Episode 5485 words0 views

মানচিত্রের বাইরে : পঞ্চম পর্ব

ভোরের আলো ফুটতেই গ্রামের ভৌতিক ভাবটা কিছুটা কমল, কিন্তু রাতের দুঃস্বপ্ন তাদের স্নায়ুতন্ত্রকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল। তারা জানত, তারা যা দেখেছে, তা নিছক কল্পনা নয়। সকালের হাওয়াটাও ছিল অদ্ভুতরকম ভারী আর স্যাঁতসেঁতে, তাতে মিশে ছিল পচা পাতার গন্ধ আর তার সাথে ওজোনের মতো এক অদ্ভুত ধাতব গন্ধ। তাদের শরীর ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছিল, কিন্তু অ্যাড্রেনালিনের প্রভাবে তারা কোনো ক্লান্তি অনুভব করছিল না, শুধু একটা চাপা উত্তেজনা আর ভয় তাদের সজাগ করে রেখেছিল। শ্রেয়া সবার আগে চামড়ার ডায়েরিটা আবার বের করল। তার হাত কাঁপছিল। সে স্বপ্নের কথা মাথায় রেখে পাতাগুলো নতুন করে পড়তে শুরু করল। এবার একটা নির্দিষ্ট লাইন তার চোখে পড়ল, যা তার মেরুদণ্ড দিয়ে শীতল স্রোত বইয়ে দিল: ‘আমরা অমরত্ব চাহিয়াছিলাম, কিন্তু পাইয়াছি এক অনন্ত কারাগার। আমাদের দেহই উহাদের কারাগার, আর রাত্রি নামলেই উহারা সেই কারাগার হইতে মুক্তি চায়। উহারা আমাদের আত্মা নহে, উহারা আমাদেরই অন্ধকারের প্রতিরূপ।’ শ্রেয়া লাইনটা বাকিদের পড়ে শোনাল। আরিকের মুখটা থমথমে হয়ে গেল। “তার মানে, ওই ছায়াগুলো এখনো এই গ্রামেই আছে। আর গ্রামবাসীরা…?” “গ্রামবাসীরাও আছে,” শ্রেয়া দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে বলল। “হয়তো এই দেওয়ালের মধ্যেই।” এই সূত্র ধরেই তারা নাটমন্দিরের ভেতরের দেওয়ালগুলো ভালো করে পর্যবেক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নিল। দিনের আলোয় মন্দিরের ভেতরের দেওয়ালগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। তারা শার্টের হাতা দিয়ে, হাতের কাছে পাওয়া পাতা দিয়ে দেওয়ালের ধুলো আর ঝুল পরিষ্কার করতে লাগল। ধীরে ধীরে যা ফুটে উঠল, তা তাদের দুঃস্বপ্নেরই এক দৃশ্যগত প্রমাণ। দেওয়াল জুড়ে খোদাই করা ছিল একটা আস্ত কাহিনী। ছবিগুলো কোনো দক্ষ শিল্পীর আঁকা নয়, বরং ভয় আর desesperación থেকে জন্ম নেওয়া কিছু crude কিন্তু জীবন্ত চিত্র। প্রথম চিত্র: শ্যামলগড় এক সমৃদ্ধ গ্রাম, গ্রামবাসীরা সুখে-শান্তিতে বসবাস করছে। দ্বিতীয় চিত্র: এক দীর্ঘদেহী, কৃশ তান্ত্রিকের আগমন, যার নিজের ছায়াটাই ছিল অস্বাভাবিক রকমের লম্বা আর বিকৃত। সে গ্রামবাসীদের এক পুঁথি দেখাচ্ছে। তৃতীয় চিত্র: সেই ভয়ঙ্কর যজ্ঞ। অমাবস্যার রাতে গ্রামের মাঝখানে বিশাল যজ্ঞের আয়োজন। ছবির কেন্দ্রে সেই নিরাকার ছায়া-দেবতা, যাকে বোঝানোর জন্য শিল্পী দেওয়ালের ওই অংশটা মসৃণ না রেখে খোদাই করে আরও গভীর অন্ধকার করে দিয়েছেন। গ্রামবাসীরা সেই দেবতার পায়ে রক্ত দিয়ে চুক্তি করছে। শ্রেয়া লক্ষ্য করল, ছবির কোনায় কিছু অদ্ভুত সঙ্কেত খোদাই করা আছে—ভেতরের দিকে ঘোরানো সর্পিল চক্র, যা ফাঁদ বা গোলকধাঁধার প্রতীক। চতুর্থ এবং শেষ চিত্র: বিভীষিকার চূড়ান্ত রূপ। ছায়াগুলো তাদের মালিকদের শরীর থেকে বেরিয়ে আসছে। গ্রামবাসীদের শরীরগুলো ধীরে ধীরে স্বচ্ছ হয়ে যাচ্ছে, যেন তাদের অস্তিত্ব মুছে যাচ্ছে। আর সেই বিজয়ী ছায়াগুলো গ্রামের দখল নিচ্ছে। “এটা কোনো অভিশাপ নয়,” শ্রেয়া ফিসফিস করে বলল। “এটা একটা চুক্তি। একটা ভয়ঙ্কর চুক্তি, যা ভুল হয়েছিল। গ্রামবাসীরা অমরত্ব চেয়েছিল, তারা ভেবেছিল তাদের ছায়া তাদের রক্ষা করবে। কিন্তু পরিবর্তে, ছায়ারাই তাদের গ্রাস করে তাদের শরীরে বন্দি হয়ে গেছে। দিনের বেলায় এই ছায়াগুলো দুর্বল থাকে, তাই তারা এই গ্রামের দেয়াল, মাটি, গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকে। আর রাত নামলেই তারা বেরিয়ে আসে।” আরিক দেওয়ালে আঁকা ছায়া-দেবতার মূর্তির দিকে তাকিয়ে বলল, “তার মানে, কাল রাতে আমরা যাদের অনুভব করেছি… ওগুলো আসলে এই গ্রামবাসীদের অতৃপ্ত, জীবন্ত ছায়া?” এই কথা ভাবতেই তার নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা মনে পড়ে গেল। এক্সক্লুসিভ স্টোরির জন্য সেও তো যেকোনো ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত ছিল। এই গ্রামবাসীরাও কি তারই মতো ছিল? এই চিন্তাটা তাকে ভেতর থেকে কাঁপিয়ে দিল। (চলবে)

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion