তারা যখন কুয়োর অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ছিল, তখন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। কুয়োর ভেতরের অন্ধকারটা, যা এতক্ষণ আলো শুষে নিচ্ছিল, সেটা হঠাৎ করেই স্থির হয়ে গেল। একটা কাঁচের মতো মসৃণ তল তৈরি হলো।
এবং সেই তলে প্রতিবিম্ব ফুটে উঠল।
কিন্তু সেটা তাদের প্রতিবিম্ব ছিল না। টর্চের আলোর প্রতিবিম্ব ছিল না।
সেই কালো আয়নায় তারা দেখল রাতের আকাশ। কিন্তু সেই আকাশে ছিল অদ্ভুত, অচেনা তারামণ্ডল। তারা দেখল এক বেগুনি রঙের চাঁদ, দুটো সূর্য। তারা দেখল এক ভিন্ন জগতের আকাশ।
তারপর প্রতিবিম্বটা বদলে গেল। তারা দেখল এই গুহাটাই। কিন্তু বহু বছর আগের। তারা দেখল সেই তান্ত্রিককে। লম্বা, কৃশ, তার মুখে ছিল জ্ঞান আর উন্মাদনার এক ভয়ঙ্কর মিশ্রণ। সে সেই কুয়োর সামনে দাঁড়িয়ে মন্ত্র উচ্চারণ করছিল। তারপর সে তার নিজের ছায়াটাকে শরীর থেকে আলাদা করে, একটা কাপড়ের মতো ভাঁজ করে, সেই কুয়োর অন্ধকারে আহুতি দিল।
কুয়োটা সেই ছায়াটাকে গিলে ফেলল। কিন্তু পরিবর্তে, কুয়োর ভেতর থেকে বেরিয়ে এল এক ঝলক জমাট অন্ধকার, যা তান্ত্রিকের শরীরে প্রবেশ করল। তারা দেখল, তান্ত্রিকের শরীরটা কাঁপছে, তার চোখ দুটো জ্বলে উঠছে এক অপার্থিব, কালো আলোয়। সে অমরত্ব বা জ্ঞান পায়নি, সে নিজেই হয়ে উঠেছিল সেই শূন্যতার এক প্রবেশদ্বার।
এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে তারা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।
তাদের চারপাশের গুহার পরিবেশটাও যেন বদলে গেল। তাদের মনে হলো, তারা আর শুধু দর্শক নয়, তারা সেই অতীতের ঘটনার অংশ হয়ে গেছে। তাদের নাকে এসে লাগল এক অদ্ভুত গন্ধ—পোড়া কর্পূর আর শুকনো রক্তের মিশ্রণ। তাদের কানে বাজতে লাগল সেই তান্ত্রিকের কণ্ঠস্বর, যা কুয়োর ভেতরকার মন্ত্রোচ্চারণের সাথে মিলে এক ভয়ঙ্কর ঐকতান তৈরি করল। শব্দগুলো তাদের বোধগম্য ছিল না, কিন্তু তার অর্থ ছিল স্পষ্ট—এটা ছিল এক আবাহন, এক সমর্পণ।
তারা দেখল, তান্ত্রিক তার ছায়া উৎসর্গ করার পর যন্ত্রণায় চিৎকার করছে না, বরং হাসছে। এক বিজয়ী, উন্মত্ত হাসি। তার শরীরের শিরাগুলো চামড়ার নিচে কালো হয়ে ফুলে উঠেছিল, তার নখগুলো লম্বা আর ছুঁচালো হয়ে যাচ্ছিল। তার নিঃশ্বাস হয়ে উঠেছিল শীতল, বাষ্পময়। তারা যা শুনেছিল দালানের দোরগোড়ায়—সেই হিসহিসে, প্রাচীন নিঃশ্বাস—সেটা ছিল এই রূপান্তরিত, অ-মানবীয় সত্তারই। সে কোনো ভূত বা প্রেতাত্মায় পরিণত হয়নি, হয়েছিল আরও ভয়ঙ্কর কিছুতে।
এই দৃশ্যটা তাদের চেতনার ওপর এক গভীর ক্ষত সৃষ্টি করল। আরিক দেখল তান্ত্রিকের চোখে সেই একই উচ্চাকাঙ্ক্ষার আগুন, যা সে নিজের চোখে বহুবার দেখেছে। শ্রেয়া দেখল জ্ঞানের জন্য এক ভয়ঙ্কর পিপাসা, যা সমস্ত নৈতিকতাকে ছাপিয়ে গেছে। তারা বুঝতে পারল, তারা শুধু এক শয়তানের কীর্তি দেখছে না, দেখছে নিজেদেরই অন্ধকারতম সম্ভাবনার এক প্রতিচ্ছবি।
তারপর, ঠিক যতটা আকস্মিকভাবে শুরু হয়েছিল, ততটাই আকস্মিকভাবে দৃশ্যটা মিলিয়ে গেল। কুয়োর ভেতরের প্রতিবিম্বটা এক মুহূর্তের জন্য আবার নিকষ কালো হয়ে গেল। গুহার ভেতরে ফিরে এল সেই পরিচিত, হাড়-কাঁপানো ঠান্ডা আর মন্ত্রের একটানা গুঞ্জন।
তারা হাঁপাচ্ছিল। তাদের মনে হচ্ছিল, তারা যেন এক লম্বা দৌড়ের পর থেমেছে।
"আমরা... আমরা ওর জন্ম দেখেছি," জয় কাঁপা কাঁপা গলায় বলল।
"জন্ম নয়," শ্রেয়া তাকে শুধরে দিল, তার নিজের গলাও কাঁপছিল। "রূপান্তর।"
আর ঠিক তখনই, কুয়োর প্রতিবিম্বটা আবার বদলে গেল। শেষবারের মতো।
এবার সেই কালো আয়নায় তারা দেখল গুহার বর্তমান দৃশ্য। তারা দেখল চারটি মানব অবয়ব কুয়োর ধারে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু অবয়বগুলো তাদের নয়।
অবয়বগুলো ছিল জমাট অন্ধকারের তৈরি। চারটি ছায়ামূর্তি। তাদেরই ছায়া। যারা দরজার বাইরে আটকে ছিল, তারা কোনোভাবে ভেতরে চলে এসেছে। অথবা, কুয়োটা তাদের ভবিষ্যৎ দেখাচ্ছে—তারা কীসে পরিণত হতে চলেছে।
তারা আতঙ্কে জমে গিয়েছিল। নড়ার শক্তি ছিল না।
আর তখনই, কুয়োর প্রতিবিম্বের মধ্যে থাকা চারটি ছায়ামূর্তির মধ্যে একটি, যা আরিকের ছায়া হওয়ার কথা, সেটা ধীরে ধীরে তার মাথাটা তুলল। ছায়াটার কোনো মুখ ছিল না, চোখ ছিল না। কিন্তু তারা প্রত্যেকেই অনুভব করল, ছায়াটা সরাসরি তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
এবং তারপর, সেই নিরাকার মুখের ওপর, ধীরে ধীরে একটা হাসি ফুটে উঠল। এক দীর্ঘ, নীরব, বিজয়ীর হাসি।
তারা আর অভিশাপের শিকার ছিল না। তারা ছিল সেই অভিশাপের উত্তরাধিকারী।
তাদের ভয়টা তখন আর মৃত্যুর ছিল না। ছিল তার চেয়েও ভয়ঙ্কর এক পরিণতির। এই গ্রাম তাদের মারতে চায় না। এই গ্রাম চায়, তারা থেকে যাক। নতুন প্রহরী হিসেবে। নতুন তান্ত্রিক হিসেবে।
কুয়োর প্রতিবিম্বের মধ্যে থাকা চারটি ছায়ামূর্তি—তাদেরই অন্ধকার প্রতিরূপ—তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। তাদের ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল, তারা যেন বহুদিন ধরে অপেক্ষা করার পর তাদের উত্তরসূরিদের খুঁজে পেয়েছে।
হঠাৎ, প্রতিবিম্বের মধ্যে থাকা আরিকের ছায়া-মূর্তিটা ধীরে ধীরে তার ডান হাতটা তুলল।
আর গুহার ভেতরে, বাস্তব জগতে, আরিকের নিজের ডান হাতটা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে, একটা তীব্র ঝাঁকুনির সাথে, নিজে থেকেই কয়েক ইঞ্চি উপরে উঠে গেল।
বন্ধনমুক্তিটা ছিল এক ভ্রাম । তারা তাদের ছায়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি। তাদের ছায়ারা শুধু তাদের শরীর ছেড়ে এক নতুন, আরও শক্তিশালী রূপ ধারণ করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। আর কুয়োর ভেতরের সেই শূন্যতা তাদের এই রূপান্তরে সাহায্য করছিল।
তারা একে অপরের দিকে তাকাল। তাদের চোখে ছিল না বলা এক ভয়ঙ্কর সত্য। তারা শ্যামলগড় থেকে পালানোর জন্য আসেনি।
তারা এসেছিল শ্যামলগড় হয়ে যাওয়ার জন্য।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion