তাদের নতুন কারাগার তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এই কারাগার শ্যামলগড় গ্রাম নয়। এই কারাগার হলো তাদের নিজেদের শরীর। আর সেই কারাগারের প্রহরী হলো তাদেরই ছায়া।
তারা পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে বসেছিল। নাটমন্দিরের চাতালে তাদের জ্বালানো আগুনটা এখন আর নিরাপত্তার উৎস ছিল না, বরং হয়ে উঠেছিল এক ভয়ঙ্কর মঞ্চ। সেই মঞ্চের আলোয় তাদের দীর্ঘায়িত ছায়াগুলো ছিল প্রধান অভিনেতা, আর তারা নিজেরা ছিল অসহায় দর্শক, যারা নিজেদেরই শরীরের নাটক দেখতে বাধ্য হচ্ছিল। এই নিস্তব্ধতা ছিল অসহনীয়। বাইরে কোনো শব্দ নেই, কিন্তু তাদের নিজেদের কানের ভেতরে রক্ত চলাচলের শব্দ, হৃদপিণ্ডের ধুকপুক শব্দ যেন ঢাকের বাদ্যির মতো বাজছিল। প্রত্যেকেই নিজের ছায়াটার দিকে তাকিয়ে ছিল—সেই কালো, দ্বি-মাত্রিক প্রতিরূপ, যা সারাজীবন ধরে তাদের অনুগত দাস হয়ে ছিল, কিন্তু আজ রাতে হয়ে উঠেছে তাদের মনিব, তাদের জল্লাদ।
প্রথম বিদ্রোহটা হলো প্রায় অশ্রুত, প্রায় অদৃশ্য। জয়, যে তার ক্যামেরাটাকে কোলের ওপর রেখে পাথরের মতো বসেছিল, সে হঠাৎ তার peripheral vision-এ একটা নড়াচড়া অনুভব করল। তার ছায়ার ডান হাতটা, যা তার কোলের ওপর রাখা ক্যামেরার ছায়ার ওপরে স্থির থাকার কথা, তার তর্জনীটা নিজে থেকেই সামান্য কেঁপে উঠল। একবার। দুইবার। জয়ের মনে হলো যেন তার নিজের তর্জনীতেও একটা অদ্ভুত, শীতল অনুভূতি খেলে গেল, যেন কেউ তার আঙুলের স্নায়ুতে বরফ ছুঁইয়েছে। এটা ছিল প্রথম সঙ্কেত। কারাগারের ভেতরে প্রথম বিদ্রোহের গুঞ্জন।
এরপরের ঘটনাটা দেখল শ্রেয়া। সে বসেছিল রিয়ার মুখোমুখি। রিয়া ভয়ে গুটিসুটি মেরে হাঁটুতে মুখ গুঁজে ছিল, তার শরীরটা ভয়ে কাঁপছিল। কিন্তু তার ছায়াটা কাঁপছিল না। শ্রেয়া দেখল, রিয়ার ছায়াটা খুব ধীরে, প্রায় imperceptible গতিতে, তার মাথাটা তুলল। ছায়ার কোনো মুখ নেই, চোখ নেই, কিন্তু শ্রেয়ার মনে হলো, ছায়াটা সরাসরি তার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টিতে ছিল এক শীতল, বুদ্ধিদীপ্ত কৌতূহল, যা কোনো মানুষের হতে পারে না।
কিন্তু আসল আতঙ্ক শুরু হলো তার কয়েক মুহূর্ত পর। একযোগে, যেন কোনো অদৃশ্য পরিচালকের ইশারায়, বিদ্রোহটা সর্বাত্মক রূপ নিল।
আরিকের ছায়া, যা তার পেছনে দেওয়ালে হেলান দিয়ে স্থির হয়ে ছিল, সেটা হঠাৎ করেই নড়ে উঠল। এটা আর আগের মতো সামান্য কাঁপুনি বা ধীরগতির নড়াচড়া ছিল না। ছায়াটা যেন দেওয়াল থেকে তরল অন্ধকারের মতো গড়িয়ে মাটিতে নেমে এল। এর নড়াচড়া ছিল অপ্রাকৃতভাবে সাবীল, একটা ক্ষুধার্ত সাপের মতো। ছায়াটা মাটিতে পড়ে থাকা একটা ছুঁচালো পাথরের ছায়ার ওপর তার হাত রাখল। আগুনের আলোয় সবাই দেখল, সেই পাথরের ছায়াটা সাধারণ ছায়ার মতো ফ্যাকাসে নয়, বরং আরও ঘন, আরও কালো, যেন তার নিজস্ব ওজন আছে। আরিকের ছায়াটা সেই পাথরের ছায়াটাকে মাটি থেকে ‘তুলল’। আরিক নিজে কিছুই করেনি, কিন্তু তার নিজের হাতেও যেন একটা ভারী, শীতল পাথরের ওজন অনুভব হলো।
“আরিক, না!” শ্রেয়া প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, কারণ সে বুঝতে পারছিল কী হতে চলেছে।
আরিকের ছায়াটা তার হাতটা পেছনে নিয়ে গিয়ে, একজন দক্ষ খেলোয়াড়ের মতো নিশানা করে, জয়ের ছায়ার দিকে ছুঁড়ে দিল। সেই ছায়া-পাথরটা অন্ধকারের একটা বুলেটের মতো, বাতাসের মধ্যে দিয়ে উড়ে গেল এবং জয়ের ছায়ার কাঁধে গিয়ে আঘাত করল। কোনো শব্দ হলো না। কিন্তু যে মুহূর্তে ছায়া-পাথরটা জয়ের ছায়াকে স্পর্শ করল, একটা প্রায় অশ্রুত কিন্তু ভয়ঙ্কর শব্দ হলো—‘খসসস!’—যেন কেউ একটা মোটা রেশমি কাপড় ছিঁড়ে ফেলল।
“আহ্!” জয় একটা তীব্র, অমানুষিক যন্ত্রণার শব্দ করে উঠল। সে তার কাঁধটা চেপে ধরল। সেখানে কোনো আঘাতের চিহ্ন ছিল না, এক ফোঁটা রক্তও না। কিন্তু জয়ের মনে হচ্ছিল, তার কাঁধের ভেতরের মাংসপেশী আর স্নায়ুগুলো কেউ ছিঁড়ে ফেলছে। এ ছিল এক অদ্ভুত, শীতল যন্ত্রণা, যা শরীরকে নয়, সরাসরি চেতনাকে আঘাত করছিল।
এই ঘটনাটা তাদের মধ্যেকার শেষ বিশ্বাসটুকুও ভেঙে দিল। তারা আর একসাথে বসে থাকতে পারছিল না। একে অপরের ছায়ার ভয়ে তারা আগুন থেকে দূরে, নাটমন্দিরের আলাদা-আলাদা থামের আড়ালে আশ্রয় নিল। প্রত্যেকেই হয়ে উঠল এক-একটি নিঃসঙ্গ দ্বীপ, নিজের বিদ্রোহী ছায়ার সাথে এক ভয়ঙ্কর, নীরব যুদ্ধে লিপ্ত। আগুনটা এখন আর তাদের বন্ধু ছিল না, ছিল এক সাক্ষী, যার আলোয় তাদের এই ভয়ঙ্কর নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছিল।
এবার শুরু হলো ব্যক্তিগত অত্যাচার। ছায়াগুলো আর শুধু একে অপরকে আক্রমণ করছিল না, তারা তাদের নিজেদের মালিকদেরই মানসিক এবং শারীরিকভাবে ভাঙার চেষ্টা করছিল।
আরিক: সে একটা থামের পেছনে পিঠ দিয়ে বসেছিল। তার ছায়াটা সেই ছায়া-পাথরটা আবার তুলে নিয়েছিল। কিন্তু এবার সে আর কাউকে আক্রমণ করল না। ছায়াটা পাথরটা নিয়ে নিজেরই মাথার পাশে, কানপট্টী-তে ঠেকাল। আরিক সাথে সাথে তার নিজের কানপট্টী-তে একটা তীব্র, ঠেলে ধরা চাপ অনুভব করল, আর তার কানে বাজতে লাগল তার নিজেরই কণ্ঠের প্রতিধ্বনি, স্বপ্নের সেই শব্দটা—‘ব্যর্থ, ব্যর্থ, ব্যর্থ…’। তার নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা, তার নিজের জেদ, তার নিজের অহংকার—সবকিছুই এখন একটা ছায়া-পাথর হয়ে তার আত্মহত্যার কারণ হতে চাইছিল।
রিয়া: সে একটা নিচু দেওয়ালের কোণে গুটিয়ে ছিল। তার ছায়াটা তার শরীর থেকে আলাদা হয়ে, একটা মাকড়সার মতো ধীরে ধীরে, আগুনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। রিয়া তার শরীরে একটা অদ্ভুত টান অনুভব করছিল, যেন কোনো অদৃশ্য দড়ি দিয়ে কেউ তাকে আগুনের দিকে টানছে। তার মনে আগুনের প্রতি এক ভয়ঙ্কর আকর্ষণ তৈরি হচ্ছিল। তার ভয় ছিল বিস্মৃত হওয়ার, হারিয়ে যাওয়ার। তার ছায়াটা যেন তাকে সেই বিস্মৃতি থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য এক ভয়ঙ্কর, চূড়ান্ত পথ বেছে নিয়েছিল—আগুনে ঝাঁপ দিয়ে নিজের অস্তিত্বকে চিরতরে মুছে ফেলা।
জয়: সে তার ক্যামেরাটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বসেছিল। তার ছায়াটা তার শরীর থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিল এবং তার সাধের ক্যামেরার ছায়াটার ওপর বারবার পা দিয়ে আঘাত করছিল। প্রতিটা আঘাতের সাথে জয়ের মনে হচ্ছিল, যেন কেউ তার বুকের পাঁজরের ওপর ভারী হাতুড়ি দিয়ে ঘা মারছে। তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। তার ক্যামেরাটা ছিল তার চোখ, তার পরিচিত জগৎ, তার পরিচয়। তার ছায়াটা সেই পরিচয়কেই গুঁড়িয়ে দিচ্ছিল, আর তার সাথে গুঁড়িয়ে যাচ্ছিল জয়ের জীবনীশক্তি।
শ্রেয়া: তার ছায়াটা ছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর, কারণ সে কোনো শারীরিক যন্ত্রণা দিচ্ছিল না। শ্রেয়া একটা থামের গায়ে হেলান দিয়ে বসেছিল। তার ছায়াটা তার সামনে মাটিতে বসেছিল এবং তার লম্বা আঙুল দিয়ে মাটিতে সেই সর্পিল, গোলকধাঁধার মতো সঙ্কেতগুলো আঁকছিল, যা তারা দেওয়ালচিত্রে দেখেছিল। আর ছায়াটা যখন সেই সঙ্কেতগুলো আঁকছিল, শ্রেয়ার মাথার ভেতরে যেন কেউ জোর করে অজানা জ্ঞান, অজানা চিন্তা ঢুকিয়ে দিচ্ছিল। সে দেখছিল ছায়া-দেবতার জন্ম, সে অনুভব করছিল তান্ত্রিকের লোভ, সে শুনতে পাচ্ছিল গ্রামবাসীদের আর্তনাদ—সবকিছু তার চেতনার ওপর আছড়ে পড়ছিল। তার ভয়টা ছিল শারীরিক নয়, মানসিক ধর্ষণের। তার নিজের মন, তার শেষ আশ্রয়, সেটাও আর তার নিজের ছিল না।
তারা প্রত্যেকেই নিজেদের ব্যক্তিগত নরকের কারাগারে বন্দি ছিল। তারা বুঝতে পারছিল, ছায়াগুলো তাদের শুধু মারতে চাইছে না। তারা চাইছে তাদের ভাঙতে, তাদের চেতনাকে দুর্বল করতে, তাদের ইচ্ছাশক্তিকে ধ্বংস করতে। কারণ, একটা খালি শরীর, একটা ইচ্ছাশক্তিহীন খাঁচা—সেটাই হবে এই বিদ্রোহী ছায়াগুলোর জন্য আদর্শ কারাগার। ঠিক যেমনটা হয়েছিল শ্যামলগড়ের অভিশপ্ত গ্রামবাসীদের সাথে। বিদ্রোহটা ছিল আসলে দখল নেওয়ার প্রক্রিয়া। নতুন মালিক তার পুরনো বাড়িটা দখল করার আগে তাকে ভেতর থেকে ভেঙে দিচ্ছিল।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion