Episode 23782 words2 views

অধ্যায় ২৩: ব্যূহের পতন

শ্রেয়ার জন্য, বাস্তবতা বলে আর কিছু ছিল না। গুহার শীতল, স্যাঁতসেঁতে দেওয়াল, পাথরের মেঝেতে পড়ে থাকা আরিকের যন্ত্রণাকাতর শরীর, কুয়োর গভীর থেকে ভেসে আসা একটানা গুঞ্জন—সবকিছু এক দূরবর্তী, আবছা প্রতিধ্বনিতে পরিণত হয়েছিল। সে তার নিজের মনের ভেতরেই এক কারাগারে বন্দি হয়ে গিয়েছিল। এই কারাগারের দেওয়াল ছিল তার ভেঙে পড়তে থাকা যুক্তি, আর এর প্রহরী ছিল তার সবচেয়ে বড় শক্তি, যা এখন তার বিরুদ্ধে এক ভয়ঙ্কর অস্ত্রে পরিণত হয়েছে। সত্তাটি তার যুক্তির ব্যূহকে এক ঝটকায় ভাঙেনি। সে করেছিল আরও ভয়ঙ্কর কিছু। সে সেই ব্যূহের ভেতরে প্রবেশ করে, তাকে ভেতর থেকে ক্ষয় করে দিচ্ছিল। শ্রেয়ার সবচেয়ে পবিত্র স্মৃতি—তার বাবার পড়ার ঘর—এখন ছিল এক নারকীয় মঞ্চ। তার চোখের সামনে আর গুহার অন্ধকার ছিল না। ছিল তার বাবার পড়ার ঘর। কিন্তু ঘরটা ছিল বিকৃত, এক দুঃস্বপ্নের প্রতিচ্ছবি। ঘরের জানলা দিয়ে বিকেলের সোনালী আলো নয়, আসছিল শ্যামলগড়ের সেই ফ্যাকাসে, প্রাণহীন ধূসর আলো। বইয়ের তাকগুলো, যা সবসময় বর্ণানুক্রমে সাজানো থাকত, সেগুলো এখন এলোমেলো, বইয়ের বাঁধাইগুলো থেকে যেন কালচে, আঠালো রস গড়িয়ে পড়ছিল। বইগুলোর নামগুলোও বদলে গিয়েছিল—‘সময়ের জ্যামিতি’, ‘শূন্যতার পদার্থবিদ্যা’, ‘স্মৃতির রসায়ন’। আর তার বাবা, তার জ্ঞানের উৎস, তার আদর্শ, তিনি তার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। তার পরনে ছিল সেই চেনা চেক্ শার্ট, মুখে ছিল সেই পরিচিত হাসি। কিন্তু তার চোখ দুটো ছিল জমাট বাঁধা অন্ধকারের কুয়ো, যা কোনো আলো প্রতিফলন করছিল না, শুধু শুষে নিচ্ছিল। আর তার মুখ দিয়ে যখন শব্দ বেরিয়ে এল, তখন সেটা ছিল তার বাবার কণ্ঠস্বর, কিন্তু তার প্রতিটি অক্ষরের নিচে বাজছিল সেই সত্তাটির প্রাচীন, হিসহিসে প্রতিধ্বনি। "যুক্তি একটা ভ্রাম, শ্রেয়া," সেই দ্বৈত কণ্ঠ বলছিল, যা ছিল স্নেহের মতো কিন্তু তার গভীরে ছিল বরফ-শীতল বিদ্রূপ। "নিয়ম হলো এক সীমাবদ্ধতা, যা তোমরা ক্ষুদ্র মানুষেরা নিজেদের সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য তৈরি করেছ। তুমি সত্য জানতে চেয়েছিলে। কিন্তু সত্য বিশৃঙ্খল, সত্য সুন্দর নয়। মহাবিশ্বের অন্তিম সত্য হলো বিশৃঙ্খলা, Entropy। সবকিছুই একদিন এই শান্ত, শীতল শূন্যতায় ফিরে আসবে। তোমার বিজ্ঞান, তোমার দর্শন, তোমার শিল্প—সবই এই অনিবার্য পরিণতির বিরুদ্ধে শিশুদের বালির ঘর তৈরি করার মতো নিষ্ফল প্রয়াস। এসো, এই বিশৃঙ্খলার সৌন্দর্যকে গ্রহণ করো। তোমার এই ক্ষুদ্র, সীমাবদ্ধ চেতনাকে বিসর্জন দাও, আর হয়ে ওঠো এক মহাজাগতিক সত্যের অংশ।" এই কথাগুলো ছিল বিষ। কারণ, এর মধ্যে ছিল এক ভয়ঙ্কর, বিকৃত যুক্তি। শ্রেয়া তার মনের সমস্ত শক্তি দিয়ে লড়াই করছিল। সে তার বাবার আসল মুখটা মনে করার চেষ্টা করছিল—তার চোখের কোণের বলিরেখা, তার হাসির উষ্ণতা, তার কফির কাপ ধরার ভঙ্গি। কিন্তু সে যতবারই সেই আসল স্মৃতিটা আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছিল, সত্তাটি ততবারই সেটাকে বিকৃত করে দিচ্ছিল। তার বাবার হাসির রেখাটা পরিণত হচ্ছিল এক ক্রূর, বিদ্রূপকারী হাসিতে। তার চোখের উষ্ণতা পরিণত হচ্ছিল কুয়োর শীতলতায়। সে তার নিজের স্মৃতির ওপর থেকেই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছিল। আরিক এই ভয়ঙ্কর মানসিক যুদ্ধটা দেখতে পাচ্ছিল না। সে শুধু দেখছিল এর শারীরিক প্রকাশ। সে দেখছিল, শ্রেয়ার শরীরটা নিস্তেজ হয়ে আসছে, তার নিঃশ্বাস ক্ষীণ হয়ে আসছে। শ্রেয়ার চোখের কোণ দিয়ে গড়িয়ে পড়া কালো রক্তের ধারাটা শুকিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তার ফ্যাকাসে মুখটা বলে দিচ্ছিল, সে ভেতর থেকে শেষ হয়ে যাচ্ছে। তার ত্বকের নিচে, কপালে আর গলায়, মুহূর্তের জন্য ফুটে উঠছিল কালচে শিরার জাল, যা আবার মিলিয়ে যাচ্ছিল—যেন ভেতরের অন্ধকারটা বাইরে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজছে। "শ্রেয়া! ফিরে আয়!" আরিক চিৎকার করছিল, শ্রেয়ার কাঁধ ধরে ঝাঁকাচ্ছিল। "আমার কথা শোন! ফাইট কর! মনে কর, কলেজ স্ট্রিট... বইয়ের গন্ধ... জয়ের বাজে জোকস... মনে কর, রিয়া...!" সে মরিয়া হয়ে তাদের বাস্তব জগতের টুকরো টুকরো স্মৃতি শ্রেয়ার দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছিল, যেন সেগুলো এক লাইফলাইন, যা দিয়ে সে শ্রেয়াকে এই মানসিক ঘূর্ণাবর্ত থেকে টেনে তুলতে পারবে। কিন্তু তার শব্দ শ্রেয়ার কাছে পৌঁছাচ্ছিল না। আরিক তার জীবনের সবচেয়ে চরম অসহায়ত্ব অনুভব করছিল। সে একজন নেতা, একজন রক্ষক। কিন্তু সে তার সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে রক্ষা করতে পারছিল না। সে মরিয়া হয়ে শ্রেয়ার শরীরটাকে টেনে কুয়ো থেকে দূরে সরিয়ে আনার চেষ্টা করল, তাকে নিজের শরীর দিয়ে আড়াল করার চেষ্টা করল, যেন তার শারীরিক উপস্থিতি সত্তাটির মানসিক আক্রমণকে বাধা দিতে পারবে। কিন্তু সে জানত, এটা একটা নিষ্ফল প্রয়াস। যুদ্ধটা শারীরিক ছিল না। সত্তাটি বুঝতে পারছিল, শ্রেয়ার প্রতিরোধ প্রায় শেষ। সে তার মানসিক আক্রমণের তীব্রতা বাড়াল। শ্রেয়ার মনের ভেতরে, তার বাবার বিকৃত মূর্তিটা এগিয়ে এসে তার কাঁধে হাত রাখল। সেই স্পর্শে কোনো উষ্ণতা ছিল না, ছিল কবরের শীতলতা। শ্রেয়ার মনে হলো, তার ‘আমি’ বলে যে সত্তাটা, সেটা ধীরে ধীরে গলে যাচ্ছে, মিশে যাচ্ছে এক বিশাল, শীতল, তারাহীন মহাবিশ্বের সাথে। তার চিন্তাভাবনাগুলো আর শব্দ বা বাক্যের আকারে ছিল না, হয়ে গিয়েছিল বিচ্ছিন্ন অনুভূতি—ঠান্ডা... ভারহীন... একা...। সে তার নাম ভুলে যাচ্ছিল, তার বন্ধুদের মুখ ভুলে যাচ্ছিল। তার সামনে ছিল শুধু এক অন্তহীন, শান্তিপূর্ণ শূন্যতা, যা তাকে আত্মসমর্পণের জন্য আহ্বান জানাচ্ছিল। তার শেষ প্রতিরোধটুকুও ভেঙে পড়ছিল। আরিক দেখল, শ্রেয়ার শরীরটা শেষবারের মতো একবার কেঁপে উঠল। তার মাথাটা একপাশে ঢলে পড়ল। তার বুকটা, যা এতক্ষণ ওঠানামা করছিল, সেটা স্থির হয়ে গেল। এক মুহূর্ত। দুই মুহূর্ত। তিন মুহূর্ত। কোনো নিঃশ্বাস নেই। তার মুখটা হয়ে গিয়েছিল এক শান্ত, সাদা পাথরের মতো। আরিকের মনে হলো, গোটা মহাবিশ্ব স্তব্ধ হয়ে গেছে। শ্রেয়া চলে গেছে। সে হেরে গেছে। তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল এক ভয়ঙ্কর, পরাজিত, পশুসুলভ আর্তনাদ, যা গুহার দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে মিলিয়ে গেল।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion