Episode 16903 words2 views

অধ্যায় ১৬: শূন্যতার আহ্বান

কুয়োর সেই কালো আয়নায় ফুটে ওঠা প্রতিবিম্বের হাসিটা ছিল এক চূড়ান্ত ঘোষণার মতো। ওটা ছিল এক দণ্ডাদেশ, যা থেকে আপিলের কোনো সুযোগ নেই। আরিকের ডান হাতটা যখন তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে, প্রতিবিম্বের ছায়া-মূর্তিটার অনুকরণে শূন্যে উঠে গেল, তখন তারা বুঝতে পারল, তাদের শরীরের ওপর তাদের নিজেদের আর কোনো পূর্ণ অধিকার নেই। তারা হয়ে উঠেছিল এক পাপেট, আর সেই কুয়োর গভীরের অদৃশ্য সত্তাটি ছিল তার পাপেট মাস্টার। আরিক তার সমস্ত শক্তি দিয়ে হাতটাকে নামানোর চেষ্টা করল। তার মুখের শিরা ফুলে উঠল, দাঁতে দাঁত চেপে বসল। তার মনে হচ্ছিল, সে যেন একটা এক টনের ওজনের পাথরকে নামানোর চেষ্টা করছে। তার নিজেরই মাংসপেশী, তার নিজেরই স্নায়ুতন্ত্র তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছিল। কয়েক মুহূর্তের সেই ভয়ঙ্কর যুদ্ধের পর, সে অবশেষে হাতটাকে নামাতে পারল। কিন্তু এই সামান্য জয়টুকুর জন্য তার শরীর থেকে যেন সমস্ত শক্তি নিংড়ে নেওয়া হয়েছিল। তারা ভয়ে পিছিয়ে আসার চেষ্টা করল, কিন্তু তাদের পা দুটো যেন মেঝের সাথে আটকে গিয়েছিল। আর ঠিক তখনই, কুয়োর ভেতর থেকে আসা সেই মন্ত্রোচ্চারণের শব্দটা থেমে গেল। তার জায়গায় এল এক নতুন, আরও ভয়ঙ্কর জিনিস—এক মানসিক আহ্বান। এটা কোনো শব্দ ছিল না। ছিল এক অনুভূতি, এক প্রতিশ্রুতি, যা সরাসরি তাদের চেতনার গভীরে প্রবেশ করছিল। কুয়োর ভেতরের সত্তাটি বুঝতে পেরেছিল যে জোর করে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না, তাই সে বেছে নিয়েছিল প্রলোভনের পথ। আরিক (নিয়ন্ত্রণের মোহ): তার মনের ভেতরে ভেসে উঠল এক শীতল, শক্তিশালী অনুভূতি—নিয়ন্ত্রণের অনুভূতি। সে দেখল, সে শুধু তার ছায়া নয়, গোটা শ্যামলগড় গ্রামকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তার ইশারায় ভাঙা বাড়িগুলো নতুন হয়ে উঠছে, মরা গাছগুলো বেঁচে উঠছে। তার জীবনে আর কোনো ব্যর্থতা নেই, কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেই। আছে শুধু ক্ষমতা, অসীম, অনন্ত ক্ষমতা। শূন্যতা তাকে বলছিল, ‘তোমার উচ্চাকাঙ্ক্ষা কোনো ভুল নয়, আরিক। শুধু তার ক্ষেত্রটা ছিল ছোট। এসো, এক নতুন রাজ্যের অধিপতি হও।’ রিয়া (স্মৃতির মোহ): তার চোখের সামনে ভেসে উঠল এক বিশাল মঞ্চ। লক্ষ লক্ষ দর্শক তার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু তারা মানুষ নয়, তারা সবাই ছায়ামূর্তি। তারা অনন্তকাল ধরে শুধু রিয়ারই গল্প শুনছে, শুধু তাকেই দেখছে। সে আর বিস্মৃত হবে না, হারিয়ে যাবে না। সে হয়ে উঠবে এক কিংবদন্তি, এক দেবী, যার পূজা হবে চিরকাল। শূন্যতা তাকে বলছিল, ‘তুমি খ্যাতি চেয়েছিলে, যা সময়ের সাথে ফিকে হয়ে যায়। আমি তোমাকে দেব মহিমা, যা অনন্তকালের।’ জয় (শান্তির মোহ): তার চারপাশের সমস্ত ভয়, সমস্ত আতঙ্ক এক মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল। তার কাঁধের যন্ত্রণা নেই, বুকের ভেতরের ধুকপুকানি নেই। আছে শুধু এক গভীর, অন্তহীন শান্তি। সে দেখল, সে তার ক্যামেরা ছাড়াই সবকিছু দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু কোনো কিছুতেই তার কোনো আবেগ হচ্ছে না। সে এক মুক্ত, নিরপেক্ষ দর্শক। শূন্যতা তাকে বলছিল, ‘ভয় হলো শরীরের ধর্ম, Joy। শরীরকে অতিক্রম করো, আর তুমি ভয়কেও অতিক্রম করবে। এসো, এই অনন্ত শান্তি গ্রহণ করো।’ শ্রেয়া (জ্ঞানের মোহ): তার মাথার ভেতরে খুলে গেল এক মহাজাগতিক গ্রন্থাগার। সে দেখল মহাবিশ্বের জন্ম, নক্ষত্রের মৃত্যু, সময়ের বুনন। ছায়া কী, আলো কী, জীবন কী—সমস্ত প্রশ্নের উত্তর তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। তান্ত্রিক যে জ্ঞানের জন্য তার সত্তাকে উৎসর্গ করেছিল, সেই সমস্ত জ্ঞান এখন তার হাতের মুঠোয়। শূন্যতা তাকে বলছিল, ‘তুমি সত্যের পূজারী, শ্রেয়া। কিন্তু তুমি শুধু বইয়ের পাতায় সত্য খুঁজেছ। আমি তোমাকে দেখাব জীবন্ত সত্য, মহাবিশ্বের अंतिम রহস্য।’ এই আহ্বান ছিল এক ভয়ঙ্কর, মিষ্টি বিষের মতো। এটা তাদের দুর্বলতায় আঘাত হানেনি, হেনেছিল তাদের গভীরতম ইচ্ছার ওপর। এক মুহূর্তের জন্য, তারা প্রত্যেকেই সেই প্রলোভনের কাছে আত্মসমর্পণ করার কথা ভেবেছিল। এই কষ্ট, এই যন্ত্রণা, এই ভয়ের শেষ যদি এত সুন্দর হয়, তাহলে ক্ষতি কী? এই মানসিক প্রলোভনের জাল প্রথম ছিঁড়ল শ্রেয়া। তার যুক্তিবাদী মন, যা এতক্ষণ প্রায় পরাজিত হয়ে গিয়েছিল, সেটাই শেষ মুহূর্তে তাকে বাঁচিয়ে দিল। সে বুঝতে পারল, এই যে জ্ঞান তাকে দেখানো হচ্ছে, তা সে নিজে অর্জন করছে না, তাকে ‘দেওয়া’ হচ্ছে। এটা জ্ঞান নয়, এটা হলো এক gilded খাঁচা। সে যে শান্তি অনুভব করছিল, তা ছিল মৃত্যুর শান্তি। যে নিয়ন্ত্রণ আরিককে দেখানো হচ্ছিল, তা ছিল এক দাসের নিয়ন্ত্রণ। 'না!'—সে তার মনের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠল। 'এটা আমার নয়! আমি আমার নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজেই খুঁজব!' তার এই মানসিক প্রত্যাখ্যানটা ছিল একটা পাথরের মতো, যা শান্ত জলে পড়ে ঢেউ তুলে দিল। তার তীব্র ইচ্ছাশক্তি বাকিদের চেতনাকেও স্পর্শ করল। আরিক, রিয়া, জয়—তারাও এক ঝটকায় সেই প্রলোভনের ঘোর থেকে বেরিয়ে এল। আর সাথে সাথেই কুয়োর ভেতরের সত্তাটি তার রূপ বদলাল। শান্ত, প্রলোভনকারী আহ্বানটা এক মুহূর্তে পরিণত হলো এক ভয়ঙ্কর, মানসিক গর্জনে। গুহাটা কাঁপতে শুরু করল, ছাদ থেকে ধুলো আর ছোট ছোট পাথর খসে পড়তে লাগল। কুয়োর চারপাশের কালো পাথরগুলো থেকে একটা কালো, ধোঁয়ার মতো বাষ্প বেরিয়ে আসতে লাগল। আর গুহার দেওয়ালের গায়ে মিশে থাকা গ্রামের সেই শত শত ছায়া-আত্মাগুলো যন্ত্রণায় কাতরাতে শুরু করল। তারা দেওয়াল থেকে বেরিয়ে এসে, গুহার মাঝখানে তাদের চারজনের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। "ও বুঝতে পেরেছে আমরা ওর ফাঁদে পা দিইনি," আরিক চিৎকার করে বলল। "ও এখন আমাদের জোর করে নিয়ে নেবে!" তারা দেখল, ছায়া-আত্মাগুলো তাদের ঘিরে একটা বৃত্ত তৈরি করছে, যা ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। তাদের পালানোর কোনো পথ ছিল না। এই চরম মুহূর্তে, শ্রেয়ার মস্তিষ্ক কাজ করছিল বিদ্যুৎগতিতে। সে মরিয়া হয়ে একটা উপায় খুঁজছিল। 'তান্ত্রিক... তান্ত্রিকের সাথে আমাদের পার্থক্য কোথায়?' সে নিজেকেই প্রশ্ন করল। 'সে নিজের ইচ্ছায় তার ছায়া উৎসর্গ করেছিল। আমরা করিনি। আমাদের ছায়াগুলো... আমাদের ছায়াগুলো বাইরে আটকে আছে!' সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্যটা তার মনে পড়ল—তাদের চারটি ভীত, পরিত্যক্ত ছায়া দালানের বাইরে কাঁপছিল। 'চুক্তিটা ছিল এক আত্মার সাথে তার ছায়ার ইচ্ছাকৃত বিচ্ছেদ,' শ্রেয়া ভাবল। 'কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে, বিচ্ছেদটা ছিল আকস্মিক এবং অনিচ্ছাকৃত। ছায়াদেরও ইচ্ছা ছিল না, আমাদেরও না। তার মানে... তার মানে চুক্তিটা অসম্পূর্ণ! The ritual is incomplete!' এই উপলব্ধিটা ছিল এক ঝলক বিদ্যুতের মতো। সত্তাটি তাদের প্রলোভন দেখাচ্ছিল, কারণ সে চেয়ে ছিল, তারা নিজের ইচ্ছায় তাদের নতুন, ছায়া-রূপে রূপান্তরিত হোক। তাহলেই চুক্তিটা সম্পূর্ণ হবে। "আমি... আমি একটা উপায় পেয়েছি!" শ্রেয়া চিৎকার করে বাকিদের বলল। "এই চুক্তিটা ভাঙা! আমাদের ছায়াগুলো বাইরে আছে! ওরাই আমাদের বাঁচার একমাত্র পথ!"

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion