Episode 21803 words2 views

অধ্যায় ২১: প্রতিবিম্বের মুখোমুখি

জয় আর রিয়া যখন দালানের বাইরে এসে দাঁড়াল, তখন তাদের মনে হলো তারা যেন এক ভিন্ন জগতে এসে পড়েছে। গুহার ভেতরের সেই ভয়ঙ্কর চাপ, সেই শব্দ—বাইরে তার কিছুই ছিল না। গ্রামটা ছিল আগের মতোই নিস্তব্ধ, শীতল। গ্রামের ছায়া-আত্মারা উধাও। মনে হচ্ছিল, তারা সবাই তাদের মনিবের ডাকে গুহার ভেতরে জমায়েত হয়েছে। তারা দরজার চৌকাঠের কাছে দেখল তাদের। তাদের চারটি ছায়া। তারা আর আগের মতো আতঙ্কিত ছিল না। তারা একসাথে জড়োসড়ো হয়ে বসেছিল, যেন একদল বিভ্রান্ত, পথ হারানো শিশু। তাদের মালিকদের দেখে তারা নড়ে উঠল, কিন্তু এগিয়ে এল না। তাদের ভঙ্গিতে ছিল ভয় আর অবিশ্বাসের মিশ্রণ। "কী করব আমরা?" জয়ের গলা কাঁপছিল। রিয়া এক মুহূর্তের জন্য দ্বিধা করল। সে ছিল দলের মুখ, যার কাজই হলো সংযোগ স্থাপন করা। কিন্তু কীভাবে সে নিজেরই আত্মার এক বিচ্ছিন্ন অংশের সাথে কথা বলবে? সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। সে তার নিজের ছায়াটার সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। সে কোনো যুক্তি দিয়ে কথা বলল না। সে কথা বলল তার মন থেকে। "আমি জানি তোমরা ভয় পেয়েছ," সে ফিসফিস করে বলল। "আমরাও পেয়েছি। কিন্তু আরিক আর শ্রেয়া ভেতরে বিপদে আছে। আমরা যদি একসাথে না হই, তাহলে আমরা সবাই শেষ হয়ে যাব। আমি জানি আমরা তোমাদের কষ্ট দিয়েছি, তোমাদের বিরুদ্ধে গেছি... আমি দুঃখিত।" তার শেষ দুটো শব্দে কোনো অভিনয় ছিল না। ছিল অনুশোচনা। তার ছায়াটা নড়ে উঠল। বাকি ছায়াগুলোও তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। জয় বুঝতে পারল, এটা শুধু কথার বিষয় নয়। এটা সংযোগের বিষয়। সে তার ক্যামেরাটা নিচে রেখে, ধীরে ধীরে তার হাতটা বাড়াল। "আমাদের তোমাদের দরকার," সে বলল। রিয়াও তার হাত বাড়াল। তাদের ছায়াগুলো কিছুক্ষণ স্থির হয়ে রইল। তারপর, খুব ধীরে, যেন এক অনন্তকালের দ্বিধা কাটিয়ে, রিয়ার ছায়াটা তার ছায়া-হাতটা বাড়াল। জয়ের ছায়াটাও তাই করল। দরজার চৌকাঠটা ছিল দুই জগতের সীমানা। একদিকে ছিল জয় আর রিয়ার শরীর, আরেকদিকে ছিল তাদের ছায়া। বাস্তব আর প্রতিবিম্বের জগৎ। তাদের আঙুলের ডগা আর ছায়া-আঙুলের ডগা যখন একে অপরকে স্পর্শ করল— এক তীব্র বৈদ্যুতিক শক তাদের সারা শরীরে খেলে গেল। জয় আর রিয়া যন্ত্রণায় এবং এক অদ্ভুত প্রাপ্তির আনন্দে চিৎকার করে উঠল। তাদের মনে হলো, তাদের শরীরের সেই অস্বাভাবিক হালকা ভাবটা চলে গেছে। মাটির সাথে তাদের সংযোগ আবার ফিরে এসেছে। তারা আবার সম্পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু তার সাথে সাথে এল একটা জিনিস। তাদের ছায়াদের সঞ্চিত ভয়, গুহার সেই উৎসের প্রতি তাদের আদিম আতঙ্ক—সেই অনুভূতিটাও এখন তাদের নিজেদের। তারা এখন শুধু তাদের নিজেদের ভয় নয়, অনুভব করতে পারছিল তাদের আত্মার অন্য অংশের ভয়কেও। এই দ্বিগুণ ভয় আর নতুন করে পাওয়া সম্পূর্ণতার অনুভূতি নিয়ে তারা উঠে দাঁড়াল। তারা জানত, তাদের কী করতে হবে। তারা তাদের বন্ধুদের মৃত্যুর মুখে ফেলে রেখে পালিয়ে যাওয়ার জন্য আসেনি। তারা এসেছিল শক্তি সঞ্চয় করে আবার ফিরে যাওয়ার জন্য। নতুন করে অ্যাঙ্কর্ড, কিন্তু দ্বিগুণ ভয়ে ভারাক্রান্ত হয়ে, জয় আর রিয়া আবার সেই নরকের দরজার দিকে ঘুরে তাকাল, যার ভেতর থেকে ভেসে আসছিল শ্রেয়ার যন্ত্রণার নীরব আর্তনাদ। তাদের আরোহন শেষ হয়েছিল। এবার শুরু হবে তাদের অবতরণ, শেষ যুদ্ধের জন্য। এই পুনর্মিলনের মুহূর্তটা ছিল এক কথায় অবর্ণনীয়। যখন তাদের আঙুলের ডগা তাদের ছায়ার অস্তিত্বকে স্পর্শ করল, তখন জয় আর রিয়ার মনে হলো, তাদের শরীরের প্রতিটি কোষে যেন এক শীতল আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। তারা অনুভব করল তাদের ছায়াদের প্রতিটি মুহূর্তের ভয়—সেই প্রথম বিচ্ছেদের যন্ত্রণা, দালানের বাইরে একা পরিত্যক্ত হয়ে থাকার আতঙ্ক, আর সবচেয়ে তীব্রভাবে, সেই দালানের ভেতরকার সত্তাটির প্রতি এক আদিম, শর্তহীন ভয়। তারা বুঝতে পারল, তাদের ছায়ারা তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। তারা শুধু বাঁচার চেষ্টা করছিল। এই উপলব্ধির সাথে সাথে তাদের ভেতরের ভয়টা এক নতুন রূপ নিল। এটা আর শুধু নিজেদের জীবন বাঁচানোর ভয় ছিল না। এটা ছিল তাদের বন্ধুদের বাঁচানোর দায়িত্ব, আর তাদের নিজেদেরই আত্মার এক বিচ্ছিন্ন অংশকে রক্ষা করার এক অদ্ভুত তাগিদ। "শ্রেয়া..." রিয়া ফিসফিস করে বলল, তার চোখ দুটো ছিল দালানের অন্ধকারের দিকে। সে এখন শুধু তার নিজের কানে নয়, তার আত্মার গভীরেও শ্রেয়ার মানসিক আর্তনাদটা অনুভব করতে পারছিল। জয় তার টর্চটা তুলে নিল। তার হাতটা আর কাঁপছিল না। তার চোখে ছিল এক নতুন, শীতল সংকল্প। সে আর সেই ভীতু ছেলেটা ছিল না, যে বিপদের সময় ক্যামেরার পেছনে লুকাত। সে এখন এক যোদ্ধা, যার কাঁধে তার বন্ধুদের এবং নিজেরই আত্মার এক অংশের ভার। তারা একে অপরের দিকে তাকাল। কোনো কথা বলার প্রয়োজন ছিল না। তাদের দুজনের মনেই ছিল একই চিন্তা। আমাদের ফিরে যেতে হবে। এই চিন্তাটা ছিল ভয়ঙ্কর। তাদের শরীরের প্রতিটি কোষ, যা এখন তাদের ছায়াদের ভয় দিয়ে পরিপূর্ণ, তারা সেই দালানের ভেতরে ফিরে যাওয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছিল। তাদের মনে হচ্ছিল, তারা যেন এক জ্বলন্ত চুল্লির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আরিক আর শ্রেয়ার মুখগুলো তাদের চোখের সামনে ভাসছিল। তাদের আত্মত্যাগের কথা মনে পড়তেই, তাদের ভয়টা একপাশে সরে গিয়ে জায়গা করে দিল এক তীব্র, মরিয়া ভালোবাসাকে। তারা ঘুরে দাঁড়াল। তাদের পেছনে ছিল শ্যামলগড়ের ফ্যাকাসে, ভৌতিক জগৎ। আর সামনে ছিল সেই দালানের জমাট বাঁধা অন্ধকার—এক নরকের প্রবেশদ্বার। তারা জানত, তারা যা করতে চলেছে, তা হয়তো তাদের জীবনের শেষ কাজ হতে চলেছে। কিন্তু তারা এটাও জানত, এটা না করে তাদের কোনো মুক্তি নেই। একসাথে, একযোগে, তারা সেই দালানের দোরগোড়ায় পা রাখল—এবার আর ছায়াহীন, বিচ্ছিন্ন সত্তা হিসেবে নয়, বরং এক সম্পূর্ণ, দ্বিখণ্ডিত কিন্তু দৃঢ় অস্তিত্ব হিসেবে, যারা তাদের বন্ধুদের বাঁচানোর জন্য স্বেচ্ছায় আবার সেই অভিশাপের হৃদপিণ্ডে প্রবেশ করতে চলেছে।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion