Episode 4946 words0 views

মানচিত্রের বাইরে : চতুর্থ পর্ব

আরিক যখন ফিরে এল, তার চেহারাটা ছিল একজন নাবিকের মতো যে দিগন্তে কিনারা খুঁজতে গিয়ে দেখে এসেছে পৃথিবীটা আসলে সপাট এবং সে তার কিনারা থেকে পড়ে যাওয়ার ভয়ে ফিরে এসেছে। তার চোখেমুখে আর জেদ বা উত্তেজনা ছিল না, ছিল এক গভীর, অতলান্ত শূন্যতা যা তার উচ্চাকাঙ্ক্ষী সত্তাটাকে গিলে ফেলেছে। সে কোনো কথা না বলে নাটমন্দিরের চাতালে ধপ করে বসে পড়ল, তার শরীরটা যেন তার ভেতরের সমস্ত শক্তি আর আশার ভারে ভেঙে পড়েছে। তার এই নীরবতাই ছিল হাজারটা চিৎকারের চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর। রিয়া এতক্ষণ যে সাহসের দেওয়াল তুলে রেখেছিল, তা এক মুহূর্তে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল। তার ঠোঁট কাঁপছিল, কিন্তু কোনো শব্দ বেরোচ্ছিল না। শুধু তার চোখ দিয়ে নিঃশব্দে জল গড়িয়ে পড়ছিল—ভয়ের নয়, সম্পূর্ণ অসহায়ত্বের অশ্রু। জয় তার ক্যামেরাটাকে বুকের কাছে এমনভাবে আঁকড়ে ধরেছিল, যেন ওটাই এই অচেনা, যুক্তিহীন বিশ্বে তার একমাত্র চেনা বস্তু, তার বাস্তবতার শেষ নোঙর। সে বারবার ক্যামেরার পাওয়ার অন করে ভিউফাইন্ডারে চোখ রাখছিল, যেন লেন্সের মধ্যে দিয়ে দেখলে এই ভয়ঙ্কর বাস্তবতাটা বদলে যাবে, একটা সিনেমার দৃশ্যে পরিণত হবে, যার শেষে ‘কাট’ বলার সুযোগ থাকবে। শ্রেয়া এগিয়ে এসে আরিকের কাঁধে হাত রাখল। “এখন ভেঙে পড়লে চলবে না, আরিক। আমাদের মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে।” মাথা ঠান্ডা রাখা— কথাটা বলা যত সহজ, এই পরিস্থিতিতে তা পালন করা ছিল প্রায় অসম্ভব। তাদের একমাত্র ভরসা ছিল ক্যাম্পফায়ারের আগুন। আগুনের হলদে-কমলা আভা তাদের চারপাশে একটা অস্থায়ী, কাঁপতে থাকা নিরাপত্তার বলয় তৈরি করেছিল। কিন্তু সেই আগুনের শিখাগুলোও যেন আজ গ্রামের এই অপার্থিব নিয়ম মেনে চলছিল না। সেগুলো স্থিরভাবে জ্বলছিল না, বরং পাগলের মতো নাচছিল, আর তাদের ছায়াগুলোকে দেওয়ালের গায়ে একেকটা দানবের মতো করে ফুটিয়ে তুলছিল। আগুনের বৃত্তের বাইরের জমাট অন্ধকারকে মনে হচ্ছিল এক কালো সমুদ্র, যা যেকোনো মুহূর্তে তাদের এই ছোট্ট দ্বীপটাকে গ্রাস করার জন্য এগিয়ে আসতে পারে। সেই করুন, ভৌতিক সুরটা আবার শুরু হলো। এবার আরও কাছ থেকে। মনে হচ্ছিল, গ্রামের প্রতিটি বাড়ির ভেতর থেকে, প্রতিটি অন্ধকার কোণ থেকে অদৃশ্য গায়কেরা সেই সুরে গলা মেলাচ্ছে। সুরটা যেন তাদের ঘিরে একটা বৃত্ত তৈরি করছিল, যা ক্রমশ ছোট হয়ে আসছিল। একসময় তাদের মনে হতে লাগল, সুরটা বাইরে থেকে আসছে না, আসছে তাদের নিজেদের মাথার ভেতর থেকে। তারা অন্য কিছু ভাবার চেষ্টা করল, অন্য গান মনে করার চেষ্টা করল, কিন্তু সেই বিষণ্ণ সুরটা তাদের সমস্ত ভাবনাকে ঢেকে দিচ্ছিল, তাদের হৃদস্পন্দনের সাথে মিশে যাচ্ছিল। হঠাৎ জয় ফিসফিস করে উপরের দিকে আঙুল দেখাল। “শব্দটা… শব্দটা উপর থেকে আসছে!” তারা সবাই উপরে তাকাল। নাটমন্দিরের ভাঙা ছাদের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছিল রাতের কালো আকাশ। কিন্তু সুরটা আসছিল ঠিক সেখান থেকেই, যেন কোনো অতৃপ্ত আত্মা আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে আর তার অন্তহীন দুঃখের গাথা শোনাচ্ছে। আর ঠিক তখনই ঘটল সেই ঘটনাটা। কোনো বাতাস ছাড়াই, আগুনের শিখাগুলো একবার দপ করে এক অস্বাভাবিক, রাসায়নিক সবুজ রঙ ধারণ করল। সেই আলোয় তাদের একে অপরের মুখকে দেখাচ্ছিল কোনো মৃতদেহের মতো। তারপর, আগুনের পটপট শব্দটা বদলে গিয়ে একটা ভেজা, হিসহিস শব্দে পরিণত হলো। এবং অবশেষে, একটা ভয়ঙ্কর, শুষে নেওয়ার মতো শব্দ—যেন অন্ধকার নিজেই একটা জীবন্ত সত্তা, যে এক নিঃশ্বাসে তাদের শেষ আশার আলোটুকু শুষে নিয়েছে। এক মুহূর্তের জন্য নেমে এল কবরের অন্ধকার। সেই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তারা প্রত্যেকেই এটা অনুভব করল। একটা শীতল, পিচ্ছিল, ওজনহীন স্পর্শ। রিয়া অনুভব করল, শুকনো ডালের মতো ভঙ্গুর, বরফ-ঠান্ডা আঙুল তার চুল বিলি করে দিচ্ছে, আর তার নাকে এল ভেজা মাটির গন্ধ। জয় তার ঘাড়ে কারও আর্দ্র নিঃশ্বাস অনুভব করল, আর তার কানে এল একটা ভেজা, clicking শব্দ, যেন কেউ জিভ দিয়ে তালুতে শব্দ করছে। আরিকের পিঠে, ঠিক শিরদাঁড়ার ওপর, কেউ যেন একটা বরফের ছুঁচ দিয়ে খোঁচা দিল। আর শ্রেয়া তার কাঁধে অনুভব করল একটা ভারী, স্যাঁতসেঁতে হাতের চাপ, যা এতটাই বাস্তব ছিল যে তার মনে হলো পরে চামড়ায় দাগ থেকে যাবে। আতঙ্কে জমে গিয়ে চিৎকার করার শক্তিও তাদের ছিল না। আরিক আর জয় যখন কাঁপা কাঁপা হাতে টর্চ জ্বালাল, তখন দেখল, সবকিছু আগের মতোই আছে। কেউ কোথাও নেই। কিন্তু সেই অদৃশ্য স্পর্শের অনুভূতি তাদের চামড়ায় লেগে রইল, যা বাইরের ঠান্ডার চেয়েও অনেক বেশি হিমশীতল ছিল। সেই রাতটা ছিল তাদের জীবনের দীর্ঘতম রাত। তারা পালা করে পাহারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল, কিন্তু ঘুম কারোরই চোখে ছিল না। এটা ঘুম ছিল না, ছিল ক্লান্তি আর ভয়ে অবশ হয়ে যাওয়া এক অচেতন অবস্থা। ভোরের ঠিক আগে, যখন অন্ধকার সবচেয়ে গভীর, তখন চারজনেই সেই তন্দ্রার অতলে তলিয়ে গেল। আর তখনই তারা স্বপ্নটা দেখল। আশ্চর্যের বিষয় হলো, তারা চারজনেই একই দুঃস্বপ্নের অংশীদার হলো। তারা দেখল, শ্যামলগড় গ্রামটা আলোয় ঝলমল করছে। নাটমন্দিরে উৎসবের আয়োজন। গ্রামবাসীরা নতুন পোশাকে সেজেছে, তাদের মুখে হাসি, কিন্তু চোখগুলো ভয়ে বিস্ফারিত। তারা যেন কোনো অদৃশ্য পরিচালকের নির্দেশে অভিনয় করে চলেছে। স্বপ্নের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল গ্রামের মাঝখানে প্রজ্বলিত এক বিশাল যজ্ঞ। সেই যজ্ঞের আগুনে গ্রামবাসীরা শুধু ঘি বা কাঠ নয়, নিজেদের চুল, নখ, এমনকি রক্তও আহুতি দিচ্ছিল। যজ্ঞের আগুন থেকে কোনো দেবতা নয়, উঠে আসছিল এক ‘অ-বস্তু’—এক জীবন্ত ছায়া, যা আলোর উৎস হওয়া সত্ত্বেও নিজেই ছিল জমাট অন্ধকার। এক ‘Anti-God’। গ্রামবাসীরা সেই ছায়া-দেবতার সামনে নতজানু হয়ে অমরত্বের জন্য প্রার্থনা করছিল। তারপরই শুরু হলো আসল বিভীষিকা। সেই ছায়া-দেবতার ইশারায় গ্রামবাসীদের শরীর থেকে তাদের ছায়াগুলো যেন চামড়া ছাড়ানোর মতো করে আলাদা হয়ে যেতে লাগল। সেই বিচ্ছিন্ন ছায়াগুলো আর সাধারণ ছায়া ছিল না। তারা হয়ে উঠেছিল স্বাধীন, বুদ্ধিমান এবং ভয়ঙ্কর সত্তা। তারা তাদের প্রাক্তন মালিকদের দিকে তাকিয়ে অট্টহাসি হাসছিল। স্বপ্নের শেষদিকে তারা দেখল, সেই ছায়াগুলো তাদের মালিকদের শরীরকে গ্রাস করছে, শুষে নিচ্ছে তাদের জীবনীশক্তি। মানুষের আর্তনাদ আর ছায়াদের বিজয়োল্লাসে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল। স্বপ্নের শেষ মুহূর্তে, তারা চারজনে দেখল, তাদের নিজেদের ছায়াও তাদের শরীর থেকে আলাদা হয়ে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের ছায়াগুলো তাদের দিকে তাকিয়ে হাসছে আর তাদের গলা টিপে ধরছে। আর সেই ছায়াগুলো তাদের কানে ফিসফিস করে বলছিল তাদের গভীরতম ভয়গুলোর কথা। আরিকের ছায়া বলছিল, ‘ব্যর্থ’। রিয়ার ছায়া বলছিল, ‘বিস্মৃত’। জয়ের ছায়া বলছিল, ‘ভীরু’। আর শ্রেয়ার ছায়া বলছিল, ‘অজ্ঞ’। সেই দমবন্ধ করা অনুভূতিতেই চারজনের ঘুম ভেঙে গেল। তারা দেখল, পুব আকাশে ভোরের ফ্যাকাসে, নিষ্প্রাণ আলো ফুটেছে। তারা হাঁপাচ্ছিল, তাদের সারা শরীর ঘামে ভেজা। তারা একে অপরের দিকে তাকাল। প্রত্যেকের চোখেই ছিল একই আতঙ্ক আর অবিশ্বাস্য দৃষ্টি। এটা কোনো সাধারণ স্বপ্ন ছিল না। এটা ছিল শ্যামলগড়ের ইতিহাস, যা তাদের চেতনায় সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছে। (চলবে)

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion