Episode 20915 words3 views

অধ্যায় ২০: ব্যূহ

নিচে, গুহার গভীরে, যুদ্ধটা ছিল অন্যরকম। এখানে কোনো দৌড় ছিল না, ছিল শুধু সহনশীলতার এক ভয়ঙ্কর পরীক্ষা। জয় আর রিয়া সিঁড়ি দিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই, কুয়োর ভেতরকার সত্তাটির সমস্ত মনোযোগ ঘুরে গেল অবশিষ্ট দুই বন্দির দিকে। আরিকের ওপর সত্তাটির মানসিক আক্রমণটা ছিল পাশবিক এবং সুপরিকল্পিত। এটা শুধু যন্ত্রণা ছিল না, ছিল তার অস্তিত্বকে ভেঙে ফেলার এক সংগঠিত প্রচেষ্টা। সত্তাটি তার মনের ভেতরে প্রবেশ করে, তার গভীরতম স্মৃতি আর অনুশোচনাগুলোকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছিল। প্রথমে এল brute force। আরিকের মনে হলো, তার মাথার খুলির ভেতরে একটা নক্ষত্রের বিস্ফোরণ ঘটছে। তার চোখের সামনে শ্বেতশুভ্র আলো ঝলসে উঠল, তার কানে এল এক বধির করা গর্জন। তার শরীরটা পাথরের মেঝেতে আছড়ে পড়ল, প্রতিটি স্নায়ু যেন ছিঁড়ে যাচ্ছিল। এটা ছিল কাঁচা, আদিম শক্তির এক প্রদর্শন, যা তাকে এক মুহূর্তে শেষ করে দিতে পারত। কিন্তু ঠিক তখনই, শ্রেয়া তার পাশে এসে বসল। সে আরিকের কাঁধে হাত রাখল। তার স্পর্শটা ছিল ঠাণ্ডা, কাঁপা কাঁপা, কিন্তু সেই স্পর্শের মধ্যে দিয়ে আরিকের বিশৃঙ্খল চেতনায় প্রবেশ করল এক নতুন অনুভূতি—শৃঙ্খলা। শ্রেয়া তার মানসিক ব্যূহের প্রথম প্রাচীরটা তৈরি করল। সে তার মনের ভেতরে আবৃত্তি করছিল না, সে ‘প্রজেক্ট’ করছিল—মানব জ্ঞানের সবচেয়ে মৌলিক স্তম্ভগুলোকে। তার চেতনায় ভেসে উঠল পর্যায় সারণী—১১৮টি মৌল, যারা বিশৃঙ্খল প্রকৃতিকে এক সুন্দর, গাণিতিক নিয়মে বেঁধে রেখেছে। সে হাইড্রোজেন থেকে শুরু করে ওগানেসন পর্যন্ত প্রতিটি মৌলের নাম, তাদের পারমাণবিক সংখ্যা, তাদের গঠন—এই সমস্ত তথ্যকে এক দুর্ভেদ্য, স্ফটিকের জালের মতো করে সত্তাটির আক্রমণের সামনে মেলে ধরল। সত্তাটির আদিম ক্রোধ, শ্রেয়ার এই যুক্তির জালের সামনে এসে যেন কিছুটা প্রতিহত হলো। আরিকের ওপর চাপটা সামান্য কমল। সত্তাটি বুঝতে পারল, কাঁচা শক্তি দিয়ে এই প্রতিরোধ ভাঙা যাবে না। তাই সে তার রণকৌশল বদলাল। এবার সে শুরু করল মানসিক বিভ্রমের খেলা। আরিকের চোখের সামনের অন্ধকারটা মিলিয়ে গেল। সে দেখল, সে শ্যামলগড়ে আসেনি। সে কলকাতায়, তার নিজের ছোট্ট ফ্ল্যাটে বসে আছে। তার ইউটিউব চ্যানেল ‘ঘোস্টোইন’-এর সিলভার প্লে বাটনটা দেওয়ালে ঝুলছে। তার ফোন বাজছে, এক বিখ্যাত টিভি চ্যানেল থেকে তার ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য ফোন করেছে। সে দেখল, শ্রেয়া রান্নাঘর থেকে কফি নিয়ে এসে তার পাশে বসছে, তাদের মুখে কোনো ক্লান্তি বা ভয়ের চিহ্ন নেই, আছে শুধু সাফল্য আর ভালোবাসার প্রশান্তি। আরিক সেই কফির গন্ধ পেল, সেই পরিচিত, comforting গন্ধ। সে শ্রেয়ার হাতের উষ্ণতা অনুভব করল। এই সুখ, এই সাফল্য ছিল নিখুঁত, বাস্তব। আরিক এক মুহূর্তের জন্য ভুলে গিয়েছিল সে কোথায় আছে। তার মন মরিয়া হয়ে এই সুন্দর মিথ্যার জগতে ডুবে যেতে চেয়েছিল। আর ঠিক তখনই, শ্রেয়া তার ব্যূহের দ্বিতীয় স্তর তৈরি করল। সে বুঝতে পারছিল, সত্তাটি আরিককে মিথ্যা সুখের লোভ দেখাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে সে প্রেরণ করল মানব সভ্যতার আরেক শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি—শিল্প। তার মাথার ভেতরে বাজছিল না, সে সত্তাটির চেতনার দিকে প্রেরণ করছিল বাখের এক জটিল ফিউগের গঠন—তার প্রতিটি নোটের গাণিতিক শুদ্ধতা। এই সুরের জটিল, সুন্দর প্যাটার্নগুলো ছিল সত্তাটির তৈরি করা সস্তা, আবেগঘন বিভ্রমের ঠিক বিপরীত। এটা ছিল এক মানসিক যুদ্ধ—মিথ্যা সুখের বিরুদ্ধে শৈল্পিক সত্যের লড়াই। আরিকের চারপাশের সেই বিভ্রমের জগৎটা কাঁচের মতো ভেঙে গেল। সে আবার ফিরে এল গুহার সেই ঠাণ্ডা, স্যাঁতসেঁতে বাস্তবতায়। এই আশা আর হতাশার ভয়ঙ্কর চক্র আরিকের মানসিক শক্তিকে তিলে তিলে ক্ষয় করে দিচ্ছিল। সে বুঝতে পারছিল, সত্তাটি তাকে মারতে চাইছে না, চাইছে তার ইচ্ছাশক্তিকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিতে। সত্তাটি এবার আরও মরিয়া হয়ে উঠল। সে বুঝতে পারছিল, এই মেয়েটি, এই ক্ষুদ্র মানুষটি, তার হাজার বছরের পুরনো বিশৃঙ্খলার সামনে যুক্তির এক দেওয়াল তৈরি করে দাঁড়িয়েছে। সে গুহার বাস্তবতাকে প্রভাবিত করতে শুরু করল। তাদের চারপাশের দেওয়ালগুলো কাঁপতে লাগল, গুহার গঠনটা যেন গলে যাচ্ছিল, জ্যামিতির নিয়মগুলো ভেঙে পড়ছিল। কিন্তু শ্রেয়া প্রস্তুত ছিল। সে তার ব্যূহের শেষ এবং সবচেয়ে শক্তিশালী স্তরটা তৈরি করল। সে আবৃত্তি করছিল জ্যামিতির স্বতঃসিদ্ধগুলো, "দুটি বিন্দুর মধ্যে সরলরেখাই হলো ক্ষুদ্রতম দূরত্ব... একটি বৃত্তের পরিধি তার ব্যাসের অনুপাতের সমান, যা হলো পাই..."—এই সহজ, অকাট্ট সত্যগুলো ছিল সেই ভৌতিক জগতের বিরুদ্ধে তার চাবুক। সে তার মনের ভেতরে আঁকছিল নিখুঁত বৃত্ত, ত্রিভুজ, বর্গক্ষেত্র—এই শৃঙ্খলাবদ্ধ আকারগুলো সত্তাটির তৈরি করা বিশৃঙ্খল বাস্তবতার বিরুদ্ধে এক মানসিক বর্ম তৈরি করল। কিন্তু এই যুদ্ধের মূল্য ছিল ভয়ঙ্কর। শ্রেয়ার নাক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। তার নিজের স্মৃতিগুলো আবছা হয়ে আসছিল, তার চিন্তার শৃঙ্খলা হারিয়ে যাচ্ছিল। সে আর শ্রেয়া থাকছে না, পরিণত হচ্ছিল এক বিশুদ্ধ ধারণার প্যাকেজে। আর আরিক, প্রতিটি মানসিক আক্রমণের সাথে সাথে তার সত্তার এক একটি অংশ হারিয়ে ফেলছিল। তারা দুজনে মিলে এক ভাঙাচোরা কিন্তু দৃঢ় ব্যূহ তৈরি করে রেখেছিল, যা যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারত। এবং তখন, সত্তাটি তার শেষ এবং সবচেয়ে নিষ্ঠুর চালটা চালল। সে বুঝতে পারল, সে আরিককে ভাঙতে পারবে না, যতক্ষণ শ্রেয়া তাকে রক্ষা করছে। তাই, শিকারি তার সহজ শিকারকে বেছে নিল। হঠাৎ করেই, আরিকের ওপর থেকে মানসিক চাপটা পুরোপুরি উধাও হয়ে গেল। সে হাঁপাতে হাঁপাতে চোখ খুলল। গুহার নিস্তব্ধতা ফিরে এসেছে। সে দেখল, শ্রেয়া তার পাশে বসে আছে, চোখ বন্ধ। কিন্তু শ্রেয়ার শান্ত মুখটা হঠাৎই যন্ত্রণায় কুঁচকে গেল। তার গোটা শরীরটা শক্ত হয়ে গেল। সত্তাটি আরিককে ছেড়ে, তার সমস্ত ভয়ঙ্কর, বিধ্বংসী মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছিল শ্রেয়ার ওপর। ব্যূহের রক্ষকই এখন আক্রান্ত। শ্রেয়া অনুভব করল, সত্তাটি আর তার যুক্তির দুর্গে আঘাত হানছে না। সে সেই দুর্গ তৈরির উৎসকে আক্রমণ করছে। সত্তাটি প্রবেশ করল তার স্মৃতির গভীরে, তার সবচেয়ে সুরক্ষিত, সবচেয়ে পবিত্র জায়গায়। শ্রেয়া দেখল, সে তার বাবার পড়ার ঘরে দাঁড়িয়ে আছে। বইয়ের গন্ধ, পড়ন্ত বিকেলের আলো—সবকিছু নিখুঁত। তার বাবা তার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। কিন্তু যখন তিনি কথা বলার জন্য মুখ খুললেন, তখন তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল সেই সত্তাটির প্রাচীন, হিসহিসে কণ্ঠস্বর। আর তার বাবার চোখ দুটো... সেগুলো আর তার বাবার চোখ ছিল না। ছিল দুটো জমাট বাঁধা অন্ধকারের কুয়ো। শ্রেয়ার মানসিক ব্যূহ এক মুহূর্তে বালির ঘরের মতো ভেঙে পড়ল। তার শেষ আশ্রয়, তার শক্তির উৎস, সেটাও এখন এক ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। তার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বেরোল না। কিন্তু তার মনের ভেতরে, তার আত্মার প্রতিটি কণা একযোগে আর্তনাদ করে উঠল। আর গুহার ভেতরে, আরিক দেখল, শ্রেয়ার চোখ দিয়ে জলের ধারার বদলে গড়িয়ে পড়ছে এক ফোঁটা গাঢ়, কালো রক্ত।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion