নীলার তীব্র, অমানুষিক চিৎকারটা চিলেকোঠার ভ্যাপসা বাতাসটাকে চিরে ফালাফালা করে দিল। সেই কালো, কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়াটা, যা পুতুলের শূন্য গহ্বর থেকে বেরিয়ে এসেছিল, তা এক মুহূর্তের জন্য নীলার মুখের সামনে একটা বীভৎস সাপের ফণার মতো স্থির রইল। নীলার চোখ দুটো আতঙ্কে বিস্ফারিত।
তারপর এক ঝটকায়, শ্বাস টানার মতো একটা 'শোঁ' শব্দ করে, ধোঁয়াটা তার খোলা মুখের ভেতর দিয়ে শরীরে প্রবেশ করল।
নীলার চিৎকারটা একটা ভয়ঙ্কর, চাপা গোঙানিতে পরিণত হয়ে মাঝপথেই থেমে গেল। তার মাথাটা সজোরে পেছনের দেয়ালে ঠুকে গেল, তারপর বুকের ওপর ঢলে পড়ল। তার পুরো শরীরটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য থরথর করে, খিঁচুনি দেওয়ার মতো কেঁপে উঠল... এবং তারপর স্থির হয়ে গেল।
"নীলা!" অয়ন পাগলের মতো চিৎকার করে উঠল। যে অদৃশ্য, বরফ-শীতল হাতগুলো তাকে এতক্ষণ চেপে ধরেছিল, তার বিরুদ্ধে সে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা (struggle) করতে লাগল। কিন্তু পারল না। ছায়াময় আঙুলগুলো যেন তার কাঁধের মাংসে গেঁথে গেছে। সে একচুলও নড়তে পারল না, কেবল অসহায়ভাবে দেখতে লাগল।
সে দেখল, পুতুলটা, 'মণি', যেটা এতক্ষণ নীলার কোলে পড়ে কাঁপছিল, সেটা যেন এক순간ে প্রাণহীন হয়ে গেল। ধোঁয়াটা বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে ওটা যেন ভেতর থেকে চুপসে গেল। তার ছেঁড়া কাপড়ের শরীরটা একটা ময়লা ন্যাকড়ার মতো নীলার কোল থেকে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল। তার সেই একটা মাত্র বোতামের চোখ আর শূন্য গহ্বরটা এখন নিষ্প্রভ, সাধারণ, মৃত।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে, চিলেকোঠার অন্য প্রান্তে, সিন্দুকের ওপর বসে থাকা পিয়ার ছোট্ট শরীরটা, যা এতক্ষণ একটা পুতুলের মতোই শক্ত হয়ে বসেছিল, সেটাও সিন্দুকের ওপর থেকে একটা পুতুলের মতোই পাশে ঢলে পড়ল।
"পিয়া!" অয়নের গলা দিয়ে এবার একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এল। তার স্ত্রী, তার মেয়ে... দুজনেই তার চোখের সামনে...।
পিয়া সিন্দুকের ওপর থেকে গড়িয়ে মেঝেতে পড়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত সেভাবেই পড়ে রইল। তারপর... ধীরে ধীরে তার আঙুলগুলো নড়ে উঠল। সে একটা গভীর, কাঁপা কাঁপা শ্বাস নিল, যেন সে অনেকক্ষণ জলের তলায় ডুবে থাকার পর ভেসে উঠেছে।
সে চোখ পিটপিট করে চাইল। তার দৃষ্টি ঘোলাটে, বিভ্রান্ত।
"বাবা...?" সে খুব দুর্বল, ক্ষীণ গলায় ডাকল। "কোথায় আমি? কী... কী হয়েছে? খুব... খুব ঠান্ডা লাগছে...।"
পিয়া তার নিজের গলায় কথা বলছে! সেই ভয়ঙ্কর স্বরটা আর নেই! আত্মাটা... আত্মাটা পিয়ার শরীর ছেড়ে দিয়েছে!
কিন্তু অয়নের আনন্দ এক সেকেন্ডও স্থায়ী হলো না। কারণ তার সামনে, দেয়ালে হেলান দিয়ে থাকা নীলার শরীরটা নড়ে উঠল।
নীলা, যে জ্ঞান হারাবার মতো পড়েছিল, সে খুব ধীরে... শান্ত ভাবে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তার নড়াচড়ায় কোনো স্বাভাবিক মানুষের ভঙ্গি নেই। মনে হচ্ছিল, অদৃশ্য সুতো দিয়ে কেউ যেন একটা ভারী পুতুলকে টেনে তুলছে।
তার ব্যান্ডেজ করা পোড়া হাতটা পাশ থেকে ঝুলছে, কিন্তু তার মুখে যন্ত্রণার কোনো চিহ্ন নেই। তার চোখ দুটো বন্ধ।
"নীলা...?" অয়ন কাঁপা গলায়, শেষ আশা নিয়ে ডাকল।
নীলা চোখ খুলল।
অয়নের বুকের ভেতরটা জমে বরফ হয়ে গেল। এ চোখ নীলার নয়। নীলার উষ্ণ, বাদামী চোখের জায়গায় এখন দুটো জ্বলন্ত কয়লার মতো চোখ। এই চোখে কোনো মমতা নেই, কোনো পরিচিতি নেই। এই চোখ দুটো প্রাচীন, শীতল, এবং এক পৈশাচিক, বিজয়ীর আনন্দে ভরা।
'নীলা' তার নতুন শরীরটার দিকে তাকাল। সে তার সুস্থ বাঁ হাতটা মুখের সামনে তুলে এনে আঙুলগুলো নাড়ল। যেন সে প্রথমবার নিজের হাত দেখছে। তারপর সে তার বীভৎসভাবে পুড়ে যাওয়া ডান হাতটার দিকে তাকাল। তার সুন্দর মুখটা এক মুহূর্তের জন্য বিতৃষ্ণায় কুঁচকে গেল। সে সুস্থ হাতটা দিয়ে পোড়া জায়গার চামড়াটা খুঁটে দেখল, কিন্তু যন্ত্রণায় নয়, নিছক কৌতূহলে। সে কোনো ব্যথা অনুভব করছে না।
পরক্ষণেই তার ঠোঁটে ফুটে উঠল সেই ভয়ঙ্কর, সেলাই করা হাসিটা—যেটা এতক্ষণ পুতুলটার মুখে ছিল।
"এই শরীরটা... অনেক ভালো," সেই খসখসে, ফ্যাসফ্যাসে স্বরটা এবার নীলার চেনা গলা দিয়ে বেরিয়ে এল। স্বরটা নীলার, কিন্তু কথা বলার ভঙ্গিটা সেই শয়তানের। "অনেক... শক্তিশালী।"
আত্মাটা তার লক্ষ্য পূরণ করেছে। পিয়া ছিল শুধু একটা দুর্বল চাবি, একটা সিঁড়ি। নীলাই ছিল আসল লক্ষ্য।
'নীলা' অয়নের দিকে তাকাল। "তুমি আটকাতে পারলে না, লেখক।"
কথাটা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই যে অদৃশ্য শক্তি অয়নকে ধরে রেখেছিল, তা এক ঝটকায় তাকে ছেড়ে দিল। অয়ন টাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে পড়ে গেল।
'নীলা' তার দিকে আর মনোযোগ দিল না। তার চোখ পড়ল সিন্দুকের পাশে, মেঝেতে ভয়ে কাঁপতে থাকা পিয়ার ওপর।
পিয়া কিছুই বুঝতে পারছিল না। সে তার 'মা'-এর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল। "মা? তোমার কী হয়েছে? তোমার চোখ... বাবা...?"
"এই ছোট্ট শরীরটা আর দরকার নেই," 'নীলা' পিয়ার দিকে এক পা এগোল। তার হাঁটার ভঙ্গিটা নীলার মতো নয়, কেমন যেন রাজকীয়, শিকারীর মতো। "মণি'র পুরনো খেলনা পছন্দ নয়। পুরনো বন্ধুদের শেষ করে দেওয়াই ভালো।"
'নীলা' তার সুস্থ বাঁ হাতটা তুলল। অয়ন বুঝতে পারল, সে পিয়াকে শেষ করে দিতে চাইছে।
"না!" অয়ন বাঘের মতো গর্জে উঠে মেঝে থেকে লাফিয়ে উঠল। সে তার শরীরের সমস্ত ওজন দিয়ে 'নীলা'কে সজোরে ধাক্কা মারল।
কিন্তু ধাক্কাটা গিয়ে লাগল যেন একটা গ্রানাইট পাথরের দেয়ালে। নীলার শরীরটা, যা অয়নের থেকে অনেক হালকা, তা একচুলও নড়ল না। 'নীলা' বিরক্ত হয়ে তার দিকে তাকাল।
"তোমার খুব শখ, না, héro সাজার?"
সে অবলীলায় তার পোড়া ডান হাতটা দিয়ে—যে হাতটা নীলা ব্যথায় নাড়াতেও পারছিল না—অয়নের বুকে একটা ধাক্কা দিল। অয়ন অনুভব করল, যেন একটা চলন্ত ট্রাক তাকে আঘাত করেছে। সে ছিটকে গিয়ে চিলেকোঠার অন্য প্রান্তের দেয়ালে সজোরে আছড়ে পড়ল। তার মাথাটা পুরনো কাঠের আলমারিতে ঠুকে গেল, চোখের সামনে সে সর্ষেফুল দেখল।
"বাবা!" পিয়ার আর্তচিৎকার শুনে সে কোনোমতে চোখ খোলা রাখল।
'নীলা' তখন পিয়ার সামনে গিয়ে ঝুঁকে পড়েছে। তার মুখে সেই বীভৎস হাসি। "বিদায়, ছোট্ট বন্ধু।"
"না..." অয়ন গোঙাতে গোঙাতে বলল। তার মাথা ঘুরছে। সে মরিয়া হয়ে একটা উপায় খুঁজছিল। এই শয়তানকে থামানোর উপায় কী?
সে পকেটে হাত দিল। তার লাইটারটা... সে যে সিগারেট খায়... লাইটারটা এখনো পকেটে আছে। আগুন!
মণিকুন্তলার গল্পটা তার মনে পড়ল। "আমি এটাকে আগুনে ফেলে দিলাম। কিন্তু এটা পুড়ল না।"
পুতুলটা পোড়েনি। পুতুলটা ছিল আত্মাটার 'ঘর', তার শিকড়। কিন্তু আত্মাটা এখন পুতুলের মধ্যে নেই। সে এখন নীলার জ্যান্ত শরীরে। পুতুলটা এখন কী? ওটা কি ওর 'প্রাণভোমরা'? ওটাকে ধ্বংস করলে কি আত্মাটাও ধ্বংস হবে?
অয়ন দেখল, ছেঁড়া, প্রাণহীন পুতুলটা পিয়ার পায়ের কাছেই পড়ে আছে।
"মণিকুন্তলা!" অয়ন তারস্বরে, শেষ চেষ্টা করে চিৎকার করে উঠল। "অতীন্দ্র তোমাকে ডাকছে! ওই কুয়োর মধ্যে! সে এখনো তোমার জন্য অপেক্ষা করছে!"
'নীলা'র উদ্যত হাতটা, যা পিয়ার গলা টিপে ধরার জন্য এগিয়ে যাচ্ছিল, তা এক মুহূর্তে থমকে গেল।
সে যন্ত্রণায় কপাল চেপে ধরল। তার মুখটা বিকৃত হয়ে গেল। "অতীন্দ্র... না... ও মরে গেছে... ও মিথ্যে..."
মণিকুন্তলার স্মৃতি, যা আত্মাটা নিজের আনন্দের জন্য ধরে রেখেছিল, সেটাই এখন তার দুর্বলতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে বিভ্রান্ত। সে নীলার শরীরে থেকেও মণিকুন্তলার তীব্র যন্ত্রণা আর প্রেম অনুভব করছে। নীলার মুখটা একবার হিংস্রতায়, পরক্ষণেই মণিকুন্তলার দুঃখে ভরে উঠছিল।
"পিয়া!" অয়ন এই সুযোগটা ছাড়ল না। সে কোনোমতে দেয়াল ধরে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। "পিয়া... ওই পুতুলটা! মণি'কে আমার দিকে ছুঁড়ে দে! এখুনি!"
পিয়া ভয়ে জমে গিয়েছিল। সে একবার তার 'মা'-এর ভয়ঙ্কর রূপটার দিকে, তারপর তার আহত বাবার দিকে তাকাল।
"মা...?" সে কাঁপা গলায় ডাকল।
"ওটা তোর মা নয়!" অয়ন চিৎকার করল। "জলদি কর, পিয়া! পুতুলটা ছুঁড়ে দে!"
"কী করছিস!" 'নীলা' সম্বিত ফিরে পেয়েছে। সে মণিকুন্তলার স্মৃতিকে জোর করে দাবিয়ে দিয়েছে। সে পিয়ার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইল।
"এই নে, বাবা!" পিয়া শেষ মুহূর্তে কাঁপা কাঁপা হাতে মেঝে থেকে সেই কাদা-মাখা, ছেঁড়া পুতুলটাকে তুলে নিল এবং তার সর্বশক্তি দিয়ে অয়নের দিকে ছুঁড়ে দিল।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion