Episode 7895 words0 views

সপ্তম অধ্যায়: সূর্যের সন্ধানে

"নবজাগরণ সমিতি"। একটা নাম, কিন্তু তার মধ্যে লুকিয়ে ছিল এক শতাব্দীর অন্ধকার। অনির্বাণের তদন্তের জগতে এটা ছিল একটা পারমাণবিক বিস্ফোরণের মতো। এতদিন সে এবং তার দল বিক্ষিপ্ত সূত্র, ছায়ার পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু এখন তাদের সামনে একটা স্পষ্ট লক্ষ্য ছিল—একটা নাম, একটা প্রতীক, একটা ইতিহাস। পরদিন সকালে লালবাজারের কনফারেন্স রুমটাকে একটা যুদ্ধক্ষেত্রের চেহারা দেওয়া হলো। ঘরের মাঝখানে রাখা বিশাল হোয়াইট বোর্ডের ওপর থেকে আগের সমস্ত লেখা মুছে, বড় বড় করে লেখা হলো "নবজাগরণ সমিতি"। তার ঠিক নিচেই অনির্বাণ নিজে হাতে আঁকল সেই তলোয়ার-রশ্মিওয়ালা উদীয়মান সূর্যের প্রতীক। সে তার সবচেয়ে দক্ষ অফিসারদের নিয়ে যে বিশেষ টাস্ক ফোর্স গঠন করেছিল, তাদের সবার মুখে ছিল একযোগে উত্তেজনা এবং গভীর উদ্বেগের ছাপ। "আমাদের শত্রু এখন আর একজন মানসিক বিকারগ্রস্ত সিরিয়াল কিলার নয়," অনির্বাণ ঘরের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে বলতে শুরু করল। তার কণ্ঠস্বর ছিল শান্ত কিন্তু ইস্পাতের মতো কঠিন। "আমরা একটা গুপ্ত সংগঠনের বিরুদ্ধে লড়ছি। একটা আদর্শের বিরুদ্ধে লড়ছি। এদের শিকড় ইতিহাসের অনেক গভীরে। তাই আমাদের লড়াইটাও দুটো ভিন্ন স্তরে লড়তে হবে: অতীতে এবং বর্তমানে।" সে কাজ ভাগ করে দিল। একটা দলকে দায়িত্ব দেওয়া হলো পুরনো আর্কাইভ, এশিয়াটিক সোসাইটির গ্রন্থাগার এবং রাইটার্স বিল্ডিংয়ের মহাফেজখানা ঘেঁটে ১৯০৫ সালের মূল "নবজাগরণ সমিতি"র প্রতিটি সদস্যের কুণ্ডলী খুঁজে বের করার। "আমি তাদের প্রত্যেকের নাম, ঠিকানা, ব্যবসার বিবরণ, এমনকি তাদের পারিবারিক শত্রুতার ইতিহাস পর্যন্ত জানতে চাই," অনির্বাণ নির্দেশ দিল। এই দলের পথপ্রদর্শক হিসেবে থাকলেন অধ্যাপিকা শমিতা সেন, যিনি নিজের ঘর থেকেই ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তাদের পরিচালনা করছিলেন। দ্বিতীয় দলটির নেতৃত্বে ছিল অনির্বাণ নিজে। তার কাজ ছিল এই সমিতির কোনো আধুনিক অস্তিত্ব আছে কিনা, তা খুঁজে বের করা। এই দলটা ছিল প্রযুক্তি এবং ফিল্ডওয়ার্কের মিশ্রণ। "আমি চাই, এই নামটা আর এই প্রতীকটা ইন্টারনেটের প্রতিটি অন্ধকার কোণায় সার্চ করা হোক," অনির্বাণ তার সাইবার সেলের প্রধানকে নির্দেশ দিল। "সোশ্যাল মিডিয়ার ক্লোজড গ্রুপ, অস্পষ্ট ব্লগ, ইতিহাস-বিষয়ক ফোরাম, এনক্রিপ্টেড মেসেজিং অ্যাপ, এমনকি ডার্ক ওয়েব পর্যন্ত। এরা যদি নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখে, তাহলে তার একটা ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট থাকবেই। Find it." তদন্ত এখন পুরোদমে শুরু হলো। একদিকে যেমন পুরনো, ধুলোমাখা ফাইল আর গেজেটিয়ারের পাতা ওল্টানো হচ্ছিল, তেমনই অন্যদিকে ডিজিটাল দুনিয়ার অদৃশ্য জালে হাজার হাজার ডেটা পয়েন্ট বিশ্লেষণ করা হচ্ছিল। এরই মধ্যে, শহরের অন্য প্রান্তে, রিয়া চৌধুরী তার নিজের যুদ্ধটা লড়ছিল। পুলিশের নীরবতা তাকে আরও মরিয়া এবং নির্ভীক করে তুলেছিল। অনির্বাণের সেই কথাটা—"এটা ইতিহাস বলছে"—তার মাথায় গেঁথে গিয়েছিল। সে তার চ্যানেলের রিসার্চ টিমকে কাজে লাগিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সে নিজে বসে থাকার পাত্রী নয়। সে তার এক পুরনো সোর্সের সাথে দেখা করল, যিনি কলকাতা পৌরসভার রেকর্ড ডিপার্টমেন্টের এক অবসরপ্রাপ্ত, বিস্মৃতপ্রায় কর্মচারী, রমেনবাবু। উত্তর কলকাতার এক পুরনো চায়ের দোকানে বসে রমেনবাবু তাকে একটা অদ্ভুত তথ্য দিলেন। "জানেন তো ম্যাডাম, এই চ্যাটার্জী, মিত্র আর ঘোষ পরিবার—এদের সবারই আদি বাড়ি ছিল শ্যামবাজার অঞ্চলের কাছাকাছি। আর শুধু তাই নয়, পুরনো দিনের রেকর্ড অনুযায়ী, এদের সবারই কিছু জমিজমা সংক্রান্ত পুরনো শত্রুতা ছিল মজুমদার পরিবারের সাথে।" "ইন্দ্রনীল মজুমদারের পরিবার?" রিয়া চমকে উঠল। "হ্যাঁ। সেই তেতাল্লিশের মন্বন্তরের সময় থেকেই এদের মধ্যে একটা রেষারেষি ছিল," রমেনবাবু বললেন। এই ছোট তথ্যটা রিয়ার মাথায় একটা নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিল। সে বুঝতে পারল, এই পরিবারগুলোর যোগসূত্রটা শুধু ঔপনিবেশিক আমলেই সীমাবদ্ধ নয়, তা আরও অনেক জটিল এবং ব্যক্তিগত শত্রুতার জালে জড়ানো। অন্যদিকে, অধ্যাপিকা শমিতা সেন জাতীয় গ্রন্থাগারের আর্কাইভের শীতল, নিস্তব্ধ ঘরে বসে একটা যুগান্তকারী আবিষ্কার করলেন। তিনি "নবজাগরণ সমিতি"র কিছু অভ্যন্তরীণ বৈঠকের কার্যবিবরণী খুঁজে পেয়েছিলেন, যা কোনোদিন প্রকাশ্যে আসেনি। সেই বিবর্ণ পাতাগুলো ওল্টাতে ওল্টাতে তার কপালে চিন্তার ভাঁজ গভীর হলো। "অনির্বাণ, একটা বিরাট সমস্যা আছে," তিনি ফোনে জানালেন, তার কণ্ঠস্বর ছিল উত্তেজিত। "সমিতিটা শুধু ব্রিটিশদের দালালি করত না, তাদের নিজেদের মধ্যেও প্রচণ্ড ক্ষমতার লড়াই এবং আদর্শগত বিরোধ ছিল। ১৯১১ সালে, বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পর, সমিতি থেকে কিছু সদস্যকে চরম বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে বের করে দেওয়া হয়। তাদের অপরাধ ছিল—তারা সমিতির আদর্শের চেয়েও নিজেদের ব্যক্তিগত লোভ এবং মুনাফাকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছিল, যা সমিতির মূল উদ্দেশ্যকে কলঙ্কিত করছিল।" "এই বহিষ্কৃত সদস্যদের মধ্যে কি..." অনির্বাণ কথা শেষ করার আগেই শমিতা সেন বললেন, "হ্যাঁ। চ্যাটার্জী, মিত্র এবং ঘোষ—তিনটি পরিবারই সেই বহিষ্কৃত এবং ‘কলঙ্কিত’ তালিকায় ছিল। তার মানে, ‘ঐতিহাসিক’ সমিতির পুরনো শত্রুদের বংশধরদের মারছে না, সে মারছে সমিতির নিজেরই ‘বিশ্বাসঘাতক’দের বংশধরদের। এটা বাইরের কোনো আক্রমণ নয়, এটা ভেতরের শুদ্ধি অভিযান। সে নিজেকে সমিতির রক্ষক এবং বিচারক বলে মনে করছে।" এই আবিষ্কারটা ছিল বিরাট। খুনি নিজেকে সমিতির পুরনো কলঙ্ক মোচন করার দায়িত্ব নিয়েছে। ঠিক সেই সময়েই অনির্বাণের সাইবার সেল থেকে খবর এল। "স্যার, একটা হিট পেয়েছি!" সাইবার সেলের প্রধানের ল্যাপটপের স্ক্রিনে ছিল একটা অখ্যাত, প্রায় অব্যবহৃত ইতিহাস-বিষয়ক ব্লগ। ব্লগের নাম ‘বাংলার বিস্মৃত অধ্যায়’। সেই ব্লগের একটি পোস্টে "নবজাগরণ সমিতি"র কার্যকলাপ নিয়ে এমন কিছু বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে, যা সাধারণ ইতিহাস বইয়ে পাওয়া যায় না। পোস্টের ভাষা ছিল তীব্র, আবেগপ্রবণ এবং কিছুটা হিংসাত্মক। পোস্টের শেষে লেখা ছিল—"ইতিহাসের পাপ কোনোদিন মুছে যায় না, তা শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষায় থাকে, যেদিন নবজাগরণের সূর্য আবার উঠবে।" পোস্টটা করা হয়েছিল মাত্র ছ'মাস আগে। "ব্লগটা টর ব্রাউজার ব্যবহার করে পোস্ট করা হয়েছে, তাই এর আইপি অ্যাড্রেস ট্রেস করা প্রায় অসম্ভব," টেক-টিমের প্রধান জানাল। "কিন্তু আমরা হাল ছাড়ছি না।" অনির্বাণের বুকের ভেতরটা উত্তেজনায় ধকধক করছিল। এই প্রথমবার তারা ডিজিটাল দুনিয়ায় তাদের শত্রুর একটা জীবন্ত পদচিহ্ন খুঁজে পেয়েছে। সে নির্দেশ দিল, "Trace it. I want to know who is behind this blog. Do whatever it takes!" টিম যখন আইপি ট্রেস করার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে, ঠিক তখনই অনির্বাণের অফিসের ল্যান্ডলাইনটা কর্কশ শব্দে বেজে উঠল। কন্ট্রোল রুম থেকে ফোন। ফোনের ওপারের কণ্ঠস্বর ছিল আতঙ্কিত এবং দ্বিধাগ্রস্ত। “স্যার, আর একটা মার্ডার! এবার কসবা ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেটের একটা পুরনো গুদামে। বডি আইডেন্টিফাই করা হয়েছে... শিকারের নাম ইন্দ্রনীল মজুমদার।” অনির্বাণের শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল। রিয়া চৌধুরীর সোর্স ঠিক ছিল। মজুমদার পরিবারই ছিল তালিকার পরবর্তী নাম। খুনি তার কাজ নিখুঁতভাবে করে গেছে। সে বুঝিয়ে দিল, তার নাগালের বাইরে কেউ নেই। (চলবে)

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion