Episode 8658 words0 views

অষ্টম অধ্যায়: তেতাল্লিশের আর্তনাদ

চতুর্থ খুনের ঘটনাটা ছিল আগেরগুলোর চেয়েও অনেক বেশি প্রতীকী, নির্মম এবং মনস্তাত্ত্বিকভাবে ভয়ঙ্কর। ইন্দ্রনীল মজুমদার, যার পরিচিতি ছিল ‘দ্য ফুড কিং’ হিসেবে, যিনি তার টেলিভিশন শো-তে খাবার নিয়ে কবিতা লিখতেন, তাকে হত্যা করা হয়েছিল চরম বঞ্চনা এবং উপহাসের মাধ্যমে। কসবা ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেটের ভেতরে তার পরিবারের পুরনো, পরিত্যক্ত চালের গুদামটার মরচে ধরা শাটার খুলতেই একটা তীব্র, পচা, ভ্যাপসা গন্ধ সবার নাকে ধাক্কা দিল। গুদামের ভেতরে হাজার হাজার চাল, ডাল আর গমের বস্তা প্রায় ছাদ পর্যন্ত থরে থরে সাজানো। যেন এক বিশাল পর্বতমালার মতো। আর এই বিপুল পরিমাণ খাবারের সমুদ্রের মাঝখানে একটা ছোট্ট খালি জায়গায় পড়েছিল ইন্দ্রনীল মজুমদারের কঙ্কালসার, প্রায় শুকিয়ে যাওয়া দেহ। তার দামি ব্র্যান্ডের পোশাকগুলো এখন একটা কংকালের ওপর আলগাভাবে ঝুলে আছে। ফরেনসিক রিপোর্ট ছিল শিউরে ওঠার মতো। তাকে প্রায় দশ-বারো দিন ধরে এখানে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। তার চারপাশে ছিল অফুরন্ত খাবার, কিন্তু তাকে এক ফোঁটা জল বা এক দানা খাবারও দেওয়া হয়নি। সে অনাহারে, তৃষ্ণায় এবং হতাশায় তিল তিল করে মারা গেছে। তার মৃত্যুর ঠিক আগের মুহূর্তে সে হয়তো বাঁচার জন্য বস্তা ছিঁড়ে কাঁচা চাল খাওয়ারও চেষ্টা করেছিল, তার আঙুলের ভাঙা নখ আর মুখের কাছে ছড়িয়ে থাকা চালের দানাগুলো তার শেষ মরিয়া চেষ্টার সাক্ষী। তার বুকের ওপর রাখা ছিল একটাই ক্লু—একটা পুরনো, ভাঙা লোহার নিক্তি, যার দুটো পাল্লাই একদিকে ঝুলে আছে। অনির্বাণ দৃশ্যটার দিকে তাকিয়ে পাথরের মতো দাঁড়িয়েছিল। একজন মানুষকে খাবারের সমুদ্রে না খাইয়ে মারার মতো মানসিক বিকৃতি যার মাথায় আসতে পারে, সে সাধারণ খুনি নয়। শমিতা সেনকে ফোন করতেই তিনি ভারাক্রান্ত গলায় বললেন, “তেতাল্লিশের মন্বন্তর, অনির্বাণ। বাংলার ইতিহাসের সবচেয়ে কালো অধ্যায়। পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ না খেতে পেয়ে রাস্তায় মরে পড়েছিল, আর কিছু অসাধু ব্যবসায়ী চাল মজুত করে রেখে কালোবাজারি করে নিজেদের ভাগ্য গড়েছিল। ইন্দ্রনীল মজুমদারের ঠাকুরদা, দীননাথ মজুমদার, ছিলেন সেই সময়ের এমনই একজন কুখ্যাত মজুতদার। ভাঙা নিক্তিটা হলো সেই ঐতিহাসিক বেইমানি এবং অন্যায়ের প্রতীক।” তিনি যোগ করলেন, “আর আমার গবেষণাও বলছে, মজুমদার পরিবারও ‘নবজাগরণ সমিতি’র সেই বহিষ্কৃত সদস্যদের তালিকায় ছিল। তাদের অপরাধ ছিল—‘অতিরিক্ত লোভ’। সমিতির আদর্শকে ছাপিয়ে তারা নিজেদের মুনাফাকেই বড় করে দেখেছিল।” তত্ত্বটা এখন জলের মতো পরিষ্কার। খুনি বা সমিতি, তাদের পুরনো বিশ্বাসঘাতকদের বংশধরদের তালিকা ধরে এক এক করে শেষ করছে, আর তাদের পূর্বপুরুষদের পাপের সাথে মিলিয়ে অবিকল সেই শাস্তিই দিচ্ছে। এই খুনের খবর ছড়িয়ে পড়তেই পুরো শহরে যেন হিস্টিরিয়া শুরু হয়ে গেল। আগের শিকারেরা ছিলেন ক্ষমতার জগতের মানুষ, কিন্তু ইন্দ্রনীল মজুমদার ছিলেন সাধারণ মানুষের ড্রইং রুমের এক হাসিখুশি, চেনা মুখ। তার এই ভয়ঙ্কর পরিণতি দেখে মানুষ বুঝতে পারল, এই ‘ঐতিহাসিক’ কতটা নির্মম এবং নাগালের বাইরে হতে পারে। এদিকে, রিয়া চৌধুরী তার নিজের তদন্তে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল। সে তার সোর্সের মাধ্যমে মজুমদার পরিবারের এই পুরনো গুদামটার কথা পুলিশের আগেই জানতে পারে। তার সাংবাদিক সুলভ দুঃসাহসিক কাজের প্রবণতা তাকে এক ভয়ঙ্কর বিপদের দিকে ঠেলে দিল। সে ঠিক করল, পুলিশ পৌঁছানোর আগেই সে নিজে একবার ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখবে, যদি কোনো এক্সক্লুসিভ ফুটেজ পাওয়া যায় যা তার চ্যানেলকে সবার আগে পৌঁছে দেবে। সে তার ক্যামেরাম্যানকে নিয়ে একটা ছোট গাড়ি করে সেই গুদামের কাছে পৌঁছাল। এলাকাটা ছিল দিনের বেলাতেও অস্বাভাবিক রকমের নির্জন। সে গুদামের ভাঙা গেট দিয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করতেই, ভেতর থেকে বেরিয়ে এল দুজন লম্বা, বলিষ্ঠ চেহারার মুখোশধারী লোক। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা রিয়ার ক্যামেরাম্যানকে মাথায় আঘাত করে অজ্ঞান করে দিল এবং রিয়ার মুখে ক্লোরোফর্ম ভেজানো কাপড় চেপে ধরে তাকে একটা অপেক্ষা করে থাকা ভ্যানের ভেতরে তুলে নিল। প্রায় এক ঘন্টা পর, যখন অনির্বাণ ক্রাইম সিনে দাঁড়িয়ে তদন্ত করছিল, তখন তার কাছে একটা ফোন এল। রিয়া চৌধুরীর চ্যানেলের হেড অফিস থেকে। “স্যার, রিয়া তার ক্যামেরাম্যানকে নিয়ে কসবা গিয়েছিল। ক্যামেরাম্যানকে কিছুক্ষণ আগে অজ্ঞান অবস্থায় রাস্তার ধার থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু রিয়া নিখোঁজ। তার ফোনও সুইচড অফ।” অনির্বাণের বুকের ভেতরটা ধমকে উঠল। সে বুঝতে পারল, রিয়া তার অনুসন্ধিৎসার কারণে বাঘের গুহায় ঢুকে পড়েছিল। ‘ঐতিহাসিক’ বা ‘নবজাগরণ সমিতি’ শুধু খুন করেই থামছে না, তারা তাদের পথের কাঁটাদেরও সরাতে শুরু করেছে। তদন্তটা আর শুধু কিছু পুরনো খুনের রহস্যভেদ রইল না। এটা अब একটা ব্যক্তিগত লড়াইয়ে পরিণত হলো। একদিকে যেমন তাকে একটা সংগঠিত, বুদ্ধিমান খুনিদের দলকে ধরতে হবে, তেমনই অন্যদিকে সময়ের বিরুদ্ধে দৌড়ে একজন নির্ভীক সাংবাদিকের জীবনও বাঁচাতে হবে। অনির্বাণের কাঁধে এখন পুরো শহরের নিরাপত্তার পাশাপাশি একজন নিরপরাধ মেয়ের জীবনের বোঝাও চেপে বসল। তার যুদ্ধটা এখন চতুর্মুখী। (চলবে)

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion