"এই নে, বাবা!"
পিয়ার আর্তচিৎকারটা চিলেকোঠার ধুলোমাখা বাতাসে প্রতিধ্বনিত হলো। সেই কাদা-মাখা, ছেঁড়া পুতুলটা শূন্যে একটা ডিগবাজি খেয়ে অয়নের দিকে উড়ে আসতে লাগল।
"না!"
'নীলা'র গলা দিয়ে একটা অমানুষিক গর্জন বেরিয়ে এল, যা নীলার স্বরযন্ত্রের পক্ষে অসম্ভব। সে পিয়াকে ছেড়ে এক লাফে, বাঘের মতো হিংস্রতায়, পুতুলটাকে ধরার জন্য শূন্যে হাত বাড়াল। তার লক্ষ্য এখন শুধু ওই পুতুলটা।
অয়ন, তার মাথায় তীব্র যন্ত্রণা, বুকে অসহ্য ব্যথা নিয়েও, মেঝেতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এটা একটা মরিয়া দৌড়। সে মেঝেতে গড়িয়ে গেল। 'নীলা'র বরফ-শীতল আঙুলগুলো বাতাস আঁকড়ে ধরল, পুতুলটা প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছিল। কিন্তু তার আগেই অয়নের হাতটা পুতুলটার একটা ছেঁড়া পা চেপে ধরল।
সে পুতুলটা পেয়ে গেছে!
'নীলা'র হাতটা সজোরে অয়নের হাতের ওপর এসে পড়ল, কিন্তু এক সেকেন্ডের জন্য সে দেরি করে ফেলেছে। অয়ন পুতুলটাকে বুকের মধ্যে চেপে ধরল।
'নীলা' তার কয়েক হাত দূরে, চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে, একটা পশুর মতো থমকে রইল। তারপর খুব ধীরে..সোজা হয়ে দাঁড়াল। তার মুখটা... নীলার সুন্দর মুখটা... এখন যে পরিমাণ আদিম হিংস্রতা আর ঘৃণায় বিকৃত হয়ে আছে, তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব।
ঘরের তাপমাত্রা যেন হিমাঙ্কের নিচে নেমে গেল। চিলেকোঠার প্রতিটি অন্ধকার কোণ থেকে অয়নের সেই অদৃশ্য 'বন্ধু'দের—বন্দী আত্মাদের—ফিসফিসানি আর গোঙানির শব্দ তীব্র হয়ে উঠল। তারা তাদের 'রানি'র ক্রোধ অনুভব করতে পারছিল।
"ওটা আমাকে দে, লেখক," 'নীলা'র গলায় সেই দ্বৈত স্বর—নীলার স্বর আর সেই প্রাচীন আত্মার খসখসে স্বর—একসাথে বেজে উঠল।
"তোর প্রাণভোমরা, তাই না?" অয়ন কোনোমতে উঠে বসার চেষ্টা করতে করতে হাঁপাতে লাগল। সে এক হাতে পুতুলটাকে ধরে অন্য হাতে পকেট থেকে লাইটারটা বের করার চেষ্টা করছিল। "তোর সব শক্তি... সবকিছু এটার মধ্যেই বাঁধা!"
'নীলা' হাসল। সেই সেলাই-করা হাসি। "তুই ওটা পোড়াতে পারবি না! মণিকুন্তলা চেষ্টা করেছিল। বোকা মেয়েটা। আগুন এই পুতুলকে ছুঁতে পারে না! এটা আমার ঘর! এটা অমর!"
"সেটা তো তুই যখন ওর ভেতরে ছিলি!" অয়ন লাইটারটা বের করে ফেলল। "এখন তুই বাইরে! এখন এটা শুধু একটা ছেঁড়া ন্যাকড়া! এখন দেখা যাক!"
সে লাইটারটা জ্বালাল। ছোট্ট, সাহসী একটা শিখা জ্বলে উঠল।
"না!"
'নীলা' অট্টহাসি করে তার পোড়া ডান হাতটা অয়নের দিকে বাড়াল।
অয়ন কোনো আঘাত অনুভব করল না। কিন্তু তার চারপাশের বাতাস যেন জীবন্ত হয়ে উঠল। শুধু একটা চেয়ার নয়—সিন্দুকের ডালাটা সজোরে বন্ধ হয়ে গেল, পুরনো একটা ভাঙা আলমারি অয়নের দিকে হেলে পড়ল, ধুলোর কুণ্ডলী পাকিয়ে একটা ছোটখাটো ঘূর্ণিঝড়ের মতো তৈরি হলো। অয়নের পাশের একটা পুরনো, ভারী কাঠের চেয়ার যেন নিজের ইচ্ছেতেই সজোরে স্লাইড করে এসে অয়নের পাঁজরে ধাক্কা মারল।
"আক্!"
অয়ন ছিটকে গিয়ে আবার দেয়ালে ধাক্কা খেল। তার হাত থেকে লাইটারটা ছিটকে ঘরের এক অন্ধকার কোণে গড়িয়ে গেল। পুতুলটা সে কোনোমতে ধরে রেখেছে।
'নীলা'র হাসিটা এবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। "বোকা। বোকা মানুষ।" সে ধীরে ধীরে অয়নের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। অয়ন ভাঙা চেয়ারটার নিচে চাপা পড়ে আছে।
"আমার বন্ধুরা চায় না তুমি আগুন নিয়ে খেলো," 'নীলা' ফিসফিস করে বলল।
"পিয়া!" অয়ন চাপা গলায় চিৎকার করল। "লাইটারটা! ওই কোণে! ধুলোর মধ্যে! লাইটারটা নিয়ে আয়!"
পিয়া ভয়ে জমে গিয়েছিল। সে দেখছিল তার 'মা' তার বাবাকে খুন করতে যাচ্ছে।
"পিয়া! মা'র জন্য! মা'কে বাঁচানোর জন্য! জলদি কর!"
এই কথাটা পিয়ার ঘোর ভাঙাল। সে হামাগুড়ি দিয়ে সেই অন্ধকার কোণটার দিকে ছুটে গেল। 'নীলা' তাকে গ্রাহ্যই করল না। তার সমস্ত মনোযোগ অয়নের ওপর, আর অয়নের হাতে ধরা পুতুলটার ওপর।
"আমাকে... দে... ওটা...।" 'নীলা' অয়নের সামনে ঝুঁকে পড়ল। সে হাত বাড়াল না। সে শুধু অয়নের দিকে তাকিয়ে রইল।
অয়ন অনুভব করল, দুটো অদৃশ্য হাত তার গলা টিপে ধরছে। তার শ্বাস আটকে আসতে লাগল। সে খাবি খেতে লাগল।
"পেয়েছি!" পিয়া লাইটারটা হাতে নিয়ে চিৎকার করে উঠল।
"পিয়া... ওটা... ওটা আমার দিকে... না... দাঁড়া...!" অয়ন দেখল, তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। 'নীলা'র হাত তার গলা স্পর্শও করেনি, অথচ সে শ্বাস নিতে পারছে না। "তুই... তুই পুতুলটা জ্বালিয়ে দে! এখুনি!"
অয়ন তার শেষ শক্তি দিয়ে, যখন তার শরীরটা খিঁচুনি দিচ্ছে, পুতুলটাকে 'নীলা'র নাগালের বাইরে, পিয়ার দিকে বাড়িয়ে ধরল।
পিয়া কাঁপতে কাঁপতে দৌড়ে এল। সে লাইটারটা জ্বালাল। একবার... দু'বার...। জ্বলল না। তার আঙুল ভয়ে, ঠান্ডায় অসাড় হয়ে গেছে।
'নীলা' অয়নের গলা টিপে ধরল। অয়নের চোখের সামনে সব কালো হয়ে আসছিল।
ফ্লিক! ফিস্...।
ফ্লিক! ফিস্...।
"জ্বলছে না!" পিয়া কেঁদে ফেলল।
"আবার কর!" অয়ন গোঙাতে গোঙাতে বলল।
ফ্লিক!
একটা ছোট্ট শিখা জ্বলে উঠল। কিন্তু সাথে সাথেই চিলেকোঠার ভেতরে একটা দমকা বাতাস—যা আসার কোনো পথই নেই—শিখাটাকে নিভিয়ে দিল। 'নীলা' হাসছে।
পিয়া আবার চেষ্টা করল। ফ্লিক! ...নিভে গেল।
'নীলা' অয়নের দিকে তাকিয়ে বলল, "বিদায়।"
পিয়া এবার লাইটারটাকে তার ফ্রক দিয়ে আড়াল করল। সে চোখ বন্ধ করে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে বুড়ো আঙুলে চাপ দিল।
ফ্লিক! শিখা!
পিয়া এক মুহূর্তও দ্বিধা করল না। সে সেই জ্বলন্ত শিখাটা চেপে ধরল পুতুলটার শুকনো, কাদা-মাখা কাপড়ের ওপর।
এক সেকেন্ড... দুই সেকেন্ড...।
কিছুই হলো না। মণিকুন্তলার কথাই কি সত্যি? ওটা কি পুড়বে না?
'নীলা'র মুখে বিজয়ীর হাসি ফুটে উঠল।
কিন্তু ঠিক তখনই, পুতুলটার ছেঁড়া জামার একটা সুতো দপ করে জ্বলে উঠল। তারপর আর একটা। আগুনটা প্রথমে নীলচে, তারপর অস্বাভাবিকভাবে পৈশাচিক সবুজ রঙ ধারণ করে দাউদাউ করে জ্বলে উঠল।
আগুনটা পুতুলটাকে পোড়াচ্ছিল না; মনে হচ্ছিল, ওটা পুতুলটার ভেতর থেকে কিছু একটা শুষে নিচ্ছে।
"আআআআআআআ!"
'নীলা' অয়নের গলা ছেড়ে দিয়ে দুই হাত দিয়ে নিজের বুক চেপে ধরে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। তার গলা দিয়ে যে চিৎকারটা বেরিয়ে এল, সেটা কোনো মানুষের চিৎকার নয়। মনে হলো, হাজার হাজার আত্মা একসাথে যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠছে।
অগ্নিপরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে।
পুতুলটার সুতোর হাতটা যখন সবুজ আগুনে কুঁকড়ে গেল, 'নীলা'র পোড়া হাতটা সজোরে খিঁচিয়ে উঠল। তার ব্যান্ডেজের ভেতর থেকে পোড়া মাংসের গন্ধ বেরিয়ে এল।
যখন পুতুলটার সেই একটা মাত্র বোতামের চোখটা গলে গিয়ে একটা কালো গর্ত তৈরি করল, 'নীলা'র একটা চোখ দিয়ে কালো ধোঁয়া বেরিয়ে আসতে শুরু করল।
"ওটা... আমার... ঘর...!" সে গোঙাতে গোঙাতে বলল। "আমার... আশ্রয়... আমার শিকড়...!"
আগুনটা দ্রুত পুতুলটাকে গ্রাস করছিল। সবুজ শিখাগুলো লকলক করে উঠছিল। চিলেকোঠার সেই অদৃশ্য আত্মাদের কোলাহল—মণির 'বন্ধু'রা—ভয়ে আর যন্ত্রণায় তীব্র হয়ে উঠল। তারা যেন তাদের 'রানি'কে হারাতে বসেছে। তারা ছায়ার মতো দেয়ালে এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াতে লাগল, কিন্তু আগুনটাকে ছোঁয়ার সাহস তাদের হলো না।
শেষবারের মতো পুতুলটা দপ করে জ্বলে উঠে একমুঠো ধবধবে সাদা ছাইয়ে পরিণত হলো। কালো নয়, সাদা।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে, 'নীলা'র শরীরটা, যেন একটা অদৃশ্য বিস্ফোরণে, সজোরে পেছনে ছিটকে গেল। তার মুখটা অমানুষিকভাবে হাঁ হয়ে গেল। অয়ন দেখল, সেই কালো ধোঁয়াটা, যা নীলার শরীরে প্রবেশ করেছিল, তা একটা ছায়ামূর্তির মতো নীলার মুখ দিয়ে সজোরে বেরিয়ে এল। সেই ছায়ামূর্তিটা এক মুহূর্তের জন্য মণিকুন্তলার যন্ত্রণা-কাতর মুখের আকার নিল, তারপর এক তীক্ষ্ণ চিৎকার করে বাতাসে মিলিয়ে গেল।
নীলার শরীরটা একটা ভারী বস্তুর মতো মেঝেতে আছড়ে পড়ল। তার মাথাটা পেছনের দেয়ালে ঠুকে গেল, এবং সে ধীরে ধীরে এলিয়ে পড়ল।
তারপর... সব চুপ।
অভিশপ্ত চিলেকোঠায় নেমে এল শ্মশানের নীরবতা। সেই অসহ্য ঠান্ডা ভাবটা আর নেই। ফিসফিসানিগুলো থেমে গেছে। মনে হলো, কেউ যেন ঘরের সব জানালা খুলে দিয়েছে।
অয়ন পাগলের মতো কাশতে লাগল। তার গলা দিয়ে রক্ত উঠে এল। পিয়া লাইটারটা ফেলে দিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
"মা...?" পিয়া ভয়ে ভয়ে ডাকল।
অয়ন ভাঙা চেয়ারটা সরিয়ে কোনোমতে হামাগুড়ি দিয়ে নীলার নিথর দেহটার কাছে গেল।
"নীলা? নীলা!" সে নীলার মুখে হাত দিল। ঠান্ডা। কিন্তু...
সে নীলার ঘাড়ে হাত রাখল। হৃৎস্পন্দন আছে! খুব ক্ষীণ, কিন্তু আছে!
কয়েক মুহূর্ত পর নীলার চোখ দুটো কেঁপে উঠল। সে ধীরে ধীরে চোখ খুলল। সেই জ্বলন্ত কয়লার মতো চোখ আর নেই। তার জায়গায় ফিরে এসেছে তার নিজের... উষ্ণ, বাদামী, বিভ্রান্ত চোখ।
"অয়ন...?" নীলার গলাটা ভেঙে আসছিল। সে আতঙ্কে চারদিকে তাকাল। "কী... কী হয়েছিল? আমার কিচ্ছু মনে নেই... ওই ধোঁয়াটা... পিয়া... পিয়া কোথায়?"
"আমরা এখানে, মা। আমরা সবাই এখানে," অয়ন নীলাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল।
পিয়া দৌড়ে এসে তার বাবা-মা'কে একসাথে আঁকড়ে ধরল। তিনজনই সেই ঠান্ডা, ধুলোমাখা মেঝেতে বসে রইল।
পুতুলটা এখন একমুঠো সাদা ছাই। আত্মাটা চলে গেছে।
অয়ন উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। তার পাঁজরে অসম্ভব ব্যথা। "চলো," সে নীলাকে ধরে তুলতে তুলতে বলল। "এখুনি এই বাড়ি থেকে বেরোতে হবে।"
সে নীলাকে ধরে, পিয়ার হাত ধরে, টলতে টলতে দরজার কাছে গেল।
সে দরজার হাতলে চাপ দিল।
দরজাটা খুলল না।
সে সজোরে ধাক্কা মারল।
দরজাটা এখনো বাইরে থেকে বন্ধ।
শয়তানটা চলে গেছে, কিন্তু তারা এখনো এই অভিশপ্ত বাড়ির ভেতরে বন্দী।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion