Episode 6632 words0 views

মানচিত্রের বাইরে : ষষ্ঠ পর্ব

সত্যটা জানার পর তাদের চারপাশের সবকিছুকেই অন্যরকম লাগতে শুরু করল। প্রত্যেকটা অন্ধকার কোণ, প্রত্যেকটা গাছের ছায়া, সবকিছুকেই জীবন্ত আর বিপজ্জনক বলে মনে হচ্ছিল। তারা ঠিক করল, দিনের আলো থাকতে থাকতেই গ্রাম থেকে বেরোনোর একটা পথ খুঁজে বের করতে হবে। কারণ, আরেকটা রাত এই গ্রামে কাটানোর কথা তারা ভাবতেও পারছিল না। তারা চারটি ভিন্ন দিকে যাওয়ার পরিকল্পনা করল, কিন্তু ঠিক করল যে তারা একে অপরের দৃষ্টিসীমার মধ্যেই থাকবে। জয় নাটমন্দিরের চারপাশের দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করতে লাগল। সে যখন ক্যামেরার ভিউফাইন্ডারে চোখ রেখে নাটমন্দিরের ভাঙা থামগুলোর ছবি তুলছিল, তখন একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করল। সে ভিউফাইন্ডারের ভেতর দিয়ে যা দেখছে, তা তার খালি চোখের দেখার সাথে মিলছে না। ভিউফাইন্ডারে, থামের গায়ে যে ছায়া পড়েছে, তার পাশে আরও অসংখ্য সূক্ষ্ম, কাঁপতে থাকা ছায়া দেখা যাচ্ছে—মানুষের আকৃতির। সে ক্যামেরাটা চোখ থেকে সরাতেই দেখল, কিচ্ছু নেই। আবার ক্যামেরায় চোখ রাখতেই সেই ছায়ামানুষদের দেখতে পেল। যেন তার ক্যামেরাটা দুই জগতের মাঝখানের পর্দাটা সরিয়ে দিচ্ছিল। একসময়, ভিউফাইন্ডারের মধ্যে থাকা একটা ছায়ামূর্তি হঠাৎ করে তার দিকে পুরোপুরি ঘুরে তাকাল। জয়ের মনে হলো, তার বুকের রক্ত জমে বরফ হয়ে গেছে। অন্যদিকে, রিয়া গ্রামের পুকুরঘাটে দাঁড়িয়ে একটা PtoC রেকর্ড করার চেষ্টা করছিল। সে সাহসের ভান করে বলছিল, “বন্ধুরা, আমরা শ্যামলগড়ের এক অবিশ্বাস্য রহস্যের মুখোমুখি হয়েছি…” কথাটা শেষ করার আগেই তার কানের পাশে কেউ ফিসফিস করে তার নিজেরই গলায় বলল, “এই ভিডিও কেউ দেখবে না, রিয়া… তুমি এখানেই হারিয়ে যাবে… একা।” ভয়েসটা এতটাই স্পষ্ট আর নিজের ছিল যে রিয়ার মনে হলো তার আত্মাটাই যেন তার সাথে কথা বলছে। সে আতঙ্কে চিৎকার করে দৌড়ে সেখান থেকে পালাল। দুপুরের দিকে তারা আবার নাটমন্দিরে ফিরে এল। প্রত্যেকের মুখেই ছিল নতুন করে পাওয়া আতঙ্কের ছাপ। শ্রেয়া বলল, “ওরা আমাদের দুর্বলতাগুলো জানে। ওরা আমাদের মন নিয়ে খেলছে।” বিকেলের ম্লান আলো যখন গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে, তখন শ্রেয়া হঠাৎ করেই সেই ভয়ঙ্করতম আবিষ্কারটা করল। তারা সবাই আগুনের জন্য শুকনো ডালপালা জড়ো করছিল। তাদের প্রত্যেকের ছায়া দীর্ঘ হয়ে মাটিতে পড়েছিল। শ্রেয়া একদৃষ্টে নিজের ছায়াটার দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ সে আরিককে শান্ত কিন্তু দৃঢ় গলায় বলল, “আরিক, কিচ্ছু না বলে, শুধু তোমার ডান হাতটা তোল।” আরিক অবাক হয়ে তার ডান হাত তুলল। কিন্তু মাটিতে পড়ে থাকা তার ছায়াটা এক মুহূর্তের জন্য স্থির রইল। তারপর খুব ধীরে, যেন অনিচ্ছাসত্ত্বেও, ছায়াটার ডান হাতটা উঠল। একটা সূক্ষ্ম, এক সেকেন্ডেরও কম সময়ের ব্যবধান। এতটাই সামান্য যে সহজে চোখে পড়ার মতো নয়। কিন্তু শ্রেয়ার শ্যেনদৃষ্টি তা এড়িয়ে যায়নি। তার মুখটা ভয়ে সাদা হয়ে গেল। সে আতঙ্কিত গলায় বাকিদের বলল, “কেউ কোনো ভাবে নড়াচড়া করবে না… খুব ধীরে… নিজেদের ছায়াগুলোর দিকে তাকাও।” জয় আর রিয়া ভয়ে ভয়ে তাদের ছায়ার দিকে তাকাল। তারা হাত-পা নাড়ল। প্রতিবারই তাদের ছায়াগুলো তাদের অনুসরণ করছিল, কিন্তু এক লহমার জন্য দেরি করে। যেন ছায়াগুলোর নিজস্ব একটা ইচ্ছা তৈরি হচ্ছে, তারা যেন তাদের শরীরের বন্ধন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বিদ্রোহ করছে। যেন একজন পাপেট মাস্টার তার পুতুলের সুতো নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। আর প্রতিবার ছায়াটা যখন দেরিতে নড়ছিল, তখন মাটি থেকে একটা প্রায় অশ্রুত, শুকনো পাতা ছেঁড়ার মতো ‘খস’ শব্দ হচ্ছিল। তারা বুঝতে পারল, শ্যামলগড়ের অভিশাপ শুধু গ্রামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। সেটা ছোঁয়াচে। সেটা এবার তাদেরও গ্রাস করতে শুরু করেছে। তাদের নিজেদের শরীরের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, তাদের নিজেদের ছায়ারাই তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। সূর্য ডুবছিল। আরেকটা রাত নামছিল শ্যামলগড়ে। কিন্তু এবার তারা জানত, অন্ধকার নামলে শুধু গ্রামের অভিশপ্ত ছায়ারাই নয়, তাদের নিজেদের ছায়ারাও তাদের শত্রু হয়ে উঠবে। অভিশাপটা এখন আর বাইরে নয়, তাদের ভেতরেই প্রবেশ করেছে। তাদের শরীর আর ছায়ার মধ্যে যে পবিত্র, প্রাকৃতিক বন্ধন, তা ছিঁড়ে যেতে শুরু করেছে। সূর্যের শেষ রক্তিম আভা যখন পশ্চিমের শালবনগুলোর পেছনে এক দীর্ঘশ্বাসের মতো ডুবে গেল, তখন শ্যামলগড়ে শুধু রাত নামল না, নামল এক ভিন্ন জগৎ। দিনের ফ্যাকাসে আলোটুকুও ছিল এক আশীর্বাদ, যা এখন তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। নাটমন্দিরের চাতালে তাদের জ্বালানো ছোট্ট আগুনটুকুই ছিল সভ্যতার শেষ প্রদীপ, এক ডুবন্ত জাহাজের শেষ সংকেত। আর সেই আগুনের আলোয়, মাটিতে তাদের যে ছায়াগুলো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছিল, সেগুলো আর তাদের অনুগত ভৃত্য ছিল না। সেগুলো হয়ে উঠেছিল তাদের শরীরের ভেতরে লুকিয়ে থাকা শত্রু, এক নীরব, আসন্ন বিদ্রোহের প্রতীক। (চলবে)

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion