সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে জয় আর রিয়া এক মুহূর্তের জন্য দ্বিধা করল। তাদের সামনে ছিল সেই ঘোরানো, অন্তহীন সিঁড়ি—যা দিয়ে তারা একটু আগেই পালিয়ে এসেছিল। কিন্তু এখন সেই পথটাকেই মনে হচ্ছিল এক অচেনা, ঊর্ধমুখী নরক নয়, বরং এক স্বেচ্ছায় বেছে নেওয়া সমাধি। তাদের শরীর আর ছায়ার পুনর্মিলনের ফলে যে সম্পূর্ণতা এসেছিল, তার সাথে এসেছিল এক দ্বিগুণ ভয়। তাদের নিজেদের ভয় আর তাদের ছায়াদের আদিম, শর্তহীন ভয়—এই দুই মিলে তাদের চেতনাকে গ্রাস করার উপক্রম করছিল।
"আমাদের পারতেই হবে," জয় ফিসফিস করে বলল, যদিও কথাটা সে রিয়াকে নয়, নিজেকেই বেশি করে বলছিল। তার কণ্ঠস্বর কাঁপছিল, কিন্তু তার মধ্যে ছিল এক নতুন দৃঢ়তা। সে আর সেই ভীতু ছেলেটা ছিল না, যে বিপদের সময় ক্যামেরার পেছনে লুকাত। সে এখন এক যোদ্ধা, যার কাঁধে তার বন্ধুদের এবং নিজেরই আত্মার এক অংশের ভার।
রিয়া কোনো উত্তর দিল না, শুধু জয়ের হাতটা আরও শক্ত করে ধরল। তার মনের ভেতরে তখন শ্রেয়ার যন্ত্রণাকাতর মুখটা ভাসছিল। সেই মুখটাই ছিল তার চালিকাশক্তি।
তারা সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা রাখল।
আর সাথে সাথেই সেই ভয়ঙ্কর অনুভূতিটা ফিরে এল। কিন্তু এবার অন্যভাবে। আগেরবার সিঁড়িটা তাদের বিরুদ্ধে ছিল, তাদের পথ আটকাতে চেয়েছিল। এবার যেন গোটা দালানটা, গোটা অভিশাপটা তাদের এই স্পর্ধা দেখে অবাক হয়েছিল। সিঁড়িটা আর ভৌত বাধা তৈরি করছিল না, করছিল মানসিক।
প্রতিটি ধাপে নামার সাথে সাথে তাদের মনে হচ্ছিল, তারা যেন এক শীতল, আঠালো সমুদ্রের গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে। গুহার সেই একটানা মন্ত্রোচ্চারণের শব্দ এখন আর শুধু তাদের কানে বাজছিল না, বাজছিল তাদের হাড়ের মজ্জায়, তাদের আত্মার গভীরে। তাদের ছায়ারা, যা এখন তাদের শরীরের সাথে আবার জুড়ে গেছে, তারা যেন ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছিল। জয় আর রিয়া অনুভব করতে পারছিল, তাদের ছায়াগুলো পেছনের দিকে যাওয়ার জন্য, সিঁড়ি দিয়ে আবার ওপরে উঠে যাওয়ার জন্য আকুতি করছে। এই অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েন তাদের প্রতিটি পদক্ষেপকে এক দুঃসাধ্য কাজে পরিণত করছিল।
জয় তার টর্চটা সামনে ফেলে পথ দেখছিল। কিন্তু এই পুনর্মিলনের পর তার দৃষ্টিশক্তিও যেন বদলে গিয়েছিল। সে এখন শুধু টর্চের আলোয় পথ দেখছিল না। তার ছায়ার মাধ্যমে, সে যেন দেওয়ালের পাথরের ভেতরের শীতলতা, বাতাসের ভেতরের স্থির বিদ্যুৎ—সবকিছু অনুভব করতে পারছিল। তার মনে হচ্ছিল, সিঁড়ির দেওয়ালের গায়ে মিশে থাকা ছায়া-আত্মাগুলোর নীরব আর্তনাদ সে শুনতে পাচ্ছে।
"ওরা... ওরা কষ্ট পাচ্ছে," রিয়া ফিসফিস করে বলল। তার চোখ দুটো ছিল দেওয়ালের দিকে। সে ছায়া-আত্মাগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল। পুনর্মিলনের পর তার অনুভূতিপ্রবণ মনটা যেন আরও সংবেদনশীল হয়ে উঠেছিল। সে এখন আর শুধু বিকৃত ছায়া দেখছিল না, দেখছিল তাদের পেছনের মানুষগুলোকে। সে দেখছিল এক কৃষকের ক্লান্ত ছায়া, এক মায়ের তার হারানো সন্তানের জন্য হাহাকার করা ছায়া, এক শিশুর বিভ্রান্ত ছায়া। এই শত শত বছরের পুরনো যন্ত্রণা তার নিজের বুকের ভেতর চেপে বসছিল।
"ওদের দিকে তাকিও না, রিয়া," জয় কঠোর গলায় বলল। "মনটাকে শক্ত রাখো। আমরা শ্রেয়া আর আরিকের জন্য যাচ্ছি।"
তারা যত নিচে নামছিল, গুহার ভেতর থেকে ভেসে আসা মানসিক চাপটা ততই বাড়ছিল। তাদের মনে হচ্ছিল, যেন এক অদৃশ্য হাত তাদের মাথাটা চেপে ধরে গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। জয়ের কাঁধের সেই পুরনো যন্ত্রণাটা আবার ফিরে এল, আর রিয়ার মনে হতে লাগল, তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।
কিন্তু তারা থামল না।
তারা এখন আর শুধু নিজেদের শক্তি দিয়ে চলছিল না। তারা চলছিল একে অপরের শক্তির ওপর ভর করে। জয়ের হাতের দৃঢ় বন্ধন রিয়াকে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়তে দিচ্ছিল না, আর রিয়ার হাতের উষ্ণতা জয়কে তার শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করার শক্তি দিচ্ছিল।
অবশেষে, তারা সিঁড়ির শেষ বাঁকে এসে পৌঁছল। নিচের গুহার দৃশ্যটা তাদের সামনে উন্মোচিত হলো।
দৃশ্যটা ছিল এক কথায় নারকীয়।
গুহার মাঝখানে, সেই অভিশপ্ত কুয়োর সামনে, আরিক এক হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে বসেছিল, তার শরীরটা কাঁপছিল। সে তার দু-হাত দিয়ে শ্রেয়াকে আগলে রেখেছিল, যে প্রায় অচৈতন্য অবস্থায় মাটিতে পড়েছিল। শ্রেয়ার শরীরটা মাঝে মাঝে খিঁচুনির মতো কেঁপে উঠছিল, আর তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছিল অস্ফুট গোঙানির শব্দ।
আর তাদের চারপাশে, সেই শত শত ছায়া-আত্মার দল এক উন্মত্ত, নীরব ঘূর্ণিঝড়ের মতো পাক খাচ্ছিল। তারা এগিয়ে আসছিল না, কিন্তু তাদের আবর্তনের সাথে সাথে গুহার বাতাস থেকে যেন সমস্ত শক্তি শুষে নেওয়া হচ্ছিল।
জয় আর রিয়া বুঝতে পারল, তারা একদম শেষ মুহূর্তে এসে পৌঁছেছে। তারা দেখল, শ্রেয়ার শরীর থেকে এক ক্ষীণ, কাঁপতে থাকা সাদা আভা বেরিয়ে আসছে—তার মানসিক ব্যূহের শেষ চিহ্ন। আর কুয়োর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা কালো ধোঁয়ার টেনট্যাকলগুলো সেই আভাকে বারবার আঘাত করছে, তাকে ভেঙে ফেলার চেষ্টা করছে।
এই দৃশ্যটা তাদের ভেতরের সমস্ত ভয়কে একপাশে সরিয়ে দিল। তার জায়গায় এল এক তীব্র, মরিয়া ক্রোধ।
তারা আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করল না। তারা সিঁড়ির শেষ ধাপ থেকে লাফিয়ে পড়ল গুহার পাথুরে মেঝেতে, তৈরি হলো তাদের বন্ধুদের বাঁচানোর জন্য তাদের জীবনের শেষ এবং সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যুদ্ধটা লড়ার জন্য।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion