আরিকের সেই যন্ত্রণাকাতর আর্তনাদ জয় আর রিয়ার পিঠে চাবুকের মতো আঘাত করল। শব্দটা শুধু তাদের কানে পৌঁছল না, পৌঁছল তাদের স্নায়ুর প্রতিটি কোষে। এটা ছিল এক বন্ধুর চরম চিৎকারের ধ্বনি, আর সেই ধ্বনিই তাদের অসাড় হয়ে যাওয়া পা দুটোকে সচল করে দিল। তারা আর পেছনে তাকাল না, কারণ পেছনে তাকানোর অর্থ ছিল সেই যন্ত্রণার সাক্ষী হওয়া, যা তাদের পাথর করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। তাদের সামনে ছিল সেই ঘোরানো, অন্তহীন সিঁড়ি—যা দিয়ে তারা নেমেছিল, কিন্তু এখন সেই পথটাকেই মনে হচ্ছিল এক অচেনা, ঊর্ধমুখী নরক, যার প্রতিটি ধাপ তাদের সিদ্ধান্তের ভারে আরও খাড়া, আরও পিচ্ছিল হয়ে উঠেছিল।
দৌড়।
তাদের অস্তিত্বের প্রতিটি কণা শুধু এই একটি শব্দই জানত। পায়ের নিচের পিচ্ছিল ধাপ, দেওয়াল থেকে চুঁইয়ে পড়া ঠাণ্ডা, স্যাঁতসেঁতে জল যা তাদের জামাকাপড় ভিজিয়ে দিচ্ছিল, আর তাদের নিজেদের আতঙ্কিত, ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ—এই ছিল তাদের জগৎ। গুহার গভীর থেকে আসা সত্তাটির মানসিক গর্জন আর আরিকের আর্তনাদ ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসছিল, কিন্তু তার প্রতিধ্বনি যেন সিঁড়ির প্রতিটি বাঁকে তাদের তাড়া করছিল, তাদের কানের ভেতরে ভূতের মতো ফিসফিস করছিল।
এই আরোহন শুধু শারীরিক ছিল না। সিঁড়িটা যেন জীবন্ত ছিল, এবং সে তাদের এই পলায়নকে স্বাগত জানাচ্ছিল না। জয়ের টর্চের আলোয় তাদের মনে হচ্ছিল, ধাপগুলো যেন নিজেদের স্থান পরিবর্তন করছে, পথটা যেন আরও দীর্ঘ, আরও জটিল হয়ে যাচ্ছে। সিঁড়ির দেওয়ালের ভেজা, শ্যাওলা পড়া গায়ে, পাথরের ভেতর থেকে, মুহূর্তের জন্য ভেসে উঠছিল গ্রামের সেই অভিশপ্ত বাসিন্দাদের যন্ত্রণাকাতর মুখের ছায়া। তারা যেন এই দুই পলাতককে ব্যঙ্গ করছিল, তাদের অবশ্যম্ভাবী পরিণতির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। এক পর্যায়ে, রিয়ার মনে হলো, দেওয়ালের একটা ভেজা অংশ থেকে বেরিয়ে আসা একটা হাত যেন তার চুল ছুঁয়ে দিল। সে চিৎকার করে সরে এল, কিন্তু সেখানে পাথর ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
ভয়টা জয়ের শরীরকে অসাড় করে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। তার প্রতিটি মাংসপেশী বিদ্রোহ করছিল, থেমে যাওয়ার জন্য আকুতি করছিল। কিন্তু আরিকের আর্তনাদ তার ভেতরে এক নতুন, মরিয়া শক্তির জন্ম দিয়েছিল। সে আর ‘ঘোস্টোইন’-এর ভীতু ক্যামেরাম্যান ছিল না, যে সবসময় লেন্সের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখত। সে ছিল এক বন্ধু, যে তার বন্ধুদের জীবনের বিনিময়ে পাওয়া এই সুযোগটাকে নষ্ট হতে দিতে পারে না। রিয়ার হাতটা সে এত শক্ত করে ধরেছিল যে তার নিজেরই আঙুলের গাঁট সাদা হয়ে গিয়েছিল। রিয়ার হাতের এই উষ্ণতাই ছিল এই বরফ-শীতল নরকে তার একমাত্র বাস্তবতার নোঙর।
রিয়ার মনের ভেতরে তখন এক অন্য যুদ্ধ চলছিল। তার ভয়ের জায়গাটা দখল করে নিয়েছিল এক তীব্র, আত্ম-বিধ্বংসী অপরাধবোধ আর জেদ। সে তার বন্ধুদের মৃত্যুর মুখে ফেলে রেখে পালাচ্ছিল, এই চিন্তাটা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। কিন্তু সে জানত, এটাই ছিল তাদের একমাত্র আশা। তার প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল আরিক আর শ্রেয়ার জন্য এক একটি প্রার্থনা। সে আর শুধু নিজের জন্য দৌড়াচ্ছিল না, দৌড়াচ্ছিল তাদের সবার জন্য। সিঁড়ির দেওয়ালে ভেসে ওঠা ছায়া-মুখগুলো যেন তার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলছিল, ‘বিশ্বাসঘাতক... তুমি ওদের ফেলে এসেছ... ওরা তোমার জন্যই মরবে...’। রিয়া দাঁতে দাঁত চেপে সেই ফিসফিসানিকে উপেক্ষা করে দৌড়ে চলল। তার চোখের জল আর কপালের ঘাম একসাথে মিশে তার মুখ ভিজিয়ে দিচ্ছিল।
অবশেষে, যা অনন্তকাল বলে মনে হচ্ছিল, তারপর, তারা সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছল। তারা হুড়মুড়িয়ে এসে পড়ল তান্ত্রিকের সেই গোলকধাঁধার মতো পাঠাগারে।
আর সাথে সাথেই এক অদ্ভুত, কর্ণভেদী পরিবর্তন অনুভব করল।
গুহার সেই ভয়ঙ্কর মানসিক চাপ, সেই তীব্র কম্পন—এখানে ছিল না। ঘরটা ছিল আশ্চর্যরকম শান্ত, নিস্তব্ধ। দেওয়ালের গায়ের সেই সর্পিল চিহ্নগুলো আর নড়ছিল না, স্থির হয়ে গিয়েছিল। কাঁচের জারের ভেতরের অন্ধকারগুলোও শান্ত ছিল। মনে হচ্ছিল, সত্তাটির সমস্ত মনোযোগ এখন নিচের গুহায়, আরিক আর শ্রেয়ার ওপর কেন্দ্রীভূত। এই ঘরটা যেন এক মুহূর্তের জন্য তার মনিবের কথা ভুলে গিয়েছিল।
কিন্তু এই শান্তিটা ছিল এক মর্গ বা সমাধিক্ষেত্রের শান্তির মতো—অস্বস্তিকর। ঘরের বাতাস ছিল ভারী, স্থির। টর্চের আলোয় ভাসমান ধূলিকণাগুলোও যেন নড়াচড়া করতে ভুলে গিয়েছিল। তাদের দৌড়ের শব্দ, তাদের ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ এই জমাট নিস্তব্ধতার মধ্যে অস্বাভাবিকরকম জোরে শোনাচ্ছিল।
তারা এক মুহূর্তও দেরি করল না। তারা সেই ভয়ঙ্কর ঘরের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে চলল দরজার দিকে—সেই জমাট অন্ধকারের হাঁ, যা দিয়ে তারা প্রবেশ করেছিল। তাদের পায়ের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। পিতলের টেলিস্কোপটা যেন এক অন্ধ চোখ দিয়ে তাদের দেখছিল, মানুষের ত্বকের মতো দেখতে বইগুলো যেন তাদের প্রতিটি পদক্ষেপের হিসাব রাখছিল।
তারা দালানের চৌকাঠে এসে পৌঁছল। বাইরে শ্যামলগড়ের সেই পরিচিত, ফ্যাকাসে চাঁদের আলো। এই আলো তাদের কাছে এখন স্বর্গের আলোর মতো মনে হচ্ছিল। কিন্তু তারা জানত, তাদের যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। বরং, সবচেয়ে কঠিন এবং অদ্ভুত অংশটা সবে শুরু হতে চলেছে।
তাদের মিশন—নিজেদেরই আত্মার এক বিচ্ছিন্ন অংশের মুখোমুখি হওয়া। এক ভয়ঙ্কর পুনর্মিলনের জন্য প্রস্তুত হওয়া, যা হয়তো তাদের বাঁচাবে, অথবা চিরতরে ধ্বংস করে দেবে।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion