Episode 141008 words6 views

অধ্যায় ১৪: তান্ত্রিকের পাঠাগার

বন্ধন মুক্তির সেই ভয়ঙ্কর অনুভূতির পর কয়েক মুহূর্তের জন্য, তারা কেবল মেঝের উপর পড়ে রইল, তাদের ফুসফুস বাতাসের জন্য আকুল, তাদের মন এই নতুন, অস্বাভাবিক বাস্তবতার সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। জয় প্রথম উঠে বসল, তার হাত কাঁপছিল যখন সে টর্চটা তুলে ধরল। আলোটা ঘরের ধুলোময় বাতাসে কণাগুলোকে দৃশ্যমান করে তুলল, যেন লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র তারা এক অন্ধকার মহাবিশ্বে ভাসছে। "ওরা... ওরা বাইরে," রিয়া ফিসফিস করে বলল, তার কণ্ঠস্বর বিস্ময় এবং আতঙ্কে ভরা। সে দরজার দিকে আঙুল তুলে দেখাল। তারা সবাই তাকাল। টর্চের আলোয়, তারা তাদের ছায়াগুলোকে আরও স্পষ্টভাবে দেখতে পেল। তারা আর কেবল মাটির উপর সমতল দাগ ছিল না। তাদের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম, ত্রিমাত্রিক গুণ দেখা যাচ্ছিল, যেন তারা প্রায়-বাস্তব হয়ে উঠছে। তারা একসাথে জড়োসড়ো হয়ে ছিল, একদল ভীত, পরিত্যক্ত শিশুর মতো, বাইরের বিশ্বের দিকে আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে ছিল। একসময়কার অত্যাচারীরা এখন নিজেরাই শিকার। এক অদ্ভুত, বিকৃত করুণা শ্রেয়ার মনে জেগে উঠল, যা ভয়কে আরও বাড়িয়ে দিল। "আমাদের... আমাদের ছায়া নেই," আরিক বলল, তার কণ্ঠস্বর প্রায় শোনা যাচ্ছিল না। সে তার নিজের হাতের দিকে তাকাল, তারপর মেঝের দিকে, যেখানে তার ছায়া থাকার কথা ছিল। কিন্তু সেখানে কিছুই ছিল না। তার হাতটা যেন শূন্যে ভাসছে, বাস্তবতার সাথে তার কোনো সংযোগ নেই। এই অনুভূতিটা ছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। তাদের শরীরের ওজন কমে গেছে বলে মনে হচ্ছিল, তাদের পদক্ষেপগুলো ছিল হালকা এবং অস্থির। তাদের মনে হচ্ছিল, তারা যেন পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে সামান্য উপরে ভাসছে, তাদের পা মাটির সাথে পুরোপুরি সংযোগ স্থাপন করতে পারছে না। এটা ছিল এক গভীর, অস্তিত্বের সংকট। তারা কি এখন সম্পূর্ণ? নাকি তারা তাদের আত্মার এক অংশ বাইরে ফেলে এসেছে? এই নতুন, ভয়ঙ্কর বাস্তবতার সাথে লড়াই করতে করতে, তারা অবশেষে তাদের চারপাশের দিকে মনোযোগ দিল। তারা যে ঘরে প্রবেশ করেছিল, তা ছিল এক দুঃস্বপ্নের দৃশ্য। বাইরে থেকে দালানটাকে যতটা বড় মনে হয়েছিল, ভেতরটা ছিল তার চেয়েও অনেক বিশাল। টর্চের আলোটা যেন এই ঘরের অন্ধকারকে পুরোপুরি ভেদ করতে পারছিল না। আলোটা কয়েক ফুট গিয়েই যেন ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল, যেন অন্ধকারটা একটা ঘন তরলের মতো, যা আলোকে শুষে নিচ্ছে। তারা একটা বড়, গোলাকার ঘরে দাঁড়িয়েছিল। ঘরের দেওয়ালগুলো ছিল কালো, মসৃণ পাথর দিয়ে তৈরি। কিন্তু সেই পাথরের গায়ে কোনো শ্যাওলা বা ধুলো ছিল না। পাথরগুলো ছিল জীবন্তের মতো মসৃণ। আর সেই পাথরের গায়ে খোদাই করা ছিল হাজার হাজার সর্পিল চিহ্ন, সেই গোলকধাঁধার মতো সঙ্কেত, যা শ্রেয়ার ছায়াটা মাটিতে আঁকছিল। এখানে, এই চিহ্নগুলো যেন স্থির ছিল না। টর্চের আলোয় তাদের মনে হচ্ছিল, চিহ্নগুলো খুব ধীরে, সাপের মতো নড়াচড়া করছে, নিজেদের মধ্যে স্থান পরিবর্তন করছে। ঘরের মাঝখানে কোনো আসবাবপত্র ছিল না। তার বদলে ছিল অদ্ভুত সব জিনিস। এক কোণে রাখা একটা বিশাল, পিতলের টেলিস্কোপ, যা ছাদের একটা গর্ত দিয়ে আকাশের দিকে তাক করা। কিন্তু সেই আকাশে কোনো তারা ছিল না, ছিল শুধু জমাট অন্ধকার। আরেক কোণে ছিল সার সার কাঁচের জার, যার ভেতরে কোনো সংরক্ষিত প্রাণী নয়, ছিল তরল, ঘূর্ণায়মান অন্ধকার, যা জারের ভেতরে ধোঁয়ার মতো পাক খাচ্ছিল। আর ছিল বই। শত শত বই। চামড়ায় বাঁধানো, হাতে লেখা পুঁথি। তাকগুলো দেওয়ালের সাথে এমনভাবে মিশে গিয়েছিল যে সেগুলোকে দেওয়ালেরই অংশ বলে মনে হচ্ছিল। বইয়ের চামড়াগুলো ছিল অস্বাভাবিকরকম নরম, আর তার রঙ ছিল বিভিন্ন—ফ্যাকাসে সাদা, তামাটে, কালচে। শ্রেয়া ভয়ে ভয়ে একটা বই স্পর্শ করল। তার মনে হলো, সে কোনো মরা প্রাণীর চামড়া নয়, স্পর্শ করছে মানুষের উষ্ণ ত্বক। "এই জায়গাটা... এটা কোনো সাধারণ বাড়ি নয়," শ্রেয়া ফিসফিস করে বলল। "এটা একটা গবেষণাগার... একটা মন্দির...।" তারা বুঝতে পারছিল, তান্ত্রিক শুধু কালো জাদুতেই পারদর্শী ছিল না। সে ছিল এক মহাজাগতিক বিষয়ের গবেষক। সে ছায়া, অন্ধকার, শূন্যতা—এইসব মৌলিক শক্তি নিয়ে গবেষণা করত। মাটির তলা থেকে আসা সেই গোঙানির মতো শব্দটা এখানে আরও স্পষ্ট। তারা বুঝতে পারল, এই ঘরটা মূল জায়গা নয়। শব্দটা আসছে ঘরের মাঝখানে থাকা একটা নিচু, পাথরের বেদি থেকে। তারা এগিয়ে গেল। বেদির ওপরে খোদাই করা ছিল একটা বিশাল, জটিল নক্ষত্রপুঞ্জের মানচিত্র। কিন্তু সেই মানচিত্র পৃথিবীর কোনো আকাশের নয়। সেই তারামণ্ডল ছিল অচেনা, ভিনগ্রহের। আর মানচিত্রের ঠিক মাঝখানে ছিল একটা গর্ত—এক সিঁড়ি যা নিচের অন্ধকারে নেমে গেছে। শব্দটা আসছিল সেখান থেকেই। তারা একে অপরের দিকে তাকাল। তাদের আর ফেরার কোনো পথ ছিল না। তাদের ছায়াহীন শরীর নিয়ে, এক মৃতপ্রায় টর্চেল আলো সম্বল করে, তারা সেই নরকের সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল। এই নামাটা ছিল এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। সিঁড়িটা ছিল ঘোরানো, কিন্তু তার কোনো কেন্দ্র ছিল না। ধাপগুলো যেন শূন্যের মধ্যে ভাসছিল। প্রতিটা ধাপে নামার সাথে সাথে তাদের চারপাশের বাতাস আরও ঠাণ্ডা, আরও ভারী হয়ে উঠছিল। তাদের কানে মন্ত্রোচ্চারণের শব্দটা আরও স্পষ্ট হচ্ছিল। তারা বুঝতে পারল, এটা কোনো রেকর্ড করা শব্দ নয়। এটা জীবন্ত। বহু কণ্ঠস্বর একসাথে মন্ত্র উচ্চারণ করে চলেছে। অবশেষে সিঁড়িটা শেষ হলো। তারা এসে পৌঁছল এক বিশাল, প্রাকৃতিক গুহার মতো জায়গায়। গুহার ছাদ এতটাই উঁচুতে যে টর্চেল আলো সেখানে পৌঁছাচ্ছিল না। গুহার মাঝখানে ছিল তাদের যাত্রার শেষ গন্তব্য। একটা বৃত্তাকার কুয়ো। কুয়োটা ছিল কালো, পালিশ করা আগ্নেয়শিলার মতো কিছু দিয়ে তৈরি। তার চারপাশে কোনো রেলিং ছিল না। কুয়োর ভেতর থেকে কোনো জল বা তরলের শব্দ আসছিল না। আসছিল শুধু সেই মন্ত্রোচ্চারণের শব্দ আর এক তীব্র, হাড়-কাঁপানো ঠান্ডা। তারা ভয়ে ভয়ে কুয়োর কিনারায় গিয়ে দাঁড়াল। টর্চেল আলো ফেলে ভেতরে দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু আলোটা কুয়োর অন্ধকারে প্রবেশ করে হারিয়ে গেল। এর কোনো তল দেখা যাচ্ছিল না। "এটাই... এটাই সেই উৎস," শ্রেয়া বলল, তার গলা ভয়ে কাঁপছিল। তারা যখন কুয়োর অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ছিল, তখন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। কুয়োর ভেতরের অন্ধকারটা, যা এতক্ষণ আলো শুষে নিচ্ছিল, সেটা হঠাৎ করেই স্থির হয়ে গেল। একটা কাঁচের মতো মসৃণ তল তৈরি হলো। এবং সেই তলে প্রতিবিম্ব ফুটে উঠল। কিন্তু সেটা তাদের প্রতিবিম্ব ছিল না। টর্চেল আলোর প্রতিবিম্ব ছিল না। সেই কালো আয়নায় তারা দেখল রাতের আকাশ। কিন্তু সেই আকাশে ছিল অদ্ভুত, অচেনা তারামণ্ডল। তারা দেখল এক বেগুনি রঙের চাঁদ, দুটো সূর্য। তারা দেখল এক ভিন্ন জগতের আকাশ। তারপর প্রতিবিম্বটা বদলে গেল। তারা দেখল এই গুহাটাই। কিন্তু বহু বছর আগের। তারা দেখল সেই তান্ত্রিককে। লম্বা, কৃশ, তার মুখে ছিল জ্ঞান আর উন্মাদনার এক ভয়ঙ্কর মিশ্রণ। সে সেই কুয়োর সামনে দাঁড়িয়ে মন্ত্র উচ্চারণ করছিল। তারপর সে তার নিজের ছায়াটাকে শরীর থেকে আলাদা করে, একটা কাপড়ের মতো ভাঁজ করে, সেই কুয়োর অন্ধকারে আহুতি দিল। কুয়োটা সেই ছায়াটাকে গিলে ফেলল। কিন্তু পরিবর্তে, কুয়োর ভেতর থেকে বেরিয়ে এল এক ঝলক জমাট অন্ধকার, যা তান্ত্রিকের শরীরে প্রবেশ করল। তারা দেখল, তান্ত্রিকের শরীরটা কাঁপছে, তার চোখ দুটো জ্বলে উঠছে এক অপার্থিব, কালো আলোয়। সে অমরত্ব বা জ্ঞান পায়নি, সে নিজেই হয়ে উঠেছিল সেই শূন্যতার এক প্রবেশদ্বার। এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে তারা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion