Episode 41188 words1 views

চতুর্থ অধ্যায়: মণির গল্প

চিলেকোঠার ভ্যাপসা অন্ধকারটা যেন হঠাৎ করেই আরও জমাট বেঁধে গেল। ভাঙা ভেন্টিলেটর দিয়ে আসা দিনের আলোটুকুও যেন এই ঘরের অশুভ ছায়ায় ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছে। দরজাটা বাইরে থেকে নয়, ভেতর থেকেও নয়—এক অশুভ শক্তি দিয়ে সীল করে দেওয়া হয়েছে। অয়ন শেষ একবার মরিয়া হয়ে দরজায় কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিল। দরজাটা নড়ল না। যেন ওটা আর কাঠ নয়, একটা শক্ত পাথরের স্ল্যাব। নীলা তার পোড়া হাতটা চেপে ধরে কোনোক্রমে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। তার ফ্যাকাশে মুখটা আতঙ্কে আর যন্ত্রণায় বিকৃত। সে ফিসফিস করে ডাকল, "পিয়া... মা... দোহাই তোর... এসব বন্ধ কর...।" পিয়া, যে এতক্ষণ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, সে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল। তার মুখটা চাঁদের আলো-আঁধারিতে অদ্ভুত দেখাচ্ছিল। সে তার কোলের পুতুলটাকে আলতো করে দোলাতে লাগল। "পিয়া এখন ঘুমোচ্ছে," সেই খসখসে, ফ্যাসফ্যাসে স্বরটা পিয়ার গলা দিয়ে বেরিয়ে এল। "পিয়া খুব ক্লান্ত। কিন্তু মণি জেগে আছে। মণি অনেক... অনেক দিন পর কথা বলার সঙ্গী পেয়েছে।" স্বরটা প্রতিধ্বনিত হলো না, কিন্তু মনে হলো চিলেকোঠার প্রতিটি কোণ থেকে, ধুলোমাখা আসবাবপত্রের ভেতর থেকে স্বরটা আসছে। "কে... কে তুমি?" অয়ন নীলাকে আড়াল করে পিয়ার সামনে এসে দাঁড়াল। "কী চাও তুমি? আমার মেয়েটাকে ছেড়ে দাও!" পিয়ার ঠোঁটে একটা হাসি ফুটে উঠল, যে হাসি কোনো ছয় বছরের বাচ্চার নয়। "ছেড়ে দেব? ওকে তো আমি সবেমাত্র খুঁজে পেলাম। ও আমার নতুন খেলার সাথী।" পিয়া এক পা এক পা করে পুরনো সিন্দুকটার দিকে এগিয়ে গেল, যেটার ওপর সে আগে বসেছিল। সে আবার ওটার ওপর বসল। পুতুলটাকে কোলের ওপর রেখে তার ছেঁড়া জামাটা সে ঠিক করে দিল। "তুমি জানতে চাও আমি কে?" মণির স্বরটা বলল। "তোমার ওই ল্যাপটপে তো তুমি আমার গল্পই পড়ছিলে। কিন্তু গল্পটা শেষ করোনি।" অয়নের বুকের ভেতরটা হিম হয়ে গেল। ও জানল কী করে? "আমার নাম ছিল মণিকুন্তলা," পিয়ার ছোট্ট শরীরটা দুলে উঠল একটা অট্টহাসিতে। "এই বাড়িটা আমার ছিল। আমার বাবা জমিদার ছিলেন। আমার অনেক কিছু ছিল... শুধু কোনো বন্ধু ছিল না।" ঘরের তাপমাত্রা দ্রুত কমতে শুরু করল। অয়নের মনে হলো সে যেন একটা বরফ-ঘরে দাঁড়িয়ে আছে। "আমি খুব একা ছিলাম," মণির গল্প চলতে লাগল। "আমার শরীর ভালো থাকত না। তাই আমি বাইরে যেতে পারতাম না। আমার মা ছিল না। বাবা আমাকে ভালোবাসত, কিন্তু সময় দিতে পারত না। তাই সে আমার জন্য একটা উপহার আনল। এই পুতুলটা।" পিয়া তার কোলের পুতুলটাকে উঁচু করে ধরল। সেটার একটা মাত্র বোতামের চোখ অয়নের দিকে স্থির। "কিন্তু এটা শুধু একটা পুতুল ছিল না। বাবা এক তান্ত্রিকের কাছ থেকে এটা আনিয়েছিল। সে বলেছিল, এই পুতুল আমার একাকিত্ব দূর করবে। সে... সে আমার মধ্যে 'শক্তি' জাগিয়ে দেবে।" "তান্ত্রিকটা পুতুলটার মধ্যে একটা পুরনো আত্মাকে বন্দী করেছিল। একটা অতৃপ্ত আত্মাকে। সে বলেছিল, এই আত্মা আমার বন্ধু হবে, আমার রক্ষক হবে।" "প্রথম প্রথম খুব ভালো লাগত। মণি আমার সাথে কথা বলত। আমাকে গল্প শোনাত। বাড়ির সব গোপন কথা আমাকে বলে দিত। কে কার নামে কী বলছে, কে বাবার সিন্দুক থেকে টাকা সরাচ্ছে... সব।" পিয়া/মণি একটু থামল। তার চোখ দুটো নীলার দিকে ফিরল। "কিন্তু আত্মার খিদে খুব বেশি হয়। ওর শুধু বন্ধুত্বে মন ভরছিল না। ওর আরও চাই।" "আমি বড় হতে শুরু করলাম," মণির স্বরটা এবার যেন দুঃখে ভরা। "আমার শরীর সারতে শুরু করল। আমার একজন নতুন বন্ধু হলো। আমাদের গানের মাস্টারমশাই... অতীন্দ্র। আমরা একে অপরকে ভালোবাসতাম।" "মণি'র এটা পছন্দ হলো না। ও খুব জেলাস (jealous) হয়ে গেল।" "ও আমাকে আটকাতে চাইল। ও আমাকে ভয় দেখাল। আমি যখন শুনলাম না, তখন ও অতীন্দ্রকে ভয় দেখাল। কিন্তু আমরা থামিনি। আমরা ঠিক করেছিলাম, এই বাড়ি থেকে পালিয়ে যাব।" "আর তারপরই..." পিয়ার গলার স্বরটা বদলে গেল হিংস্রতায়। "মণি তার আসল খেলাটা খেলল। ও বাবাকে গিয়ে বলল, অতীন্দ্র আমার ক্ষতি করতে চায়। ও বলল, অতীন্দ্র আসলে একটা খুনি, সে আমার গয়না নিয়ে পালিয়ে যাবে।" "বাবা বিশ্বাস করল। বাবা...।" মণির স্বরটা কান্নায় ভেঙে পড়ল। "বাবা অতীন্দ্রকে... ওই কুয়োটায়...। জ্যান্ত। কুয়োর মধ্যে ফেলে দিল।" অয়ন আর নীলা শিউরে উঠল। সেই কুয়োটা! "আমি পাগল হয়ে গেলাম," মণি বলতে লাগল। "আমি বুঝতে পারলাম সব এই পুতুলটার কাজ। আমি এটাকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলাম। আমি এটাকে আগুনে ফেলে দিলাম। কিন্তু এটা পুড়ল না। আমি এটাকে ওই সিন্দুকে তালাবন্ধ করে রাখলাম। কিন্তু ও... ও আমার মাথার ভেতর থেকে কথা বলতে লাগল।" "ও আমাকে বলতে লাগল, অতীন্দ্র মরেনি। ও কুয়োর ভেতরে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। ও আমাকে ডাকছে। ও বলছিল, একমাত্র মুক্তি... মৃত্যু।" "একদিন দুপুরে... এই চিলেকোঠার ঘর থেকেই... আমি ঝাঁপ দিলাম। ওই ভেন্টিলেটরের পাশের বড় জানালাটা দিয়ে। আমি ভেবেছিলাম, আমি অতীন্দ্রর কাছে চলে যাব।" পিয়া/মণি উঠে দাঁড়াল। "কিন্তু আমি মরতে পারলাম না। আমার শরীরটা পড়ে গেল, কিন্তু আমার আত্মা...।" সে পুতুলটাকে তার মুখের সামনে তুলে ধরল। "ওই শয়তান আত্মাটা আমার আত্মাকে টেনে এই পুতুলটার ভেতর ঢুকিয়ে দিল! আর নিজে... নিজে আমার শরীরটা দখল করে নিল!" অয়নের সব জট খুলে গেল। সে এতক্ষণ ভুল ভাবছিল। পুতুলটার মধ্যে যে আছে, সে মণিকুন্তলা নয়। সে... "না!" পিয়া/মণি চিৎকার করে উঠল, যেন সে অয়নের মনের কথা পড়তে পেরেছে। "আমি মণিকুন্তলা নই! আমি সেই তান্ত্রিকের বন্দী করা অতৃপ্ত আত্মা! আর মণিকুন্তলার দুর্বল আত্মাটা... সে অনেক আগেই এই পুতুলের ভেতর গলে পচে শেষ হয়ে গেছে! আমি শুধু তার স্মৃতিটা ধরে রেখেছি।" অয়ন আর নীলা বুঝতে পারল, তারা এক আদিম, ভয়ঙ্কর কোনো কিছুর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। "আমি মণিকুন্তলার শরীরটা পেয়েছিলাম," সেই আত্মাটা বলতে লাগল। "কিন্তু শরীরটা বড্ড দুর্বল ছিল। বেশিদিন টিকল না। মণিকুন্তলার বাবা যখন দেখল তার মেয়ে একটা রাক্ষসী হয়ে গেছে, তখন সে ভয় পেয়ে গেল। সে ওই তান্ত্রিককে আবার ডেকে আনল। তান্ত্রিকটা আমাকে আবার এই পুতুলের মধ্যে বন্দী করে... এই সিন্দুকে তালা দিয়ে দিল। আর মণিকুন্তলার বাবা বাড়িটা অভিশপ্ত বলে ছেড়ে চলে গেল।" "আমি অপেক্ষা করছিলাম। বছরের পর বছর। যুগের পর যুগ। এই ধুলোর মধ্যে। অন্ধকারের মধ্যে। আমি শুধু অপেক্ষা করছিলাম। একটা নতুন শরীরের জন্য। একটা নতুন... বন্ধুর জন্য।" "তারপর তোমরা এলে। আর তোমাদের সাথে এল... ও।" পিয়ার আঙুলটা তার নিজের বুকের দিকে দেখাল। "একটা ছোট্ট, সরল মন। দরজাটা খোলার জন্য একদম ঠিকঠাক চাবি।" "কী চাও তুমি?" অয়ন শক্ত গলায় বলল। "পিয়াকে তুমি পেয়েছ। এবার আমাদের যেতে দাও!" "যেতে দেব?" সেই পৈশাচিক হাসিটা আবার ফিরে এল। "খেলা তো সবে শুরু। পিয়ার শরীরটা খুব ভালো। খুব নরম। কিন্তু... বড্ড ছোট। আমার আরও শক্তিশালী কিছু চাই। আমার এমন একটা শরীর চাই, যেটা অনেকদিন টিকবে।" পিয়া/মণি ধীরে ধীরে নীলার দিকে এক পা এগোল। "আমার এমন একটা শরীর চাই," সে ফিসফিস করল। "যে একটা নতুন জীবন ধারণ করতে পারবে। একটা... মায়ের শরীর।" নীলা আতঙ্কে গোঙিয়ে উঠল। "না!" অয়ন বুঝতে পারল শয়তানটার আসল উদ্দেশ্য কী। সে পিয়ার শরীরটা ব্যবহার করেছে শুধু ফাঁদটা পাতার জন্য। তার আসল লক্ষ্য নীলা! "পিয়া ছিল টোপ," আত্মাটা হাসল। "আর তুমি, নীলা... তুমি হলে আমার নতুন ঘর।" পিয়া/মণি তার ছোট্ট হাতটা বাড়াল নীলার দিকে। কিন্তু হাতটা তার নয়। অয়ন দেখল, পিয়ার হাত থেকে একটা কালো ধোঁয়ার মতো অবয়ব বেরিয়ে আসছে। অয়ন ঝাঁপিয়ে পড়ে পিয়া আর নীলার মাঝখানে দাঁড়াল। "তোর ছায়াও আমি আমার স্ত্রীর ওপর পড়তে দেব না!" "তুমি আমাকে আটকাতে পারবে না," আত্মাটা বলল। অয়ন হঠাৎ করেই অনুভব করল, সে নড়তে পারছে না। দুটো বরফ-শীতল হাত যেন তার কাঁধ দুটো চেপে ধরেছে। সে পেছনে তাকানোর চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। সে অনুভব করল, তার চারপাশে আরও অনেকে আছে। চিলেকোঠার পুরনো বাসিন্দারা... মণির 'বন্ধুরা'। সে দেখল, পিয়া তার হাত থেকে পুতুলটাকে নীলার কোলের ওপর ফেলে দিল। "না! মণি কে ছুঁস না!" নীলা তার পোড়া হাতটা দিয়ে পুতুলটাকে সরাতে চাইল। কিন্তু পুতুলটার সেই সেলাই করা হাসিটা যেন আরও চওড়া হয়ে গেল। তার ছেঁড়া কাপড়ের ভেতর থেকে, তার বোতামের চোখ আর খালি গহ্বরটা দিয়ে, একরাশ কালো ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে বেরিয়ে আসতে শুরু করল। সেই ধোঁয়াটা একটা সাপের মতো ফণা তুলে নীলার মুখের দিকে এগিয়ে গেল। নীলা চোখ বন্ধ করে তীব্র আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion