অয়নের সে রাতে আর ঘুম এলো না। সে বসার ঘরের সোফায় বসে রইল। এক হাতে কফির মগ, অন্য হাতে তার নিভে যাওয়া ল্যাপটপ। পিয়ার ঘরের দিক থেকে ভেসে আসা অদ্ভুত হাসির শব্দটা তার কানে বাজছিল। "মা যদি ভালো করে না লুকোয়, তাহলে মা হেরে যাবে।"
এই বাড়িটা একটা ফাঁদ। সে প্রথম দিন থেকেই এটা বুঝতে পারছিল, কিন্তু মানতে চায়নি। তার যুক্তিবাদী মন প্রতিটা অদ্ভুত ঘটনাকে কাকতালীয় বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আজ... নীলার পোড়া হাত আর পিয়ার ওই পৈশাচিক হাসি—আর কোনো সন্দেহ নেই।
ভোর হওয়ার সাথে সাথেই অয়ন সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলল। সে আর এক মুহূর্তও এখানে থাকবে না। নীলার হাতটা বেশ খারাপভাবে পুড়েছে, ইনফেকশন হওয়ার আগে তাকে শহরে নিয়ে যেতে হবে। আর পিয়া... পিয়াকে এই অভিশাপ থেকে যত দূরে সম্ভব নিয়ে যেতে হবে।
সে ধীর পায়ে তাদের বেডরুমে ঢুকল। নীলা ব্যথার ওষুধের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। তার ব্যান্ডেজ করা হাতটা বুকের ওপর রাখা।
"নীলা... ওঠো," অয়ন আলতো করে তাকে ঝাঁকাল।
নীলা চোখ পিটপিট করে চাইল। ব্যথায় তার মুখটা বিকৃত হয়ে গেল। "অয়ন... ক'টা বাজে?"
"সকাল হয়ে গেছে। আমরা এই মুহূর্তে বাড়িটা ছাড়ছি। কিচ্ছু গোছাতে হবে না। শুধু দরকারি কাগজ আর টাকাটা নাও। আমি গাড়ি বের করছি। তুমি পিয়াকে তৈরি হতে বলো," অয়ন এক নিঃশ্বাসে বলল।
"পিয়া?" নীলার চোখ দুটো ভয়ে বড় হয়ে গেল। কাল রাতের ঘটনাটা তার মনে পড়ে গেছে।
"আমি দেখছি ওকে," অয়ন তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল। "তুমি শুধু কোনোক্রমে উঠে দাঁড়াও। আমি তোমাকে ধরে গাড়িতে নিয়ে যাব।"
নীলা কোনোমতে দেয়াল ধরে উঠে দাঁড়াল। অয়ন তার কাঁধের ওপর একটা শাল জড়িয়ে দিয়ে দ্রুত পিয়ার ঘরের দিকে গেল।
"পিয়া... মা... ওঠো। আমরা এখুনি বেরোব।"
সে দরজায় টোকা দিল। কোনো সাড়া নেই।
"পিয়া!" সে আবার ডাকল।
ভেতরটা অদ্ভুত রকম চুপ। সেই রাতের ফিসফিসানি বা খিলখিল হাসি—কিছুই নেই।
অয়নের বুকটা ধড়াস করে উঠল। সে আর অপেক্ষা না করে দরজায় ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকল।
ঘরটা ফাঁকা।
পিয়া বিছানায় নেই। আর তার সাথে... সেই পুতুলটাও নেই।
"পিয়া!" অয়ন পাগলের মতো চিৎকার করে উঠল। সে বাথরুম দেখল, খাটের তলা দেখল। কোথাও নেই।
"নীলা! পিয়া ঘরে নেই!"
নীলা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বসার ঘরে আসতেই শুনতে পেল সেই শব্দটা।
পিয়ার খিলখিল হাসির শব্দ। কিন্তু শব্দটা এক জায়গা থেকে আসছে না। কখনো মনে হচ্ছে রান্নাঘর, পরক্ষণেই মনে হচ্ছে সিঁড়ির কাছ থেকে ভেসে আসছে।
"বাবা!" পিয়ার গলা শোনা গেল। "খেলা শুরু হয়ে গেছে! তুমি মা'কে খুঁজে বের করো!"
অয়ন দৌড়ে বেডরুমে ফিরে গেল। নীলা সেখানে নেই। সে যেখানে নীলাকে দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছিল, সেই জায়গাটা ফাঁকা।
"নীলা!" অয়ন আবার চিৎকার করল।
"মা খুব ভালো জায়গায় লুকিয়েচে!" পিয়ার হাসির শব্দটা এবার যেন ছাদ থেকে আসছিল। "তুমি কক্ষনো খুঁজে পাবে না!"
অয়নের মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছিল। নীলার হাতটা পোড়া, সে ঠিক করে হাঁটতে পর্যন্ত পারছে না। পিয়া তাকে একা টেনে নিয়ে গেল কী করে?
"পিয়া! মজা করিস না! মা'র খুব কষ্ট হচ্ছে! বেরিয়ে আয়!" অয়ন মরিয়া হয়ে বলল।
"মণিও তো কষ্ট পেয়েছিল," পিয়ার গলাটা হঠাৎ করেই বদলে গেল। সেই ফ্যাসফ্যাসে, বয়স্ক স্বর। "যখন মা মণি'কে কুয়োয় ফেলে দিয়েছিল... মণির খুব ঠান্ডা লেগেছিল। মা'রও একটু ঠান্ডা লাগা উচিত।"
'ঠান্ডা লাগা উচিত?' অয়নের হঠাৎ করেই চিলেকোঠার কথা মনে পড়ল। ওই ঘরটা সবসময় ঠান্ডা থাকে।
সে এক দৌড়ে চিলেকোঠার সিঁড়ির কাছে গেল। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে সে দুটো-তিনটে করে ধাপ টপকে ওপরে উঠতে লাগল।
চিলেকোঠার দরজাটা, যেটা পিয়া প্রথম দিন খুব সহজেই খুলে ফেলেছিল, সেটা এখন বাইরে থেকে শক্ত করে বন্ধ।
"পিয়া! দরজা খোল!" অয়ন দরজায় ধাক্কা মারল।
"তুমি ভুল জায়গায় খুঁজছ, বাবা," পিয়ার গলাটা এবার ভেসে এলো একদম নিচের তলা থেকে।
অয়ন বিভ্রান্ত হয়ে গেল। সে কি ভুল ভাবছে? সে আবার নিচে নামতে যাবে, এমন সময় দরজার তলার ফাঁক দিয়ে সে একটা জিনিস দেখতে পেল।
এক টুকরো নীলচে কাপড়। নীলার শালের একটা অংশ।
"নীলা!" অয়ন বুঝতে পারল সে ঠিক জায়গাতেই এসেছে। নীলা ভেতরেই আছে।
সে সর্বশক্তি দিয়ে দরজায় কাঁধ দিয়ে ধাক্কা মারল। পুরনো কাঠের দরজা, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন ইস্পাত দিয়ে তৈরি।
"দরজা খোল বলছি!" অয়ন পকেট থেকে তার গাড়ির চাবি বের করে লকের মধ্যে ঢোকানোর চেষ্টা করল। কিন্তু ওতে কোনো চাবির গর্তই নেই! ওটা একটা পুরনো ছিটকিনি, যা শুধু ভেতর থেকেই বন্ধ করা যায়।
'ভেতর থেকে?' তার মানে... পিয়াও ভেতরে আছে।
অয়ন এবার মরিয়া হয়ে দরজায় লাথি মারতে শুরু করল। এক... দুই... তিন...। চতুর্থ লাথিতে দরজার একটা পাল্লা মড়মড় করে ভেঙে গেল।
ভেতরে ভ্যাপসা অন্ধকার। সেই পুরনো গন্ধ। ভাঙা ভেন্টিলেটর দিয়ে আসা এক চিলতে আলোয় সে দেখল।
ঘরের এক কোণে, সেই পুরনো সিন্দুকটার পাশে নীলা পড়ে আছে। তার হাত-পা বাঁধা। সেই পুরনো সিল্কের শাড়িগুলো দিয়ে, যা সিন্দুকের ভেতরে ছিল। তার মুখেও কাপড়ের টুকরো গোঁজা। সে অয়নকে দেখে গোঙাতে চেষ্টা করল।
আর পিয়া বসে আছে সেই কাঠের সিন্দুকটার ওপর। ঠিক যেন একটা ছোট্ট রানি। তার কোলে মণি। সে পা দোলাতে দোলাতে একটা অদ্ভুত সুর ভাঁজছিল।
"বাবা, তুমি তো খুব তাড়াতাড়ি খুঁজে ফেললে! খেলাটা তো জমলই না।" পিয়ার গলায় অভিমান।
অয়ন পিয়ার দিকে না তাকিয়ে দৌড়ে নীলার কাছে গেল। সে নীলার বাঁধন খুলতে খুলতে বলল, "নীলা, তুমি ঠিক আছ? ও তোর কোনো ক্ষতি করেনি তো?"
নীলা এত ভয় পেয়েছিল যে সে কথাই বলতে পারছিল না।
"তুমি মা'কে নিয়ে যাবে?" পিয়া শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল।
"হ্যাঁ! আমরা সবাই এই জাহান্নাম থেকে চলে যাচ্ছি! তুইও চল!" অয়ন নীলাকে ধরে দাঁড় করানোর চেষ্টা করল।
"না," পিয়া মাথা নাড়ল। "মণি'র এই বাড়িটা খুব পছন্দ। মণি এখান থেকে কোথাও যাবে না। আর আমিও মণি'কে ছেড়ে কোথাও যাব না।"
"তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে, পিয়া! চল বলছি!" অয়ন এক হাতে নীলাকে ধরে অন্য হাতে পিয়াকে ধরতে গেল।
সে পিয়ার হাতটা ধরার আগেই একটা বিকট শব্দ হলো।
'দড়াম!'
চিলেকোঠার ভাঙা দরজাটা সজোরে বন্ধ হয়ে গেল। অয়ন চমকে সেদিকে তাকাল।
"কে? কে ওখানে?"
সে নীলাকে ছেড়ে দৌড়ে দরজার কাছে গেল। সে ধাক্কা মারল। কিন্তু দরজাটা একচুলও নড়ল না। মনে হলো, কেউ যেন ওপাশ থেকে একটা বিশাল পাথর চাপা দিয়ে দিয়েছে।
"পিয়া! এটা কী মজা হচ্ছে? দরজাটা কে বন্ধ করল?" অয়ন মেয়ের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করল।
পিয়া সিন্দুক থেকে লাফিয়ে নামল। সে পুতুলটাকে এমনভাবে ধরেছিল যেন ওটা একটা জ্যান্ত বাচ্চা।
সে অয়নের দিকে তাকাল না। সে ঘরের কোণে গিয়ে একটা পুরনো, ভাঙা আয়নার সামনে দাঁড়াল। আয়নায় ধুলোর আস্তরণ, কিচ্ছু দেখা যায় না।
পিয়া তার ছোট্ট আঙুল দিয়ে আয়নার ধুলো মুছল।
"তুমি জিজ্ঞেস করছ, দরজা কে বন্ধ করল?" পিয়া হাসল। "মণি'র বন্ধুরা বন্ধ করেছে। ওরা চায় না আমরা এখন যাই।"
অয়ন দেখল, আয়নার মধ্যে পিয়ার প্রতিবিম্ব। কিন্তু তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুতুলটার প্রতিবিম্বের জায়গায় একটা লম্বা, ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে।
পিয়া এবার ঘুরে দাঁড়াল। তার কোলে মণি। পুতুলটার সেই একটা মাত্র বোতামের চোখ আর খালি গহ্বরটা অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে।
পিয়া তার নিজের গলায় কথা বলল না। সে কথা বলল সেই শুকনো, খসখসে, ফ্যাসফ্যাসে গলায়—যেটা অয়ন কাল রাতে শুনেছিল।
"লুকোচুরি খেলা শেষ," পুতুলটা বলল পিয়ার মুখ দিয়ে। "এবার মণির গল্প বলার পালা।"
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion