সেই হিসহিসে, প্রাচীন নিঃশ্বাসের শব্দটা ছিল এক অনুঘটকের মতো। ওটা ছিল এক জীবন্ত সত্তার অস্তিত্বের প্রথম অকাট্য প্রমাণ। এতদিন তারা লড়াই করছিল এক বিমূর্ত অভিশাপের বিরুদ্ধে, গ্রামের ভৌতিক স্মৃতির বিরুদ্ধে, নিজেদেরই শরীরের বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে। কিন্তু এই শব্দটা ছিল অন্য কিছু। এটা ছিল এক শিকারির শব্দ, যে তার শিকারকে দোরগোড়ায় দেখে জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটছে।
এই উপলব্ধিটা তাদের মধ্যে এক নতুন, আদিম ভয়ের জন্ম দিল, যা তাদের ছায়াদের দেওয়া যন্ত্রণার চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল। ছায়ারা ভয় পাচ্ছিল এই দালানের উৎসকে, কিন্তু এখন তারা ভয় পাচ্ছিল এর ভেতরে থাকা জীবন্ত বর্তমানকে।
"এখনি!" আরিক তার সমস্ত শক্তি দিয়ে গর্জে উঠল। "একসাথে!"
এটা আর কোনো অনুরোধ ছিল না, ছিল এক desperate আদেশ।
তারা একে অপরের দিকে তাকাল। তাদের চোখে ছিল ভয়, যন্ত্রণা, কিন্তু তার সাথে ছিল এক মরিয়া সংকল্প। তারা একা নয়। তারা একসাথে আছে।
তারা একসাথে, একযোগে তাদের সমস্ত ইচ্ছাশক্তি এক বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত করল। তারা চিৎকার করল, এক অস্ফুট, সম্মিলিত আর্তনাদ যা তাদের গলা দিয়ে নয়, আত্মা থেকে বেরিয়ে এল। তারা তাদের শরীরগুলোকে সামনে ঠেলতে লাগল, তাদের বিদ্রোহী ছায়াগুলোকে মাটির ওপর দিয়ে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল।
আর তারপর, সেই চরম যন্ত্রণার মুহূর্তে, কিছু একটা ঘটল।
একটা ধাতব ‘টং’ শব্দের মতো, কিন্তু আরও গভীর, আরও মৌলিক, কিছু একটা ছিঁড়ে গেল।
সেই ‘খসসস’ শব্দটা একটা চূড়ান্ত, তীক্ষ্ণ আর্তনাদ করে থেমে গেল। তাদের শরীরগুলো হঠাৎ করেই ভারমুক্ত হয়ে গেল। পেছনের সেই অদৃশ্য, আঠালো টানটা আর ছিল না।
ভারসাম্য হারিয়ে তারা চারজনে হুড়মুড়িয়ে দালানের জমাট অন্ধকারের ভেতরে ছিটকে পড়ল। তারা পাথরের ঠান্ডা, স্যাঁতসেঁতে মেঝের ওপর একে অপরের ওপর স্তূপের মতো পড়ে রইল, হাঁপাচ্ছিল, তাদের সারা শরীর যন্ত্রণায় এবং পরিশ্রমে কাঁপছিল।
কয়েক মুহূর্ত পর, যখন তাদের শ্বাস কিছুটা স্বাভাবিক হলো, জয় তার টর্চটা জ্বালাল। আলোটা কাঁপতে কাঁপতে ঘরের ভেতরে ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু তারা ঘরের ভেতরটা দেখার আগে, দেখল দরজার দিকে।
তারা যা দেখল, তাতে তাদের রক্ত জল হয়ে গেল।
তাদের ছায়াগুলো আর তাদের সাথে ছিল না।
দরজার বাইরে, গ্রামের মাটিতে, তাদের চারটি ছায়া পড়েছিল। তারা আর স্থির ছিল না। তারা কাঁপছিল, থরথর করে কাঁপছিল, যেন প্রচণ্ড শীতে জমে যাওয়া কোনো প্রাণী। তারা দরজার চৌকাঠের দিকে তাকিয়ে ছিল চরম আতঙ্কে। তারা ভেতরে আসার চেষ্টা করছিল না, বরং তাদের ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল, তারা তাদের মালিকদের এই ভয়ঙ্কর জায়গায় ফেলে রেখে পালিয়ে যেতে পারলে বাঁচে।
এই প্রথমবার, জন্মাবার পর এই প্রথমবার, তারা তাদের ছায়া থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।
এই অনুভূতিটা মুক্তির ছিল না। ছিল ভয়ঙ্কর। তাদের শরীরগুলোকে অস্বাভাবিকরকম হালকা লাগছিল। তাদের মনে হচ্ছিল, তারা যেন আর মাটির সাথে বাঁধা নেই, যেন তারা বেলুনের মতো ভেসে উঠবে। একটা গভীর শূন্যতা, একটা অপূর্ণতার অনুভূতি তাদের গ্রাস করল। তারা বুঝতে পারল, ছায়া শুধু আলোর অনুপস্থিতি নয়, তা হলো মাটির সাথে, বাস্তবতার সাথে আমাদের সংযোগের প্রমাণ। আজ তারা সেই সংযোগ হারিয়ে ফেলেছে।
তাদের ছায়ারা বাইরে বন্দি, আর তারা ভেতরে। কে বেশি ভাগ্যবান, তা বলা কঠিন ছিল।
এই ভয়ঙ্কর মুক্তির পর কয়েক মুহূর্তের জন্য, তারা কেবল মেঝের উপর পড়ে রইল, তাদের ফুসফুস বাতাসের জন্য আকুল, তাদের মন এই নতুন, অস্বাভাবিক বাস্তবতার সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। জয় প্রথম উঠে বসল, তার হাত কাঁপছিল যখন সে টর্চটা তুলে ধরল। আলোটা ঘরের ধুলোময় বাতাসে কণাগুলোকে দৃশ্যমান করে তুলল, যেন লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র তারা এক অন্ধকার মহাবিশ্বে ভাসছে।
"ওরা... ওরা বাইরে," রিয়া ফিসফিস করে বলল, তার কণ্ঠস্বর বিস্ময় এবং আতঙ্কে ভরা। সে দরজার দিকে আঙুল তুলে দেখাল।
তারা সবাই তাকাল। টর্চের আলোয়, তারা তাদের ছায়াগুলোকে আরও স্পষ্টভাবে দেখতে পেল। তারা আর কেবল মাটির উপর সমতল দাগ ছিল না। তাদের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম, ত্রিমাত্রিক গুণ দেখা যাচ্ছিল, যেন তারা প্রায়-বাস্তব হয়ে উঠছে। তারা একসাথে জড়োসড়ো হয়ে ছিল, একদল ভীত, পরিত্যক্ত শিশুর মতো, বাইরের বিশ্বের দিকে আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে ছিল। একসময়কার অত্যাচারীরা এখন নিজেরাই শিকার। এক অদ্ভুত, বিকৃত করুণা শ্রেয়ার মনে জেগে উঠল, যা ভয়কে আরও বাড়িয়ে দিল।
"আমাদের... আমাদের ছায়া নেই," আরিক বলল, তার কণ্ঠস্বর প্রায় শোনা যাচ্ছিল না। সে তার নিজের হাতের দিকে তাকাল, তারপর মেঝের দিকে, যেখানে তার ছায়া থাকার কথা ছিল। কিন্তু সেখানে কিছুই ছিল না। তার হাতটা যেন শূন্যে ভাসছে, বাস্তবতার সাথে তার কোনো সংযোগ নেই।
এই অনুভূতিটা ছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। তাদের শরীরের ওজন কমে গেছে বলে মনে হচ্ছিল, তাদের পদক্ষেপগুলো ছিল হালকা এবং অস্থির। তাদের মনে হচ্ছিল, তারা যেন পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে সামান্য উপরে ভাসছে, তাদের পা মাটির সাথে পুরোপুরি সংযোগ স্থাপন করতে পারছে না। এটা ছিল এক গভীর, অস্তিত্বের সংকট। তারা কি এখন সম্পূর্ণ? নাকি তারা তাদের আত্মার এক অংশ বাইরে ফেলে এসেছে?
এই নতুন, ভয়ঙ্কর বাস্তবতার সাথে লড়াই করতে করতে, তারা অবশেষে তাদের চারপাশের দিকে মনোযোগ দিল। তারা যে ঘরে প্রবেশ করেছিল, তা ছিল এক দুঃস্বপ্নের দৃশ্য।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion