আগুনটা তখন প্রায় নিভে এসেছে। তার শেষ অঙ্গারটুকুও যখন ছাইয়ের নিচে চাপা পড়ল, তখন নাটমন্দিরের চাতালটা এক অতলান্ত অন্ধকারে ডুবে গেল। সেই অন্ধকার শুধু আলোর অনুপস্থিতি ছিল না, ছিল এক ভারী, জীবন্ত অন্ধকার, যা বাতাসের প্রতিটি অণুতে ওজন যোগ করেছিল। এই অন্ধকারের নিজস্ব ওজন ছিল, নিজস্ব শীতলতা ছিল, নিজস্ব শব্দ ছিল—যা হলো এক চূড়ান্ত, কান-ফাটানো নিস্তব্ধতা। এতক্ষণ ধরে আগুনের শিখার দিকে তাকিয়ে থাকায় তাদের চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল। এখন সেই আগুনের শেষ আশ্রয়টুকুও চলে যাওয়ায়, তারা যেন এক অন্ধকারের সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত হলো।
শ্রেয়ার দেখানো পথটা ছিল তাদের একমাত্র ভরসা। নাটমন্দিরের ঠিক পেছনে, গ্রামের অন্য প্রান্তের দিকে এক ভাঙা দালান। এই কয়েকশ মিটারের পথটুকু এখন তাদের কাছে এক মহাদেশ পাড়ি দেওয়ার মতো দুর্গম বলে মনে হচ্ছিল।
আরিক তার টর্চটা জ্বালাল। শক্তিশালী LED-র ঠান্ডা, সাদা আলোটা অন্ধকারের বুকে একটা ছুরির ফলার মতো প্রবেশ করল, কিন্তু অন্ধকার এতটাই জমাট ছিল যে আলোটা বেশিদূর যেতে পারছিল না। তাদের সামনে তৈরি হলো এক চলমান, সীমাবদ্ধ জগৎ—এক আলোর বৃত্ত, যার বাইরে ওঁত পেতে আছে অসীম, অজানা আতঙ্ক।
"একসাথে থাকো," আরিকের গলাটা ভাঙা, ফ্যাসফেসে শোনাল। "কেউ পিছিয়ে পড়বে না।"
তারা প্রথম পদক্ষেপটা নিল। আর সাথে সাথেই সেই ভয়ঙ্কর প্রতিরোধটা ফিরে এল। তাদের ছায়ারা, যারা তাদের উঠে দাঁড়ানোর সময় বিদ্রোহ করেছিল, তারা এখন প্রতিটি পদক্ষেপে বাধা দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, তারা যেন শুকনো ডাঙায় নয়, হাঁটছে এক অদৃশ্য, ঘন, আঠালো কাদার সমুদ্রের মধ্যে দিয়ে। প্রতিটি পা তোলার জন্য তাদের এমনভাবে শক্তি প্রয়োগ করতে হচ্ছিল, যেন তারা মাধ্যাকর্ষণের বিরুদ্ধে লড়ছে। আর প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে সেই শুকনো পাতা ছেঁড়ার মতো ‘খসসস’ শব্দটা এখন আরও তীব্র, আরও ক্রোধান্বিত শোনাল। যেন তাদের শরীর আর ছায়ার মধ্যেকার প্রতিটি ছিঁড়তে থাকা সুতো যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠছে।
তারা নাটমন্দিরের চাতাল ছেড়ে গ্রামের মূল মাটির রাস্তায় নামল। আর সাথে সাথেই, যেন তাদের এই স্পর্ধা দেখে, গোটা গ্রামটা জেগে উঠল।
সেই ভয়ঙ্কর, করুন সুরটা আবার ফিরে এল। কিন্তু এবার আর সেটা শুধু বিষণ্ণ ছিল না। সুরটা ছিল বিকৃত, বেসুরো। যেন কেউ একটা পুরনো রেকর্ডকে ভুল স্পিডে বাজাচ্ছে। সুরের ভেতরের কান্নাটা এখন বিদ্রুপের হাসিতে পরিণত হয়েছিল।
আর তারা একা ছিল না।
আরিকের টর্চের আলো যখন কাঁপতে কাঁপতে এদিক-ওদিক ঘুরছিল, তখন তারা দেখছিল। ভাঙা বাড়ির দরজার চৌকাঠে, জানালার অন্ধকারে, গাছের আড়ালে—অসংখ্য ছায়ামূর্তি। তারা স্থির নয়, তারা নড়ছিল। বাতাসের সাথে ভেসে যাওয়া ধোঁয়ার মতো তাদের আকৃতি বদলাচ্ছিল। তারা এগিয়ে আসছিল না, কিন্তু তাদের উপস্থিতি ছিল স্পষ্ট। তারা ছিল দর্শক। শ্যামলগড়ের পুরনো বাসিন্দারা, তাদের নতুন অতিথিদের এই শেষ যাত্রা দেখার জন্য যেন জমায়েত হয়েছিল। তাদের কোনো চোখ ছিল না, কিন্তু চারজনই অনুভব করতে পারছিল সহস্র অদৃশ্য চোখের শীতল দৃষ্টি তাদের পিঠের ওপর ছুরির মতো বিঁধছে।
এই পথটা ছিল নরকের পথ। বাইরে ছিল গ্রামের অতৃপ্ত ছায়াদের নীরব পর্যবেক্ষণ, আর ভেতরে ছিল নিজেদেরই বিদ্রোহী ছায়ার সাথে এক নিরন্তর যুদ্ধ।
এই পথ ধরে হাঁটাটা ছিল এক দুঃস্বপ্নের মতো। তাদের চারপাশের বাতাস আরও ঠাণ্ডা, আরও ভারী হয়ে উঠেছিল। একটা পচা, স্যাঁতসেঁতে গন্ধ তাদের নাকে এসে লাগছিল—যেন বহুদিনের পুরনো, ভেজা মাটির গন্ধ, তার সাথে মিশে আছে শুকনো পাতার আর অজানা কোনো ফুলের মিষ্টি কিন্তু পচনশীল সুবাস। গ্রামের নিস্তব্ধতা আর ছিল না। তার জায়গায় এসেছিল এক চাপা গুঞ্জন, ফিসফিসানির শব্দ, যা বাতাসের সাথে ভেসে আসছিল। মনে হচ্ছিল, গ্রামের প্রতিটি কোণ থেকে, প্রতিটি ভাঙা দেওয়াল থেকে, অদৃশ্য বাসিন্দারা তাদের নিয়ে কথা বলছে।
আরিকের টর্চের আলোটা ছিল তাদের একমাত্র পথপ্রদর্শক। কিন্তু সেই আলোটাও যেন এই গ্রামের অদ্ভুত নিয়মের বাইরে ছিল না। আলোর বৃত্তটা যেখানে শেষ হচ্ছিল, সেই সীমানাটা ছিল অস্বাভাবিকরকম স্পষ্ট। তার বাইরে অন্ধকারটা ছিল জমাট, impenetrable। টর্চের আলোটা যেন সেই অন্ধকারকে ভেদ করতে পারছিল না, বরং অন্ধকারের গায়ে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছিল।
তারা যখন গ্রামের মাঝখান দিয়ে যাচ্ছিল, তখন দেখল, ছায়ামূর্তিগুলো আর শুধু দাঁড়িয়ে নেই। তারা তাদের ভাঙা বাড়িগুলো থেকে বেরিয়ে আসছে, রাস্তার ধারে সার দিয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাদের কোনো মুখ নেই, কিন্তু তাদের ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল, তারা যেন কোনো শোভাযাত্রা দেখছে। এক মৃতদের শোভাযাত্রা, যা জীবিতদের শেষ যাত্রাপথকে অনুসরণ করছে।
রিয়া ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে শ্রেয়ার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরেছিল। তার চোখ দুটো ছিল ভয়ে বিস্ফারিত। টর্চের আলোয় সে দেখছিল, একটা ছায়ামূর্তি, যা দেখতে অনেকটা অল্পবয়সী মেয়ের মতো, তার দিকে আঙুল তুলে দেখাচ্ছে। তার কোনো আঙুল ছিল না, ছিল শুধু একটা লম্বা, ছুঁচালো অগ্রভাগ। কিন্তু তার ভঙ্গিটা ছিল স্পষ্ট।
জয় তার ক্যামেরাটা দিয়ে ভিডিও করার চেষ্টা করছিল, কিন্তু স্ক্রিনে শুধু noise আর static ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। মাঝে মাঝে, static-এর মধ্যে দিয়ে আবছাভাবে ছায়ামূর্তিগুলোর contorted আকার ফুটে উঠছিল। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল ক্যামেরার অডিও রেকর্ডার। হেডফোনে সে শুনতে পাচ্ছিল, ফিসফিসানির শব্দগুলো আসলে অর্থহীন নয়। সেগুলো ছিল প্রাচীন বাংলার এক বিকৃত রূপ, যা সে বুঝতে পারছিল না। কিন্তু তার মধ্যে বারবার একটা শব্দ ফিরে আসছিল—"বলি... বলি... বলি..."
শ্রেয়া তার চোখ বন্ধ করে রেখেছিল। সে জানত, এই গ্রামের দৃশ্য তার মনকে আরও দুর্বল করে দেবে। সে শুধু ডায়েরির ম্যাপটা মনে মনে স্মরণ করার চেষ্টা করছিল। "সোজাসুজি... নাটমন্দিরের পেছনের রাস্তাটা গ্রামের শেষ মাথায় গিয়ে মিশেছে... সেখানেই দালানটা..."
কিন্তু তার মনোযোগ দেওয়াটা ছিল কঠিন। কারণ, গ্রামের গুঞ্জনটা এখন আর শুধু গুঞ্জন ছিল না। সেটা ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছিল এক সম্মিলিত বিলাপের সুরে। শত শত কণ্ঠ, নারী-পুরুষ-শিশু, সবাই মিলে একই গান গাইছিল—সেই করুন, বিষণ্ণ ঘুমপাড়ানি গান। কিন্তু একসাথে গাওয়ার ফলে সেটা কোনো সঙ্গীত ছিল না, ছিল এক ভয়ঙ্কর, কর্ণভেদী কথোপকথন।
এই ভয়ঙ্কর পথ ধরে তারা এগিয়ে চলছিল। তাদের শরীর ক্লান্তিতে, ভয়ে, আর তাদের নিজেদের ছায়ার সাথে নিরন্তর যুদ্ধে ভেঙে পড়ছিল। কিন্তু তাদের মনের ভেতরে ছিল এক মরিয়া জেদ। এই নরকের পথ তাদের পার হতেই হবে। কারণ, এই পথের শেষেই আছে তাদের একমাত্র মুক্তির—বা ধ্বংসের—সম্ভাবনা।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion