিশ সরকারের সাথে সহযোগিতার মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির শপথ নিচ্ছিল। আর সেই তালিকায় জ্বলজ্বল করছিল রামরতন চ্যাটার্জী, আনন্দরাম দাস এবং দুর্যোধন ঘোষের উত্তরসূরীদের নাম।
কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারটা ছিল বিবরণের শেষে। সেখানে সমিতির প্রতীকের একটা হাতে আঁকা ছবি ছিল—একটি উদীয়মান সূর্য, যার প্রতিটি রশ্মি ছিল তলোয়ারের মতো তীক্ষ্ণ।
অনির্বাণ আর শমিতা সেন একে অপরের দিকে তাকালেন। তাদের দুজনের চোখেই ছিল একইসাথে উত্তেজনা এবং ভয়। তারা দীর্ঘ সময় পর তাদের অদৃশ্য শত্রুর একটা নাম পেয়েছে, একটা পরিচয় পেয়েছে।
“নবজাগাগরণ সমিতি,” শমিতা সেন প্রায় ফিসফিস করে বললেন। “এদের কথা আমি বইয়ে পড়েছি। এরা ছিল বাংলার সবচেয়ে বিপজ্জনক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে একটা। বাইরে থেকে এরা সমাজ সংস্কারের কথা বলত, কিন্তু আড়ালে ক্ষমতার লোভে ব্রিটিশদের দালালি করত এবং নিজেদের পথের কাঁটাদের সরিয়ে দিত। এরা শুধু বিশ্বাসঘাতক ছিল না, এরা ছিল সংগঠিত অপরাধী।”
অনির্বাণ বোর্ডের দিকে তাকাল। সে এতদিন শুধু শিকারিদের বংশধরদের খুঁজছিল। এখন সে বুঝতে পারল, তাকে শিকারিদের সংগঠনটাকেই খুঁজে বের করতে হবে। খুনি বা ‘ঐতিহাসিক’ হয়তো সেই পুরনো সমিতিরই কোনো পুনর্জন্ম দেওয়া সংস্করণ চালাচ্ছে।
সে তার ফোনে উদীয়মান সূর্যের প্রতীকটার ছবি তুলে নিল। “আমাদের শত্রু এখন আর ছায়া নয়, ম্যাডাম। তার একটা নাম আছে, একটা প্রতীক আছে। এবার লড়াইটা সামনাসামনি হবে।”
অনির্বাণের মনে হলো, সে যেন একটা অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষে পর্যন্ত আলোর রেখা দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু সে জানত না, এই আলো হয়তো আরও গভীর, আরও ভয়ঙ্কর কোনো অন্ধকারের প্রবেশদ্বার।
(চলবে )
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion