Episode 91091 words0 views

মানচিত্রের বাইরে : নবম পর্ব

সময় তার স্বাভাবিক গতি হারিয়েছিল। সেকেন্ডগুলো ঘণ্টার মতো দীর্ঘ, আর প্রতিটি নিঃশ্বাস ছিল এক-একটি সংগ্রামের সমান। নাটমন্দিরের চাতালটা হয়ে উঠেছিল এক জীবন্ত নরক, যেখানে চারজন মানুষ তাদের নিজেদেরই সত্তার অন্ধকার প্রতিরূপের সাথে এক অসম যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। আগুনটা ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে আসছিল, তার শিখাগুলো আর উজ্জ্বল কমলা ছিল না, বরং হয়ে উঠেছিল এক ক্লান্ত, রক্তিম আভা। আর আলো যত কমছিল, ছায়াগুলো ততই যেন প্রাণবন্ত, ততই যেন শক্তিশালী হয়ে উঠছিল। এই চরম বিশৃঙ্খলা আর আতঙ্কের মধ্যে শ্রেয়ার মনটা হঠাৎ করেই আশ্চর্যরকমভাবে শান্ত হয়ে গেল। এটা ছিল ঝড়ের কেন্দ্রের মতো এক শীতল নিস্তব্ধতা। সে দেখছিল আরিককে, যে তার নিজের ছায়ার ভয়ে নিজেকে প্রায় পঙ্গু করে ফেলেছে। সে দেখছিল রিয়াকে, যার মানসিক প্রতিরোধ ভেঙে পড়ার মুখে। সে দেখছিল জয়কে, যে শারীরিক যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছিল। আর সে অনুভব করছিল তার নিজের মনের ভেতরে এক শীতল, পরজীবী চেতনার অনুপ্রবেশ, যা তার ছায়াটা মাটিতে আঁকা প্রতিটি সঙ্কেতের সাথে সাথে আরও গভীর হচ্ছিল। সে বুঝতে পারল, এভাবে বসে থাকলে মৃত্যু নিশ্চিত। হয় তারা ভয়ে পাগল হয়ে যাবে, অথবা তাদের ছায়াদের নতুন কারাগারে পরিণত হবে। পালানোটা একটা ভ্রম ছিল। প্রথম থেকেই পালানোর কোনো পথ ছিল না। একমাত্র পথ হলো গভীরে যাওয়া, আক্রমণের দিকে এগিয়ে যাওয়া। তাদের একটা অস্ত্র দরকার। আর এই যুক্তিহীন, ভৌতিক জগতে তাদের একমাত্র অস্ত্র হলো জ্ঞান—ডায়েরির সেই লেখা আর দেওয়ালের সেই ছবি। এই সিদ্ধান্তটা নেওয়ার সাথে সাথেই শ্রেয়ার ভেতরে এক অদ্ভুত, শীতল সাহসের জন্ম হলো। সে তার নিজের ছায়াটার দিকে তাকাল, যা তখনো মাটিতে বসে সেই সর্পিল চিহ্ন এঁকে চলেছিল। শ্রেয়ার মনে হলো, ছায়াটা তাকে নিয়ে হাসছে, তার এই নিষ্ফল প্রতিরোধের চেষ্টাকে ব্যঙ্গ করছে। "না," শ্রেয়া নিজের মনেই ফিসফিস করে বলল। "তুই জিতবি না।" সে বাকিদের দিকে ইশারায় বোঝানোর চেষ্টা করল যে সে তার ব্যাগ থেকে কিছু একটা বের করবে। আরিক আর জয় তাদের নিজেদের ছায়াকে সামলাতে সামলাতে যন্ত্রণাকাতর চোখে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। শ্রেয়া খুব ধীরে, মিলিমিটারে মিলিমিারে তার শরীরটা নাড়িয়ে তার পিঠের ব্যাগটার দিকে হাত বাড়াল। প্রতিটি নড়াচড়ার সাথে তার ছায়াটাও নড়ছিল, কিন্তু সেই বিরক্তিকর ‘ল্যাগ’ আর ‘খস’ শব্দটা এখন যেন আরও প্রকট, আরও বিদ্রূপকারী। মনে হচ্ছিল, ছায়াটা যেন বলছে, "কর, চেষ্টা করে দেখ। তোর প্রতিটি পদক্ষেপ আমারই নিয়ন্ত্রণে।" ব্যাগ থেকে ফোন আর ডায়েরিটা বের করাটা ছিল এক দুঃসাধ্য কাজ। শ্রেয়ার ছায়াটা তার হাতের ছায়াকে অনুকরণ করে ব্যাগটার ছায়ার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিচ্ছিল, যেন সে-ই জিনিসগুলো বের করছে। শ্রেয়ার নিজের হাতেই তার ছায়ার এক শীতল, অবাস্তব স্পর্শ অনুভব হলো। তার সারা শরীর ঘিনঘিন করে উঠল। অবশেষে সে জিনিস দুটো বের করতে পারল। ফোনের ব্যাটারি ছিল মাত্র সাত শতাংশ। একটা লাল সতর্কতা চিহ্ন স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছিল। এইটুকু সময়ই তার সম্বল। সে ফোনের স্ক্রিনের আলোটা যতটা সম্ভব কমিয়ে দিল, যাতে তার ছায়াটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠতে না পারে। তারপর সে গ্যালারিতে খুলে রাখা দেওয়ালচিত্রের ছবিগুলোর দিকে মন দিল। সাথে সাথেই তার মাথায় আক্রমণটা শুরু হলো। তার ছায়াটা যখন দেখল সে ছবিগুলোর দিকে মনোযোগ দিচ্ছে, তখন তার মানসিক আক্রমণ আরও তীব্র হয়ে উঠল। শ্রেয়ার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল যজ্ঞের রাতের ভয়ঙ্কর দৃশ্য—পোড়া মাংসের গন্ধ, মানুষের আর্তনাদ, ছায়া-দেবতার সেই শূন্যতার রূপ যা দেখলে আত্মা পর্যন্ত জমে যায়। তার কানে বাজতে লাগল সেই তান্ত্রিকের মন্ত্রোচ্চারণের বিকৃত প্রতিধ্বনি। শ্রেয়া দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করতে লাগল। সে একজন গবেষক। তার কাজই হলো বিশৃঙ্খলার মধ্যে থেকে নিয়ম খুঁজে বের করা। সে জোর করে নিজের মন থেকে এই মায়া গুলোকে সরাতে লাগল। 'Focus, Shreya, focus! This is just data. Analyze the data.' সে যজ্ঞের ছবিটার ওপর জুম করল। গ্রামবাসীদের ছায়াগুলো ঘন, জমাট কালো। ছায়া-দেবতা নিজেই অন্ধকারের মূর্তি। কিন্তু তান্ত্রিক...? শ্রেয়া যা দেখল, তাতে তার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। যজ্ঞের আগুনের তীব্র আলোয় বাকি সবার যখন স্পষ্ট, গভীর ছায়া পড়েছে, তখন সেই তান্ত্রিকের ছায়াটা প্রায় নেই বললেই চলে। একটা হালকা, প্রায় স্বচ্ছ আভা শুধু তার পায়ের কাছে দেখা যাচ্ছে। এতটাই ক্ষীণ যে প্রথমবার তারা সেটাকে খেয়ালই করেনি। 'কেন? ওর ছায়া এত দুর্বল কেন?'—শ্রেয়ার মাথায় প্রশ্নটা বিদ্যুৎগতিতে খেলে গেল। 'এটা শিল্পীর ভুল? না। এই ছবি ভয়ে আঁকা, desesperación-এ আঁকা। এখানে অপ্রয়োজনীয় কিছু আঁকার বিলাসিতা শিল্পীর ছিল না। প্রতিটি আঁচড়ই গুরুত্বপূর্ণ।' সে দ্রুত ডায়েরির পাতা ওল্টাতে শুরু করল। তার আঙুলগুলো ঠান্ডায় আর ভয়ে অবশ হয়ে গিয়েছিল। পাতাগুলো এত ভঙ্গুর ছিল যে যেকোনো মুহূর্তে গুঁড়িয়ে যেতে পারে। সে শেষের পাতায় পৌঁছাল, যেখানে লেখাগুলো প্রায় মুছে গেছে। ফোনের আলো ফেলে সে অক্ষরগুলো উদ্ধার করার চেষ্টা করল। এক-একটি করে অক্ষর, যেন সে এক হারিয়ে যাওয়া ভাষার পাঠোদ্ধার করছে। তার ছায়াটা তার ঘাড়ে ঝুঁকে পড়ার ভঙ্গি করছিল, যেন সে-ও পড়ার চেষ্টা করছে। শ্রেয়ার মনে হচ্ছিল, ছায়াটা চায় না সে এই লাইনের অর্থ বুঝুক। অতি কষ্টে সে পড়ল: "যিনি ছায়াদের শাসন করিবেন, প্রথমে তাহাকেই ছায়াহীন হইতে হইবে।" (He who will rule the shadows, must first become shadowless.) এক মুহূর্তে সবকিছু তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। এক ভয়ঙ্কর, শীতল সত্যের আলো তার মনের সমস্ত ভয় আর মায়া কে ভেদ করে গেল। তান্ত্রিক গ্রামবাসীদের ছায়া দিয়ে যজ্ঞ করে ছায়া-দেবতাকে জাগিয়েছিল, কিন্তু সে নিজের ছায়া সেই যজ্ঞে আহুতি দেয়নি। সে নিজের ছায়াকে কোনোভাবে দমন করেছিল বা প্রায় নষ্ট করে ফেলেছিল, আর সেই কারণেই সে ছায়াদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা পেয়েছিল। ছায়ার ওপরে আধিপত্য করার শর্তই হলো ছায়াহীন হওয়া! এই অভিশাপের উৎস কোনো দেবতা নয়। উৎস হলো সেই তান্ত্রিকের অসমাপ্ত সাধনা আর তার নিয়ন্ত্রণ করার লোভ। এই আবিষ্কার শ্রেয়াকে কোনো আনন্দ দিল না। বরং এক ভয়ঙ্কর সম্ভাবনার দিকে ইঙ্গিত করল। যদি ছায়াহীন হওয়াই নিয়ন্ত্রণের পথ হয়, তাহলে... সে উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে বাকিদের দিকে তাকাল। তারা তখনো নিজেদের ছায়ার সাথে যুদ্ধ করে চলেছে। সে আর ফিসফিস করে কথা বলল না। তার গলা দিয়ে বেরিয়ে এল এক ভাঙা, চেরা কিন্তু দৃঢ় চিৎকার: "আমি... আমি মনে হয় একটা পথ পেয়েছি!" তার গলা শুনে বাকিরা চমকে তার দিকে তাকাল। তাদের চোখে কোনো আশা ছিল না, ছিল শুধু ক্লান্তি আর শূন্যতা। শ্রেয়ার কথায় সেই শূন্যতা এক মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠল। শ্রেয়া হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, "আমাদের পালাতে হবে না। পালানোর কোনো পথ নেই। আমাদের এই অভিশাপের উৎসের কাছে যেতে হবে। সেই তান্ত্রিক... সেই-ই এর শুরু আর শেষ। দেওয়ালচিত্রে দেখানো হয়েছে, নাটমন্দিরের ঠিক পেছনে একটা ভাঙা দালান আছে। ওটাই মনে হয় ছিল ওর আস্তানা। এই অভিশাপের কেন্দ্রবিন্দু সেখানেই আছে। আমাদের ওটাকে খুঁজে বের করতে হবে।" রিয়া কান্নারত গলায় বলল, "কিন্তু কীভাবে? আমরা নড়তেও পারছি না! আমাদের নিজেদের ছায়াই তো আমাদের শত্রু।" "আমি জানি না," শ্রেয়া স্বীকার করল, তার চোখে তখন এক অদ্ভুত আগুন জ্বলছিল। "কিন্তু এখানে বসে থাকলেও মৃত্যু, আর ওখানে গেলেও মৃত্যু। অন্তত চেষ্টা করে মরাটাও একটা পথ।" আরিকের চোখে প্রথমবারের মতো আবার সেই পুরনো আগুনটা জ্বলে উঠল। এক ভয়ঙ্কর জেদ। আগুনটা তখন প্রায় নিভে এসেছে, তার শেষ আভা তাদের মুখে দীর্ঘ, কাঁপতে থাকা ছায়া ফেলছিল। তাদের সামনে তখন একটাই পথ খোলা। শ্যামলগড়ের গভীরতম অন্ধকারে, অভিশাপের হৃদপিণ্ডের দিকে এগিয়ে যাওয়া। ধীরে ধীরে, ইচ্ছাশক্তির জোরে, তারা উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। তাদের শরীর কাঁপছিল, তাদের ছায়ারা মাটিতে শুয়ে বিদ্রোহ করছিল। প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল এক যুদ্ধ। কিন্তু তারা আর একা ছিল না। তাদের সামনে ছিল এক ভয়ঙ্কর উদ্দেশ্য। যুদ্ধটা এখন আর শুধু বাঁচার জন্য ছিল না, ছিল নিজেদের অস্তিত্বকে পুনরুদ্ধার করার জন্য।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion