বিশ্বাসঘাতকতার ভার বহন করে, একে অপরের শক্তিকে অবলম্বন করে, তারা গ্রামের শেষ প্রান্তের দিকে এগিয়ে চলল। তাদের চারপাশের ছায়ামূর্তিগুলোর বিলাপ আর গুঞ্জন ধীরে ধীরে পেছনে মিলিয়ে যাচ্ছিল। তার জায়গায় আসছিল এক নতুন, আরও গভীর, আরও ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধতা। এই নিস্তব্ধতা শূন্য ছিল না; এটা ছিল এক পূর্ণ, জমাট বাঁধা নিস্তব্ধতা, যা তাদের কানের ওপর চাপ সৃষ্টি করছিল।
প্রায় আধ ঘণ্টা, যা তাদের কাছে অনন্তকাল বলে মনে হয়েছিল, সেই ভয়ঙ্কর পথ ধরে হাঁটার পর, তারা সেটা দেখতে পেল।
গ্রামের অন্য সব বাড়ির থেকে আলাদা, এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা একটা দ্বিতল, পোড়ো দালান। এটা শুধু ভাঙা বা পুরনো ছিল না। দালানটাকে দেখে মনে হচ্ছিল, ওটা যেন গ্রামের শরীরে একটা গভীর, সংক্রামিত ক্ষত। দেওয়ালের ইটগুলো ক্ষয়ে গিয়ে ধারালো হয়ে আছে, তার ওপর জন্মানো শ্যাওলাগুলোও সবুজ নয়, কালচে-বেগুনি। দালানটার চারপাশে একটাও জীবন্ত গাছ নেই, শুধু কয়েকটা মরা, কালো ডালপালা আকাশের দিকে প্রার্থনার ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে আছে।
তারা যত কাছে এগোচ্ছিল, বাতাস ততই ভারী আর শীতল হয়ে উঠছিল। তাদের নিঃশ্বাসের সাথে মুখ দিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছিল। আর তাদের ত্বকের ওপর দিয়ে যেন স্থির বিদ্যুতের স্রোত বয়ে যাচ্ছিল, যা তাদের গায়ের রোম খাড়া করে দিচ্ছিল।
বিকৃত সুরটা এখানেই সবচেয়ে তীব্র। কিন্তু এখন আর সেটা চারপাশ থেকে আসছিল না। মনে হচ্ছিল, শব্দটা আসছে ওই দালানের তলা থেকে, মাটির গভীর থেকে। যেন গোটা বাড়িটাই এক অশুভ সত্তার মতো গোঙাচ্ছে।
তারা দালানের প্রবেশপথ থেকে প্রায় দশ ফুট দূরে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। দালানের দরজা বলে কিছু নেই, আছে শুধু একটা জমাট অন্ধকারের হাঁ। সেই অন্ধকারের দিকে তাকালে মাথা ঘুরে যাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল যেন ওটা একটা ব্ল্যাক হোল, যা আলো, শব্দ, আশা—সবকিছুকে শুষে নিচ্ছে।
"এটাই," শ্রেয়া হাঁপাতে হাঁঁপাতে বলল। "তান্ত্রিকের আস্তানা।"
তারা এগোনোর চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না।
একটা অদৃশ্য দেওয়াল যেন তাদের পথ আটকে দিয়েছে। না, দেওয়াল নয়। তার চেয়েও ভয়ঙ্কর কিছু। তাদের নিজেদের ছায়া। তারা দেখল, তাদের ছায়াগুলো আর তাদের অনুসরণ করছে না। তারা মাটিতে, তাদের পায়ের কাছে স্থির হয়ে গেছে। তারা তাদের ছায়া-পা দিয়ে মাটিকে এমনভাবে আঁকড়ে ধরেছে, যেন বহুদিনের পুরনো শিকড়। ছায়াগুলো আর এক ইঞ্চিও এগোতে চাইছে না।
শ্রেয়া বুঝতে পারল। এই জায়গাটা হলো ছায়াদের উৎস, তাদের শক্তির কেন্দ্রবিন্দু। গ্রামের বাকি ছায়ারা হয়তো এখানে ফিরতে চায়, কিন্তু তাদের নিজেদের শরীরের সাথে জুড়ে থাকা এই নতুন, বিদ্রোহী ছায়ারা ভয় পাচ্ছে। তারা তাদের নতুন পাওয়া স্বাধীনতা আর সত্তা নিয়ে এই ভয়ঙ্কর উৎসের মুখোমুখি হতে চাইছে না।
তারা তাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে এগোনোর চেষ্টা করল। তাদের পেশিগুলো ফুলে উঠল, কপালে ফুটে উঠল শির। কিন্তু তাদের শরীর আর এক চুলও নড়ল না। তাদের নিজেদের ছায়ারাই তাদের বন্দি করে ফেলেছে।
তারা তাদের লক্ষ্যের দোরগোড়ায় এসে পৌঁছেছে। অভিশাপের হৃদপিণ্ড তাদের সামনে। কিন্তু সেই হৃদপিণ্ডে প্রবেশ করার শেষ বাধাটা কোনো ভূত বা প্রেত নয়, কোনো অদৃশ্য দেওয়াল নয়।
শেষ বাধাটা হলো তারা নিজেরা।
তারা দাঁড়িয়ে রইল সেই ভয়ঙ্কর দালানের সামনে, নিজের শরীরের কারাগারে বন্দি হয়ে। প্রবেশপথের সেই নিকষ কালো অন্ধকার তাদের দিকে তাকিয়ে হাসছিল, আর অপেক্ষা করছিল তাদের শেষ ইচ্ছাশক্তিটুকুও নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার জন্য।
এই অচলাবস্থাটা ছিল অসহনীয়। তারা সামনে এগোতে চাইছিল, কিন্তু তাদের ছায়ারা তাদের পেছনে টেনে ধরছিল। তাদের শরীরটা হয়ে উঠেছিল এক দড়ি টানাটানির ময়দান। একদিকে ছিল তাদের বাঁচার ইচ্ছা, আর অন্যদিকে ছিল তাদের ছায়াদের আত্মরক্ষার প্রবৃত্তি।
আরিক গর্জে উঠল। "এভাবে হবে না!" সে তার সমস্ত শক্তি এক করে এক পা এগোনোর চেষ্টা করল। তার পেশিগুলো যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। তার মনে হলো, সে শুধু নিজের শরীরের ওজন নয়, একটা আস্ত পাহাড় ঠেলছে।
রিয়া ভয়ে কাঁদতে শুরু করল। তার ছায়াটা মাটিতে লেপ্টে গিয়ে এমনভাবে কাঁপছিল, যেন সে চরম আতঙ্কে জমে গেছে। আর সেই আতঙ্কটা রিয়ার নিজের মনেও সংক্রমিত হচ্ছিল।
জয় তার টর্চটা দালানের দরজার দিকে ফেলল। কিন্তু আলোটা সেই অন্ধকারের ভেতরে প্রবেশ করতে পারল না। মনে হলো, অন্ধকারটা আলোটাকে গিলে ফেলছে।
শ্রেয়া তার জ্ঞান আর যুক্তি দিয়ে এই পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করছিল। 'ছায়ারা ভয় পাচ্ছে... তার মানে, ভেতরে এমন কিছু আছে যা তাদের চেয়েও শক্তিশালী... যা তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে... বা ধ্বংস করতে পারে।' এই উপলব্ধিটা তাকে এক ভয়ঙ্কর সাহস দিল।
সে চিৎকার করে বলল, "আমাদের এগোতেই হবে! এটাই একমাত্র পথ! জোর লাগাও!"
তার কথায় বাকিরাও যেন নতুন করে শক্তি পেল। তারা একে অপরকে দেখল। তাদের চোখে ছিল ভয়, যন্ত্রণা, কিন্তু তার সাথে ছিল এক মরিয়া সংকল্প। তারা একা নয়। তারা একসাথে আছে।
তারা একসাথে, একযোগে তাদের সমস্ত ইচ্ছাশক্তি এক বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত করল। তারা চিৎকার করল, এক অস্ফুট, সম্মিলিত আর্তনাদ। তারা তাদের শরীরগুলোকে সামনে ঠেলতে লাগল, তাদের বিদ্রোহী ছায়াগুলোকে মাটির ওপর দিয়ে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল।
সেই ‘খসসস’ শব্দটা এখন আর ফিসফিসানি ছিল না। সেটা এক বধির করা চিৎকারে পরিণত হলো। তাদের শরীর আর ছায়ার মধ্যেকার বন্ধনটা ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো।
এক ইঞ্চি। দুই ইঞ্চি। তারা এগোচ্ছিল। যন্ত্রণায় তাদের মুখ বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তারা এগোচ্ছিল।
তারা এসে পৌঁছল সেই জমাট অন্ধকারের দোরগোড়ায়। তাদের শরীরটা দালানের ভেতরে প্রবেশ করার জন্য ঝুঁকে পড়েছে, কিন্তু তাদের ছায়ারা বাইরে, মাটিতে মরিয়াভাবে আটকে আছে। তারা আক্ষরিক অর্থেই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছিল।
আর ঠিক তখনই, সেই অন্ধকারের ভেতর থেকে, মাটির তলার সেই গোঙানির শব্দ ছাপিয়ে, একটা নতুন শব্দ ভেসে এল।
একটা শুকনো, হিসহিসে নিঃশ্বাসের শব্দ।
যেন বহু যুগ ধরে ঘুমিয়ে থাকা কোনো সত্তা এইমাত্র জেগে উঠল। যেন কিছু একটা ভেতরে বসে ছিল, অপেক্ষা করছিল। আর এখন, শিকার দোরগোড়ায় এসে পৌঁছতেই, সে তার প্রথম নিঃশ্বাসটা নিল।
সেই শব্দটা তাদের মেরুদণ্ড দিয়ে এক শীতল স্রোত বইয়ে দিল, যা তাদের ছায়াদের দেওয়া যন্ত্রণার চেয়েও অনেক বেশি ভয়ঙ্কর ছিল। তারা বুঝতে পারল, তারা শুধু একটা অভিশপ্ত দালানে প্রবেশ করছে না।
তারা প্রবেশ করছে কোনো এক জীবন্ত সত্তার মুখে।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion