Episode 3635 words0 views

মানচিত্রের বাইরে : তৃতীয় পর্ব

সুড়ঙ্গের মতো পথ ধরে তারা যত ভেতরে এগোতে লাগল, বাইরের পৃথিবীর সাথে তাদের যোগাযোগ ততই ক্ষীণ হতে শুরু করল। বাতাসের চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, একটা ভ্যাপসা, পুরনো গন্ধ নাকে আসছিল—যেন ভেজা মাটি আর পচা পাতার গন্ধ। হঠাৎই তাদের চারজনেরই কানে একটা অদ্ভুত চাপ অনুভব হলো, যেমনটা প্লেন টেক-অফ করার সময় হয়। তাপমাত্রাটাও যেন কয়েক ডিগ্রি কমে গেল। প্রায় এক ঘণ্টা ওই claustrophobic পথ ধরে হাঁটার পর হঠাৎই জঙ্গলটা শেষ হয়ে গেল। তারা খোলা জায়গায় এসে দাঁড়াল এবং যা দেখল, তাতে তাদের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। তাদের সামনে একটা আস্ত গ্রাম। মাটির দেওয়াল, খড়ের চাল, ভাঙা দালান, মাঝখান দিয়ে সরু রাস্তা—কিন্তু সবকিছু কেমন যেন স্থির, নিথর। যেন কেউ একটা গোটা গ্রামের ছবি এঁকে তাতে ধূসর রঙ ঢেলে দিয়েছে। সবচেয়ে অদ্ভুত হলো এর নিখুঁত সংরক্ষণ। ঘরবাড়িগুলো পুরনো, কিন্তু ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়নি। যেন বাসিন্দারা এই গতকালই গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। আর আলো! এখানের দিনের আলোটাও কেমন যেন ফ্যাকাসে, নিষ্প্রভ। যেন সূর্যের তেজ এই গ্রামের সীমানায় এসে দমে যায়। এবং সেই নিস্তব্ধতা। কোনো মানুষের সাড়া নেই, পশুর ডাক নেই, পাখির কিচিরমিচির নেই। একটা পাতা পড়ার শব্দও কান পর্যন্ত আসছে না। “এটা… এটা শ্যামলগড়,” আরিকের গলাটা উত্তেজনায় কাঁপছিল। “আমরা পেরেছি!” তারা সাবধানে গ্রামে প্রবেশ করল। প্রথম ঘরটার সামনে এসে তারা দেখল দরজাটা হাট করে খোলা। ভেতরে উঁকি দিতেই দেখল, মেঝেতে একটা কাঁসার থালা রাখা, তাতে শুকিয়ে যাওয়া ভাতের দানা। ভাতের চারপাশে কয়েকটা মরা পিঁপড়ের সারি, যারা খাবারের কাছে এসে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে জমে পাথর হয়ে গেছে। একটা দোলনার ওপর কাপড়ের পুতুল, যার চোখ দুটো সরাসরি দরজার দিকে ফেরানো, যেন সে তাদের প্রবেশের অপেক্ষায় ছিল। দেওয়ালে এক শিশুর হাতের ছাপ। জীবন এখানে হঠাৎ করেই থেমে গেছে। কিন্তু কেন? জয় ড্রোন ওড়াল। ড্রোনের ক্যামেরায় পুরো গ্রামটা ধরা পড়ল। গ্রামের গঠনটা অদ্ভুত, গোলকধাঁধার মতো। রাস্তাগুলো এমনভাবে একে অপরকে জড়িয়েছে যে বেরোনোর পথ খুঁজে পাওয়া কঠিন। গ্রামের ঠিক মাঝখানে একটা বড়, দ্বিতল দালান—একটা পুরনো নাটমন্দির। “আমাদের বেস ক্যাম্প ওখানেই হবে,” আরিক বলল। নাটমন্দিরে পৌঁছে তারা তাদের জিনিসপত্র রাখল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই গ্রামের ওপর একটা অপার্থিব, ছাইরঙা চাদর নেমে এল। দিনের বেলার অস্বস্তিকর নিস্তব্ধতা রাতের বেলা যেন আরও ভয়ঙ্কর, আরও জীবন্ত হয়ে উঠল। তারা ক্যাম্পফায়ার জ্বালিয়ে তার চারপাশে বসল। হঠাৎ জয় তার ক্যামেরার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ফ্যাকাসে মুখে বলল, “গাইজ… লুক অ্যাট দিস।” সে ক্যামেরার প্লে-ব্যাক অন করল। দিনের বেলায় তোলা একটা ফুটেজ। একটা ঘরের ভাঙা জানালার দিকে জুম করতেই দেখা গেল, কয়েক ফ্রেমের জন্য জানালার জমাট অন্ধকারে একটা আবছা, মানুষের মতো অবয়ব ফুটে উঠে আবার মিলিয়ে গেল। এতটাই দ্রুত যে খালি চোখে বোঝার উপায় নেই। ঠিক সেই মুহূর্তে দূর থেকে সেই শব্দটা ভেসে এল। ডায়েরিতে লেখা সেই সুর। এক মহিলার গলায় গাওয়া এক করুন, বিষণ্ণ আর পুনরাবৃত্তিমূলক ঘুমপাড়ানি গান। সুরটা কোনো নির্দিষ্ট দিক থেকে আসছিল না, আসছিল সবদিক থেকে—মাটি ফুঁড়ে, গাছের পাতা থেকে, পুরনো দেওয়াল থেকে। সেই সুরে কোনো শব্দ ছিল না, ছিল শুধু অন্তহীন আর্তি। চারজনে একসাথে উঠে দাঁড়াল। তারা বুঝতে পারছিল, এই গ্রামে তারা একা নয়। শ্যামলগড়ের আসল রহস্যের দরজা সবে খুলতে শুরু করেছে। আরিক তার ফোন বের করল। ‘No Service’। শ্রেয়া স্যাটেলাইট ফোনটা অন করল। স্ক্রিনে কয়েক মুহূর্ত ডেটা খোঁজার চেষ্টা করার পর একটা লাল রঙের বার্তা ভেসে উঠল: “GEOSYNCHRONIZATION FAILED. UNKNOWN TERRITORY.” “অজানা এলাকা…” শ্রেয়ার গলা শুকিয়ে কাঠ। “এর মানে আমরা এমন কোথাও আছি যা পৃথিবীর কোনো স্যাটেলাইটের রেকর্ডে নেই।” এই ভয়ঙ্কর সত্যটা বোঝার সাথে সাথে আরিক দৌড়ে জঙ্গলের সেই প্রবেশপথটার দিকে গেল। সে টর্চের আলো ফেলে মরিয়া হয়ে খুঁজতে লাগল। কিন্তু সেখানে দুর্ভেদ্য জঙ্গল ছাড়া কিছুই ছিল না। সে তার নিজের হাতে আগাছা সরিয়েছিল, কিন্তু এখন সেখানে বহু বছরের পুরনো কাঁটা ঝোপ এমনভাবে জন্মে আছে যেন কেউ কোনোদিন তা স্পর্শও করেনি। সে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করল, কিন্তু তার শব্দ প্রতিধ্বনিত না হয়ে যেন ভারী বাতাসে শোষিত হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর সে ফিরে এল। তার মুখটা ছিল একজন পরাজিত সেনাপতির মতো। তার চোখের দিকে তাকিয়েই বাকিরা বুঝে গেল। পথটা আর নেই। তারা এক ভৌতিক ফাঁদে আটকে পড়েছে। যে গ্রামের কোনো অস্তিত্ব মানচিত্রে নেই, সেই গ্রাম থেকে বেরোনোর পথও হয়তো তাদের জন্য আর অবশিষ্ট নেই। (চলবে)

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion