রাতের দ্বিতীয় প্রহর তখন। নাটমন্দিরের চাতালে তাদের জ্বালানো আগুনটা কিছুটা দমে এসেছে। কাঠের জ্বলন্ত টুকরোগুলো এখন আর উজ্জ্বল শিখা নয়, বরং গনগনে অঙ্গারের মতো জ্বলছে, যা থেকে একটা নিস্তেজ, রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়ছে। এই আলোয় চারপাশের অন্ধকার আরও গভীর, আরও দুর্ভেদ্য বলে মনে হচ্ছিল। রাতের সেই অশুভ সুরটা আপাতত থেমে গিয়েছিল, কিন্তু তার জায়গায় এসেছিল এক ভারী, থমথমে নিস্তব্ধতা। এই নিস্তব্ধতা শূন্য ছিল না; এটা ছিল expectant, যেন গোটা গ্রাম কান পেতে আছে, তাদের পরবর্তী ভুলের অপেক্ষায়।
তারা চারজন আগুনের চারপাশে বসেছিল, কিন্তু কেউ কারও সাথে কথা বলছিল না। প্রথম রাতের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার পর তাদের মধ্যে এক অলিখিত দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। ভয়টা এখন আর সমষ্টিগত ছিল না, ছিল একান্ত ব্যক্তিগত।
শ্রেয়াই প্রথম ব্যাপারটা লক্ষ্য করল। ক্লান্তি আর বিনিদ্র রাতের কারণে তার চোখ জ্বালা করছিল। সে তার নোটবুকের পাতায় দিনের পর্যবেক্ষণগুলো লেখার জন্য ঝুঁকেছিল। আগুনের কাঁপা আলোয় তার হাতের ছায়াটাও দেওয়ালের গায়ে নড়ছিল—এক পরিচিত, আজন্মের সঙ্গী। সে লেখা থামিয়ে হাতটা সরাতেই তার চোখটা আটকে গেল। তার মনে হলো, দেওয়ালের ওপর তার হাতের ছায়াটা যেন এক মুহূর্তের ভগ্নাংশের জন্য স্থির রয়ে গিয়েছিল, তারপর অনিচ্ছাসত্ত্বেও তার হাতকে অনুসরণ করেছিল।
সে ভ্রূ কুঁচকে গেল। ‘চোখের ভুল,’ সে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করল। ‘ক্লান্তি আর এই অদ্ভুত আলো… অপটিক্যাল ইলিউশন হওয়াটাই স্বাভাবিক।’
কিন্তু তার বিজ্ঞানমনস্ক মন এই সামান্য অসামঞ্জস্যকেও উপেক্ষা করতে পারল না। সে আবার চেষ্টা করল, এবার আরও সজাগভাবে। সে তার আঙুলগুলো ধীরে ধীরে নাড়াল। ছায়াটাও নাড়ল। স্বাভাবিক। তারপর সে হঠাৎই আঙুলগুলো মুষ্টিবদ্ধ করল। আর তখনই সে আবার দেখল। তার আঙুলগুলো মুষ্টিবদ্ধ হওয়ার প্রায় এক সেকেন্ডের এক-চতুর্থাংশ সময় পর তার ছায়াটা মুষ্টিবদ্ধ হলো। একটা সূক্ষ্ম, কিন্তু সামান্য সময়ের ব্যবধান। যেন তার শরীর আর ছায়ার মধ্যেকার সংযোগটা কোনো ঘন, আঠালো মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে আসছে।
তার হৃদপিণ্ডটা একবার জোরে লাফিয়ে উঠে থেমে গেল। সে তার নিজের শরীরের দিকে তাকাল, তারপর দেওয়ালের ওপর তার অন্ধকার প্রতিরূপের দিকে। এক শীতল, আর্দ্র ভয় তার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল। সে সবার অলক্ষ্যে আরও কয়েকবার চেষ্টা করল। মাথা নাড়াল, কাঁধ ঝাঁকাল। প্রতিবার ফল একই।
না, এটা মনের ভুল নয়। এটা সত্যি।
“গাইজ,” সে নিচু গলায় বলল। তার স্বরটা অস্বাভাবিকরকম শান্ত, প্রায় clinical, যা তার ভেতরের চরম ঝড়কে ঢেকে রেখেছিল। এই শান্ত ভাবটা ছিল তার ভেঙে পড়ার ঠিক আগের মুহূর্ত।
আরিক, যে তখনো গ্রামের একটা হাতে আঁকা ম্যাপের দিকে তাকিয়ে বেরোনোর পথের কথা ভাবছিল, সে বিরক্ত হয়ে মুখ তুলে তাকাল। “কী হয়েছে?”
“একটা কাজ করতে পারবে?” শ্রেয়া আরিকের চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল। “তোমার ডান হাতটা তোলো। প্রথমে খুব ধীরে… তারপর হঠাৎ করে নামিয়ে নেবে।” তার গলার স্বরে এমন কিছু ছিল যা আরিককে পাল্টা প্রশ্ন করতে বাধা দিল। রিয়ার কান্ন ভেজা চোখ আর জয়ের ফ্যাকাসে মুখও ঘুরে তাকাল শ্রেয়ার দিকে।
আরিক কাঁধ ঝাঁকিয়ে তার হাতটা তুলল। প্রথমে ধীরে। সবকিছু স্বাভাবিক। তারপর সে হঠাৎই হাতটা নামিয়ে নিল।
আর তখনই তারা সবাই দেখল।
আরিকের শরীরটা থেমে যাওয়ার প্রায় এক সেকেন্ড পর তার ছায়াটা মাটিতে আছড়ে পড়ল। একটা বিরক্তিকর, বিলম্বিত প্রতিध्वনি-র মতো। যেন ছায়াটা তার মালিকের আদেশের কথা কিছুক্ষণ ভেবে, তারপর অসীম অনিচ্ছায় সেই আদেশ পালন করল।
রিয়া ভয়ে মুখ চাপা দিল। তার মুখ থেকে একটা চাপা গোঙানির শব্দ বেরিয়ে এল। জয় তার ক্যামেরাটা তুলে প্রায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে দৃশ্যটা রেকর্ড করতে শুরু করল। তার হাত কাঁপছিল।
একে একে তারা প্রত্যেকেই চেষ্টা করল। প্রতিবার ফল একই। তাদের শরীর আর ছায়ার মধ্যেকার সেই পবিত্র, জন্মগত বন্ধন ছিঁড়ে গিয়েছিল। একটা অদৃশ্য সুতো, যা আলোর গতিতে তাদের সংযুক্ত রাখত, তা যেন এই অভিশপ্ত গ্রামের বাতাসে এসে ঢিলে হয়ে গিয়েছিল, আঠালো হয়ে গিয়েছিল। আর প্রতিবার ছায়াটা যখন দেরিতে নড়ছিল, তখন মাটি থেকে একটা প্রায় অশ্রুত, শুকনো পাতা ছেঁড়ার মতো ‘খস’ শব্দ হচ্ছিল। বাস্তবতার পর্দা ছিঁড়ে যাওয়ার শব্দ।
এই আবিষ্কার তাদের বাস্তবতার বোধকে চুরমার করে দিল। এ ছিল নিজেরই শরীরের বিশ্বাসঘাতকতার ভয়, নিজের অস্তিত্বের মৌলিক নিয়ম ভেঙে যাওয়ার আতঙ্ক।
আরিক: তার কাছে এই ঘটনাটা ছিল এক ব্যক্তিগত অপমান। সে গর্জে উঠে দাঁড়াল। “এটা কীভাবে সম্ভব! এটা হতে পারে না!” তার কাছে নিয়ন্ত্রণই ছিল সবকিছু। আর আজ তার নিজের শরীর, তার নিজের ছায়াই তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সে প্রায় পাগল হয়ে গেল। সে দ্রুত হাত-পা ছুঁড়তে লাগল, প্রায় একটা উন্মত্ত নাচের ভঙ্গিতে, যেন সে তার ছায়াটাকে জোর করে, শারীরিক শক্তি প্রয়োগ করে তার সাথে তাল মেলাতে বাধ্য করবে। সে ঘুষি মারছিল, লাথি ছুঁড়ছিল, আর তার ছায়াটা এক অলস, বিশৃঙ্খল অনুকরণে তাকে অনুসরণ করছিল। এই দৃশ্যটা ছিল করুণ এবং ভয়ঙ্কর। আরিক শুধু তার ছায়ার সাথেই লড়ছিল না, সে লড়ছিল এই গ্রামের ভয়ঙ্কর, যুক্তিহীন বাস্তবতার বিরুদ্ধে। সে প্রকৃতির নিয়মকে নিজের ইচ্ছাশক্তি দিয়ে পুনঃস্থাপন করতে চাইছিল। কিন্তু প্রতিবারই সে হারছিল। অবশেষে, হাঁপাতে হাঁপাতে, পরাজিত হয়ে সে মাটিতে বসে পড়ল। তার চোখে ছিল এক শিশুর মতো অসহায়ত্ব আর তীব্র ক্রোধ।
রিয়া: তার আতঙ্কটা ছিল আরও আদিম, আরও ব্যক্তিগত। তার পেশাটাই ছিল তার চেহারা, তার শরীর, তার প্রতিচ্ছবিকে কেন্দ্র করে। ছায়া হলো তারই এক অন্ধকার প্রতিরূপ। সেই প্রতিরূপ আজ তার অবাধ্য। এই অনুভূতিটা ছিল ভয়ঙ্কর। তার মনে হলো, সে তার নিজের শরীরেই একজন অপরিচিত। সে তার ফোনটা বের করে সেলফি ক্যামেরা অন করল। স্ক্রিনে তার ভীত, ফ্যাকাসে মুখ। সে হাত নাড়াল। স্ক্রিনে তার হাত নড়ল, কিন্তু তার ছায়ার কথা ভাবতেই তার শরীর গুলিয়ে উঠল। তার মনে হলো, তার সত্তা দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। সে তার নিজের হাত, নিজের মুখ স্পর্শ করতে লাগল, যেন নিশ্চিত হতে চাইছে যে সেগুলো সত্যি। তার প্যানিক অ্যাটাক শুরু হলো। তার নিঃশ্বাস ঘন হয়ে এল, বুকের ভেতরটা চেপে ধরল। সে তার ছায়াটার দিকে তাকিয়ে ভয়ে চিৎকার করে উঠল এবং তার থেকে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু সে যেখানেই যাচ্ছিল, তার ছায়াটা তার সাথেই যাচ্ছিল। এই ভয়ঙ্কর সত্যটা—যে সে তার নিজের কাছ থেকেই পালাতে পারবে না—তাকে প্রায় জ্ঞানশূন্য করে দিয়েছিল। সে এক কোণে গিয়ে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে পড়ল, শরীরটাকে যতটা সম্ভব গুটিয়ে নিল, যেন তার ছায়াটাও ছোট হয়ে যায়, যেন তার অস্তিত্বটাই সংকুচিত হয়ে যায়।
জয়: সে তার ক্যামেরাটাকে আঁকড়ে ধরেছিল। সে কাঁপতে কাঁপতে ক্যামেরাটা অন করে নিজের ছায়ার দিকে ফোকাস করল। ক্যামেরার হাই-ফ্রেম রেট ডিসপ্লেতে সেই ‘ল্যাগ’ আরও স্পষ্টভাবে ধরা পড়ছিল। সে প্লে-ব্যাক করে স্লো-মোশনে দেখল। তার শরীর আর ছায়ার নড়াচড়ার মাঝখানে কয়েকটা কালো, glitchy ফ্রেম রেকর্ড হয়েছে, যেন বাস্তবতা নিজেই কয়েক মুহূর্তের জন্য ছিঁড়ে গিয়েছিল। সে যা দেখল, তাতে তার ভয় আরও বেড়ে গেল। ক্যামেরার লেন্সে, তার ছায়াটা শুধু দেরিতে নড়ছিল না, নড়ার আগে এক মুহূর্তের জন্য তার আকৃতিটাও সামান্য বিকৃত হয়ে যাচ্ছিল, যেন সেটা তরল অবস্থা থেকে কঠিন অবস্থায় ফিরে আসার চেষ্টা করছে। তার মনে হলো, তার ক্যামেরা, যা এতদিন তার আর বাস্তবতার মধ্যে একটা নিরাপদ দেওয়াল ছিল, সেই দেওয়ালটা আজ ভেঙে পড়েছে। ক্যামেরাটা তাকে এমন এক সত্য দেখাচ্ছে যা তার মস্তিষ্ক মেনে নিতে পারছে না। তার মাথা ঘুরতে লাগল, বমি বমি ভাব হলো।
শ্রেয়া: বাকিদের প্রতিক্রিয়া দেখে তার নিজের ভয়টা আরও তীব্র হলো। তার বৈজ্ঞানিক মনটা মরিয়া হয়ে একটা ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করছিল। টাইম ডাইলেশন? লোকাল গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিঙ? ম্যাস হিস্টিরিয়া? কিন্তু কোনো তত্ত্বই এই ঘটনা-কে ব্যাখ্যা করতে পারছিল না। সে তার নিজের হাতের দিকে তাকাল, তারপর মাটিতে পড়ে থাকা তার অন্ধকার প্রতিরূপের দিকে। তার মনে হলো, তারা দুজন আলাদা সত্তা। সে তার শরীরটাকে অনুভব করতে পারছিল, কিন্তু তার ছায়াটাকে নয়। তাদের মধ্যেকার সংযোগটা ছিল একতরফা। সে তার ছায়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত না, কিন্তু তার ছায়াটা তার সাথে জুড়ে ছিল। এই অনুভূতিটা ছিল ভয়ঙ্কর। তার মনে হলো, সে যেন এক পাপেট, যার সুতোগুলো ঢিলে হয়ে গেছে, কিন্তু ছিঁড়ে যায়নি। সে বুঝতে পারল, এটা পদার্থবিদ্যার সংকট নয়, এটা অস্তিত্বের সংকট।
অবশেষে, তাদের frantic নড়াচড়া থেমে গেল। একটা ভয়ঙ্কর উপলব্ধি তাদের সবাইকে গ্রাস করল। নড়াচড়াই এই বিদ্রোহকে উস্কে দিচ্ছে। তারা যত নড়বে, তাদের শরীর আর ছায়ার মধ্যেকার ফাটল তত বাড়বে।
এক নতুন, ভয়ঙ্কর নীরবতা নেমে এল। আগের নীরবতা ছিল গ্রামের, ছিল বাইরের। এই নীরবতা ছিল তাদের নিজেদের তৈরি। তারা আগুনের চারপাশে আবার এসে বসল, কিন্তু এবার মূর্তির মতো। স্থির। নিশ্চল। কেউ নড়তে সাহস করছিল না। তারা একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিল, তাদের চোখে ছিল না বলা এক প্রশ্ন—এরপর কী?
তাদের নতুন কারাগার তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এই কারাগার শ্যামলগড় গ্রাম নয়। এই কারাগার হলো তাদের নিজেদের শরীর। আর সেই কারাগারের প্রহরী হলো তাদেরই ছায়া।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion