Episode 11867 words3 views

মানচিত্রের বাইরে : একাদশ পর্ব

নরকের পথ ধরে তারা যত এগোতে লাগল, তাদের নিজেদের ছায়াদের প্রতিরোধ ততই বুদ্ধিদীপ্ত এবং সুনির্দিষ্ট হয়ে উঠল। তারা আর শুধু নড়াচড়ায় বাধা দিচ্ছিল না, তারা সক্রিয়ভাবে তাদের যাত্রাপথে অন্তরায় সৃষ্টি করছিল। এই বিদ্রোহ আর অন্ধ আক্রোশ ছিল না; এর মধ্যে ছিল এক শীতল, হিসাব করা শত্রুতা। ছায়াগুলো তাদের মালিকদের সবচেয়ে বড় শক্তি এবং গভীরতম দুর্বলতাগুলো জানত, আর সেই জ্ঞানকেই তারা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছিল। বিশ্বাসঘাতকতাটা এখন আর শুধু শারীরিক ছিল না, ছিল আত্মিক। আরিক (নেতার পতন): সে সবার সামনে পথ দেখিয়ে চলছিল। তার মনটা ছিল এক কঠিন লক্ষ্যে স্থির—দালানটায় পৌঁছানো। কিন্তু তার শরীরটা তার সাথে ছিল না। তার ছায়াটা যেন তার নেতৃত্বকে মেনে নিতে পারছিল না। বারবার আরিকের ছায়া-পা মাটির ওপর থাকা কোনো অদৃশ্য শিকড় বা পাথরের ছায়ার ওপর আটকে যাচ্ছিল। ফলে আরিক আচমকা হোঁচট খাচ্ছিল, টলে পড়ছিল। তার টর্চের আলো কেঁপে উঠছিল, মুহূর্তের জন্য পথ অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছিল। প্রতিবার সামলে ওঠার জন্য তাকে দ্বিগুণ শক্তি প্রয়োগ করতে হচ্ছিল। এটা ছিল এক নিরন্তর борьба শুধু এগিয়ে যাওয়ার জন্য নয়, শুধু দাঁড়িয়ে থাকার জন্যও। তার নিজের ছায়াটাই তাকে ফেলে দেওয়ার জন্য বদ্ধপরিকর ছিল। রিয়া (স্মৃতির মায়া): তার মানসিক প্রতিরোধ প্রায় ভেঙে গিয়েছিল। সে প্রায় একটা ঘোরের মধ্যে হাঁটছিল। তার ছায়াটা এই সুযোগটা নিল। ছায়াটা বারবার তাকে রাস্তার পাশের অন্ধকার, ভাঙা বাড়িগুলোর দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। রিয়ার মনে হচ্ছিল, যেন একটা ঠান্ডা হাত তার কাঁধ ধরে টানছে। আর তার মাথার ভেতরে ফিসফিসানিটা আবার শুরু হয়েছিল। তার নিজেরই গলার স্বরে এক শীতল কণ্ঠ বলছিল, ‘এদিকে আয়, রিয়া... এখানে আলো নেই, কষ্ট নেই... শুধু শান্তি... শুধু বিস্মৃতি...’। সে কয়েকবার সত্যিই একটা ভাঙা বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েছিল। আরিক আর শ্রেয়া তাকে ধরে না ফেললে হয়তো সে সেই অন্ধকারের গভীরে হারিয়েই যেত। জয় (আলোর ক্ষয়): তার কাঁধের সেই ভৌতিক যন্ত্রণাটা কমে এলেও একটা ভোঁতা ব্যথা রয়ে গিয়েছিল। সে তার নিজের টর্চটা জ্বেলে দলের পেছনে হাঁটছিল, যাতে পেছনের দিকটাও সুরক্ষিত থাকে। কিন্তু তার ছায়াটার লক্ষ্য ছিল একটাই—আলো নিভিয়ে দেওয়া। জয়ের ছায়া-হাতটা বারবার তার টর্চের ছায়াটার ওপর এসে পড়ছিল, যেন লেন্সটা ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করছে। আর যখনই এমন হচ্ছিল, জয়ের হাতের টর্চটা সত্যি সত্যিই নিভু নিভু করে উঠছিল, তার আলোটা হলুদ আর দুর্বল হয়ে যাচ্ছিল। জয়ের মনে হচ্ছিল, তার হাতের টর্চটা বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, তার নিজের শরীরের উত্তাপও যেন সেই যন্ত্র থেকে শুষে নেওয়া হচ্ছে। শ্রেয়া (যুক্তির বিভ্রম): তার লড়াইটা ছিল সবচেয়ে সূক্ষ্ম এবং সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। সে ডায়েরির ম্যাপটা মনে মনে স্মরণ করে পথ চেনার চেষ্টা করছিল। কিন্তু তার ছায়াটা তার দৃষ্টি নিয়ে খেলছিল। টর্চের আলোয়, মাটির রাস্তার ওপর শ্রেয়া দেখছিল মরীচিকার মতো পথ—ডানে একটা রাস্তা, বাঁয়ে একটা গলি। কিন্তু সে জানত, ম্যাপ অনুযায়ী সোজা একটাই পথ আছে। তার ছায়াটা তার চোখের সামনে ভ্রম তৈরি করছিল, তাকে ভুল পথে চালিত করার জন্য। তাকে তার নিজের চোখকে অবিশ্বাস করে, এক মৃত মানুষের আঁকা মানচিত্রের ওপর ভরসা করে এগোতে হচ্ছিল। এটা ছিল তার যুক্তিবাদী মনের ওপর এক চরম আক্রমণ। এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতে তাদের মধ্যে এক অদ্ভুত বোঝাপড়া তৈরি হলো। তারা কথা না বলেও একে অপরের দুর্বলতাগুলো বুঝতে পারছিল। যখন আরিক হোঁচট খাচ্ছিল, জয় তার পিঠে টর্চের আলো ফেলে পথটা স্থির রাখছিল। যখন রিয়া ভুল পথে যেতে চাইছিল, শ্রেয়া তার হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছিল। তারা একে অপরের নোঙর হয়ে উঠেছিল, এক উত্তাল, অন্ধকার সমুদ্রে। তাদের শরীরগুলো একসাথে হাঁটছিল, আর তাদের ছায়াগুলো মাটিতে একে অপরের সাথে এক নীরব, হিংস্র যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল। তারা যখন গ্রামের প্রায় শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছল, তখন তাদের চারপাশের ছায়ামূর্তিগুলোর গুঞ্জন আর বিলাপের শব্দ কমে এল। তার জায়গায় এল এক নতুন, আরও গভীর, আরও ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধতা। তারা বুঝতে পারল, তারা অভিশাপের কেন্দ্রের কাছাকাছি চলে এসেছে। আর এখানেই তাদের ছায়াদের বিশ্বাসঘাতকতা চরম পর্যায়ে পৌঁছল। আরিকের ছায়াটা হঠাৎ করে তার দুটো পা-ই মাটিতে গেঁথে দিল। আরিক টলে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। সে তার সমস্ত শক্তি দিয়েও আর এক পা এগোতে পারছিল না। তার ছায়াটা তাকে থামিয়ে দিয়েছিল। রিয়ার মাথার ভেতরের ফিসফিসানিটা হঠাৎ করে তার মায়ের গলার স্বরে পরিণত হলো। "অনেক হয়েছে, মা। এবার বাড়ি চল,"—এই কথাটা শুনে রিয়ার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। সে মাটিতে বসে পড়ার জন্য তৈরী হলো। জয়ের হাতের টর্চটা দপ করে নিভে গেল। তার ছায়াটা সফল হয়েছিল। তারা ডুবে গেল এক মুহূর্তের জমাট অন্ধকারে। আর শ্রেয়ার মনের ভেতরে, ম্যাপের ছবিটা পুরোপুরি মুছে গিয়ে তার জায়গায় ফুটে উঠল সেই ভয়ঙ্কর, সর্পিল সঙ্কেতটা। সে পথ হারিয়ে ফেলল। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, সবকিছু শেষ। তারা হেরে গেছে। কিন্তু সেই চরম হতাশার মুহূর্তেই, তাদের ভেতরের মানবতা জেগে উঠল। "জয়! টর্চ!" আরিক তার নিজের ছায়ার সাথে যুদ্ধ করতে করতেই চিৎকার করে উঠল। জয় তার টর্চটায় সজোরে একটা ঝাঁকুনি দিল। আলোটা আবার জ্বলে উঠল, দুর্বল কিন্তু স্থির। সেই আলোয় শ্রেয়া আবার তার আত্মা ফিরে পেল। সে রিয়ার দিকে তাকিয়ে, তার মায়ের কথা ভুলে যাওয়ার জন্য, প্রায় ধমকের সুরে বলল, "রিয়া! এটা সত্যি নয়! আমার দিকে তাকাও! আমরা এখনো বেঁচে আছি!" শ্রেয়ার কথায় রিয়া চমকে উঠল। সে দেখল শ্রেয়ার ভীত কিন্তু দৃঢ় চোখের দিকে। সে বুঝতে পারল, স্মৃতির মায়ায় ডুবে গেলে তার চলবে না। আরিক তার সমস্ত ইচ্ছাশক্তি এক করে, এক ভয়ঙ্কর চিৎকার করে, তার পা দুটোকে মাটি থেকে তুলে এক কদম এগিয়ে গেল। তার ছায়াটা যেন এই প্রবল ইচ্ছাশক্তির কাছে এক মুহূর্তের জন্য হেরে গেল। তারা আবার এগোতে শুরু করল। এবার আরও ধীরে, আরও কষ্টে। কিন্তু তারা একসাথে ছিল। একে অপরের শক্তি, একে অপরের সাহস। বিশ্বাসঘাতকতার ভার তাদের পিঠ ভেঙে দিচ্ছিল, কিন্তু তারা একে অপরের অবলম্বন হয়ে সেই ভার বহন করছিল। তারা জানত, এই পথ তাদের ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তারা এটাও জানত, এই পথ ছাড়া তাদের আর কোনো পথ নেই। চলবে...

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion