Episode 18970 words2 views

অধ্যায় ১৮: শেষ বাজি

"কী বলছিস তুই?" জয় প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, যখন একটা ছায়ামূর্তি তার প্রায় গা ঘেঁষে চলে গেল। "তান্ত্রিক নিজের ছায়া উৎসর্গ করেছিল," শ্রেয়া দ্রুত ব্যাখ্যা করল। "কিন্তু আমাদের ছায়ারা স্বাধীন। তারা বাইরে আটকে আছে। এই সত্তাটা আমাদের শরীরকে ব্যবহার করে নতুন প্রহরী তৈরি করতে চায়, কিন্তু ছায়া ছাড়া শরীর অসম্পূর্ণ। তাই ও আমাদের লোভ দেখাচ্ছিল, যাতে আমরা স্বেচ্ছায় রূপান্তরিত হই। আমরা যদি কোনোভাবে আমাদের পুরনো ছায়াগুলোর সাথে আবার সংযোগ স্থাপন করতে পারি, তাহলে হয়তো এই চক্রটা ভাঙা যাবে!" "কিন্তু কীভাবে?" রিয়া বলল, তার গলা ভয়ে শুকিয়ে গিয়েছিল। "ও তো আমাদের এখান থেকে বেরোতেই দেবে না!" গুহার কম্পন বাড়ছিল। ছায়াদের বৃত্তটা তাদের থেকে মাত্র কয়েক ফুট দূরে। আরিক এক মুহূর্তের জন্য সিদ্ধান্ত নিল। তার চোখেমুখে ফুটে উঠল এক ভয়ঙ্কর, আত্মঘাতী সংকল্প। "বেরোতে হবে। আমাদের মধ্যে দুজনকে বেরোতে হবে। বাকি দুজন ওকে ব্যস্ত রাখবে।" "না, আরিক!" শ্রেয়া আঁতকে উঠল। "এটা আত্মহত্যা!" "এখানে দাঁড়িয়ে থাকলেও আত্মহত্যা!" আরিক পাল্টা চিৎকার করল। "এটা আমাদের শেষ সুযোগ, শ্রেয়া! এটাই আমাদের শেষ বাজি!" সে শ্রেয়ার দিকে তাকাল। "তুমি আর আমি ওকে আটকাব। তোমার জ্ঞান আর আমার... যা কিছু অবশিষ্ট আছে। জয়, রিয়া, তোমরা দৌড়াও। সিঁড়ি দিয়ে উপরে যাও। দরজা দিয়ে বেরিয়ে তোমাদের ছায়াগুলোকে খুঁজে বের করো। কীভাবে সংযোগ করবে আমি জানি না, কিন্তু তোমাদের করতে হবে!" জয় আর রিয়ার মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গিয়েছিল। এই দায়িত্ব তাদের জন্য ছিল অসম্ভব। কিন্তু আরিকের চোখের দিকে তাকিয়ে তারা কোনো প্রতিবাদ করতে পারল না। "যাও!" আরিক গর্জে উঠল। সেই মুহূর্তে, তারা আর ‘ঘোস্টইন’-এর সদস্য ছিল না। তারা ছিল একদল যোদ্ধা, যারা এক অসম যুদ্ধে তাদের শেষ চালটা চালছিল। আরিক আর শ্রেয়া ঘুরে কুয়োর দিকে মুখ করে দাঁড়াল, যেন তারা এক অদৃশ্য ঝড়ের সামনে বুক পেতে দিয়েছে। তারা তাদের সমস্ত মানসিক শক্তি এক করে সত্তাটির বিরুদ্ধে এক অদৃশ্য দেওয়াল তৈরি করার চেষ্টা করল। জয় আর রিয়া একে অপরের দিকে তাকাল। তারপর, এক মুহূর্তের দ্বিধা কাটিয়ে, তারা সিঁড়ির দিকে দৌড় লাগাল। গুহার ভেতরে, আরিক আর শ্রেয়া অনুভব করল এক ভয়ঙ্কর মানসিক চাপ, যা তাদের চেতনাকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। আর বাইরে, জয় আর রিয়া তাদের জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দৌড়টা শুরু করল—অভিশাপের কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে, নিজেদেরই বিচ্ছিন্ন আত্মার খোঁজে। যুদ্ধটা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। একদল লড়ছিল ভেতরে, আরেক দল বাইরে। কিন্তু তাদের ভাগ্য জড়িয়ে ছিল একটাই সুতোয়। এই পরিকল্পনাটা ছিল উন্মাদনার নামান্তর। শ্রেয়ার মস্তিষ্ক যখন মরিয়া হয়ে একটা পথ খুঁজে পেয়েছিল, তখন আরিকের মস্তিষ্ক খুঁজে নিয়েছিল সেই পথ কার্যকর করার একমাত্র উপায়—আত্মত্যাগ। "জয়! রিয়া!" আরিক আবার চিৎকার করল, তার কণ্ঠস্বর গুহার দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হলো। "সময় নেই! যাও!" জয় আর রিয়ার পা দুটো যেন মাটিতে গেঁথে গিয়েছিল। তাদের সামনে ছিল সেই অন্ধকার, ঘোরানো সিঁড়ি—যা দিয়ে তারা নেমেছিল, কিন্তু এখন সেই পথটাকেই মনে হচ্ছিল এক অচেনা, ঊর্ধমুখী নরক। আর তাদের পেছনে ছিল আরিক আর শ্রেয়া, যারা স্বেচ্ছায় নিজেদেরকে এক মহাজাগতিক, ক্ষুধার্ত সত্তার সামনে বলি দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। "আমরা... আমরা পারব না," রিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলল। তখনই ঘটল ঘটনাটা। আরিক, সেই দীর্ঘদেহী, শক্তিশালী যুবক, যে এই গোটা দুঃস্বপ্নের জন্য নিজেকে দায়ী করছিল, সে তার জীবনের সবচেয়ে সাহসী কাজটা করল। সে তার পাশ থেকে একটা আলগা, ভারী পাথর তুলে নিল এবং তার সমস্ত শক্তি দিয়ে সেটাকে ছুঁড়ে মারল কুয়োর জমাট অন্ধকারের দিকে। পাথরটা কুয়োর অদৃশ্য তলে কোনো শব্দ না করেই মিলিয়ে গেল। কিন্তু তার ফল হলো মারাত্মক। গুহার ভেতরের সেই মানসিক গর্জনটা এক মুহূর্তে কেন্দ্রীভূত হয়ে গেল। সত্তাটির সমস্ত ক্রোধ, সমস্ত ক্ষুধা, যা এতক্ষণ তাদের চারজনের ওপর বিভক্ত ছিল, তা এবার একা আরিকের ওপর আছড়ে পড়ল। "আআআহ্‌!" আরিকের মুখ দিয়ে এক তীব্র যন্ত্রণার আর্তনাদ বেরিয়ে এল। সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল, দুটো হাত দিয়ে নিজের মাথা চেপে ধরল। তার মনে হচ্ছিল, হাজারটা গরম ছুঁচ তার মস্তিষ্কের ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সে তার চোখের সামনে দেখছিল মহাবিশ্বের জন্ম আর ধ্বংসের ভয়ঙ্কর দৃশ্য। সত্তাটি তাকে শাস্তি দিচ্ছিল। "আরিক!" শ্রেয়া তার দিকে দৌড়ে যাওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু আরিক হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিল। "পালাও!" সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল। "এটাই... সুযোগ...!" আরিকের এই আত্মত্যাগ জয় আর রিয়ার ভেতরের সমস্ত দ্বিধাকে ভেঙে দিল। তারা বুঝতে পারল, তাদের বন্ধু তাদের জন্য নিজের জীবন বাজি রেখেছে। তারা আর এক মুহূর্তও দেরি করল না। জয় রিয়ার হাতটা শক্ত করে ধরল, এবং তারা একসাথে সিঁড়ির দিকে দৌড় লাগাল। তাদের চারপাশে তখন নরক গুলজার। ছায়া-আত্মাগুলো তাদের পথ আটকানোর জন্য এগিয়ে এল, তাদের শীতল, অস্তিত্বহীন হাত দিয়ে তাদের ধরার চেষ্টা করল। তাদের স্পর্শ লাগতেই জয়ের মনে হলো তার শরীরের সমস্ত উত্তাপ শুষে নেওয়া হচ্ছে, রিয়ার মনে হলো তার সমস্ত সুখের স্মৃতি মুছে যাচ্ছে। কিন্তু তারা থামল না। তারা সেই ছায়াদের নদী ঠেলে এগিয়ে চলল। আর তাদের পেছনে, শ্রেয়া বসে পড়ল আরিকের পাশে। সে আরিককে শারীরিকভাবে সাহায্য করতে পারত না, কিন্তু সে অন্য এক যুদ্ধ শুরু করল। সে চোখ বন্ধ করে, তার সমস্ত মানসিক শক্তি এক করে, কুয়োর সত্তাটির দিকে প্রেরণ করতে লাগল। সে মন্ত্র উচ্চারণ করছিল না। সে বলছিল বিজ্ঞানের কথা, ইতিহাসের কথা, যুক্তির কথা। "আলোর গতি শূন্য মাধ্যমে প্রতি সেকেন্ডে ২৯৯,৭৯২,৪৫৮ মিটার," সে চিৎকার করে বলতে লাগল। "পাই-এর মান ৩.১৪১৫৯... একটা মৌলিক সংখ্যাকে শুধু সেই সংখ্যা বা এক দিয়ে ভাগ করা যায়..." এগুলো ছিল তার অস্ত্র। মানব সভ্যতার যুক্তি, জ্ঞান, আর নিয়ম। এক প্রাচীন, বিশৃঙ্খল, মহাজাগতিক সত্তার বিরুদ্ধে এক তরুণী বিজ্ঞানীর মস্তিষ্কের লড়াই। তার এই যুক্তিগুলো সত্তাটির মানসিক আক্রমণের বিরুদ্ধে এক দুর্বল কিন্তু দৃঢ় দেওয়াল তৈরি করল, যা আরিককে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখছিল। জয় আর রিয়া তখন সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছে গেছে। তারা একবার শেষবারের মতো পেছনে ফিরে তাকাল। তারা দেখল, আরিক মাটিতে পড়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, আর শ্রেয়া তার পাশে বসে একমনে কিছু বলে চলেছে, যেন এক আধুনিক যুগের পুরোহিত তার বন্ধুকে বাঁচানোর জন্য মন্ত্র পড়ছে। আর তাদের ঘিরে, ছায়াদের সেই ভয়ঙ্কর নদীটা আবর্তিত হচ্ছিল। জয় আর রিয়ার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। তারা তাদের বন্ধুদের এই অবস্থায় ফেলে রেখে যেতে চায়নি। কিন্তু তারা জানত, এটাই তাদের একমাত্র আশা। তারা সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা রাখল। আর ঠিক তখনই, তাদের পেছনে, গুহার গভীর থেকে, আরিকের এক নতুন, আরও তীব্র, আরও ভয়ঙ্কর আর্তনাদ ভেসে এল। সেই আর্তনাদ জয় আর রিয়ার পিঠে চাবুকের মতো আঘাত করল। তারা আর পেছনে তাকাল না। তারা তাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে, কান্নারত চোখে, সিঁড়ি দিয়ে উপরের দিকে দৌড়াতে শুরু করল—এক অনিশ্চিত মুক্তির দিকে, এক ভয়ঙ্কর দায়িত্বের বোঝা কাঁধে নিয়ে।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion