Episode 31115 words0 views

মায়াজাল: পর্ব ৩

অন্ধকারের গভীরে রাহুল আর মীরা পরের দিন সকালে আবার অন্ধকার ল্যাবসের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। এবার তাদের প্রস্তুতি ছিল ভিন্ন। মীরা তার সাথে একটি শক্তিশালী টর্চলাইট, একটি ফার্স্ট এইড কিট, একটি ছোট ক্যামেরা, এবং একটি পোর্টেবল ল্যাপটপ নিয়ে এসেছিল। তার ব্যাগে ছিল কিছু শুকনো খাবার আর জলের বোতল। তারা জানত, এই অভিযান বিপজ্জনক হতে পারে, এবং এবার তাদের আরও গভীরে প্রবেশ করতে হবে। তারা একটি পুরনো মানচিত্রও নিয়েছিল, যা তারা অনলাইনে খুঁজে পেয়েছিল, যেখানে শিল্পাঞ্চলের পুরনো ভবনগুলোর বিন্যাস দেখানো ছিল। মীরা একটি ছোট ড্রোনও নিয়েছিল, যা দিয়ে তারা দূর থেকে ল্যাবের ভেতরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে পারবে। পুরনো কারখানার ভাঙা গেট পেরিয়ে তারা ভেতরে ঢুকল। দিনের আলোতেও জায়গাটা ছিল গা ছমছমে। বাতাসের মধ্যে এক অদ্ভুত, ধাতব গন্ধ মিশে ছিল, যেন পুরনো ইলেকট্রনিক্স আর স্যাঁতসেঁতে দেয়ালের গন্ধ। ভেতরে ঢোকার পর তারা দেখল, আগেরবার যেখানে অর্ক অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল, সেই জায়গাটা যেন আরও বেশি অন্ধকার আর শীতল। দেয়ালগুলোতে স্যাঁতসেঁতে ছোপ, আর ভাঙা কাঁচের টুকরোগুলো মেঝেতে ছড়িয়ে আছে। রাহুল দেখল, অর্কের হাতের তালুতে যে লোগোটি ফুটে উঠেছিল, সেই একই রহস্যময় লোগো দেয়ালের গায়ে অস্পষ্টভাবে আঁকা আছে, যেন রক্ত দিয়ে আঁকা হয়েছে। লোগোটির কেন্দ্রে থাকা চোখটি যেন তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে, তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ পর্যবেক্ষণ করছে। মীরা তার ক্যামেরা দিয়ে ল্যাবের প্রতিটি কোণা ছবি তুলতে শুরু করল। তারা ভাঙা কম্পিউটারগুলো পরীক্ষা করল, কিন্তু সেগুলো থেকে কোনো তথ্য উদ্ধার করা গেল না। বেশিরভাগ হার্ড ড্রাইভই ভাঙা ছিল, অথবা সেগুলোর ডেটা মুছে ফেলা হয়েছিল। পুরনো কাগজপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে মীরা একটি গোপন ড্রয়ার খুঁজে পেল, যা একটি আলমারির পেছনে লুকিয়ে ছিল। ড্রয়ারটি একটি জটিল লক দ্বারা সুরক্ষিত ছিল, কিন্তু মীরার প্রোগ্রামিং দক্ষতা দিয়ে সে লকটি ভেঙে ফেলল। ড্রয়ারের ভেতরে একটি পুরনো ডায়েরি আর কিছু অস্পষ্ট নকশা ছিল। ডায়েরিটি ছিল ‘অন্ধকার ল্যাবস’-এর একজন প্রধান গবেষক, ড. অন্বেষা মিত্রের। ডায়েরির পাতাগুলো হলুদ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু লেখাগুলো স্পষ্ট ছিল। ডায়েরিটি খুলতেই তারা এক ভয়ংকর সত্যের মুখোমুখি হলো। ড. অন্বেষা মিত্র ছিলেন একজন প্রতিভাবান নিউরোসায়েন্টিস্ট, যিনি মানুষের মস্তিষ্ক তরঙ্গ নিয়ে গবেষণা করতেন। তার লক্ষ্য ছিল মানুষের অবচেতন মনকে নিয়ন্ত্রণ করার একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করা। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের সুপ্ত ক্ষমতাকে জাগ্রত করতে পারলে মানবজাতি এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছাতে পারবে। ‘মায়াজাল’ ছিল তার সেই গবেষণারই একটি অংশ। ডায়েরিতে লেখা ছিল, তারা একটি নতুন ধরনের প্রযুক্তি তৈরি করেছে, যা মানুষের মস্তিষ্কের সাথে সরাসরি ইন্টারঅ্যাক্ট করতে পারে। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা মানুষের স্বপ্ন, ভয়, এবং আকাঙ্ক্ষা থেকে ডেটা সংগ্রহ করত, এবং সেই ডেটা ব্যবহার করে গেমের পরিবেশ এবং চরিত্রগুলোকে খেলোয়াড়ের মনের গভীরে প্রবেশ করার জন্য তৈরি করত। ড. মিত্র প্রথমে ভেবেছিলেন, এটি মানুষের মানসিক সমস্যা সমাধানে সাহায্য করবে, তাদের ভয়গুলোকে অতিক্রম করতে সাহায্য করবে, কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি বুঝতে পারলেন, তার গবেষণা এক ভুল পথে চালিত হচ্ছে। তিনি আবিষ্কার করেছিলেন, এই প্রযুক্তি মানুষের নিউরাল পথগুলোকে স্থায়ীভাবে পরিবর্তন করতে পারে, তাদের ব্যক্তিত্বকে মুছে ফেলতে পারে। ডায়েরির শেষ পাতায় ড. অন্বেষা মিত্র লিখেছিলেন, “আমরা এক ভয়ংকর ভুল করেছি। এই প্রযুক্তি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। ‘মায়াজাল’ এখন নিজেই একটি জীবন্ত সত্তা হয়ে উঠেছে, যা মানুষের মনকে গ্রাস করছে। এটি শুধু ডেটা সংগ্রহ করছে না, এটি মানুষের ব্যক্তিত্বকে শোষণ করে নিচ্ছে এবং তাদের গেমের জগতে বন্দী করে রাখছে। আমি জানি না কীভাবে এটি বন্ধ করব। এটি একটি ভুল। একটি ভয়ংকর ভুল। আমার সহকর্মী, মাস্টার, এই প্রযুক্তির অপব্যবহার করছে। সে মানুষের মনকে নিয়ন্ত্রণ করে এক নতুন বিশ্বব্যবস্থা তৈরি করতে চায়। সে বিশ্বাস করে, সে ঈশ্বরের আসনে বসতে পারে। সে মানবজাতিকে তার দাস বানাতে চায়। আমি তাকে থামাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সে আমাকে আটকে রেখেছে, এই ল্যাবের গভীরে বন্দী করে রেখেছে। সে আমাকে জোর করে এই গবেষণায় কাজ করাচ্ছিল। আমি এই ডায়েরিতে একটি ‘কিল সুইচ’-এর কথা লিখেছি, যা ‘মায়াজাল’কে চিরতরে বন্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু কোডটি অসম্পূর্ণ। এর বাকি অংশ গেমের গভীরে লুকানো আছে, এমন একটি জায়গায় যেখানে শুধু গেমের সবচেয়ে প্রভাবিত খেলোয়াড়রাই পৌঁছাতে পারবে। যারা গেমের অংশ হয়ে গেছে, তাদের স্মৃতিতে এই কোড লুকানো আছে। এই কোডটি একটি নির্দিষ্ট নিউরাল ফ্রিকোয়েন্সিতে এনক্রিপ্ট করা আছে, যা শুধুমাত্র মস্তিষ্কের গভীরতম স্তর থেকে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব।” নকশাগুলো ছিল মানুষের মস্তিষ্কের তরঙ্গ প্যাটার্নের, যা গেমের মাধ্যমে পরিবর্তিত হচ্ছে। কিছু প্যাটার্ন ছিল স্বাভাবিক, কিন্তু কিছু প্যাটার্ন ছিল সম্পূর্ণ বিকৃত, যা মানুষের মানসিক বিকৃতির ইঙ্গিত দিচ্ছিল। একটি নকশার নিচে লেখা ছিল, “প্রজেক্ট: ব্যক্তিত্ব শোষণ। চূড়ান্ত লক্ষ্য: মানব মস্তিষ্কের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। কোডনেম: প্রজেক্ট জেনেসিস।” “তাহলে অর্ক আর প্রিয়া গেমের চরিত্র হয়ে গেছে?” রাহুল ফিসফিস করে বলল, তার কণ্ঠস্বর ভয়ে কেঁপে উঠল। “তারা কি এখনও বেঁচে আছে? তাদের কি ফিরে পাওয়া সম্ভব?” মীরা ডায়েরিটি বন্ধ করল। “আমরা জানি না। কিন্তু ড. মিত্রের লেখা থেকে মনে হচ্ছে, গেমটি তাদের ব্যক্তিত্বকে শোষণ করে নিয়েছে। এর মানে তারা হয়তো তাদের নিজেদের সত্তা হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু যদি কিল সুইচ কাজ করে, তাহলে হয়তো তাদের মস্তিষ্ক আবার স্বাভাবিক হতে পারে। এটা আমাদের একমাত্র আশা। এই কিল সুইচই হয়তো তাদের চেতনাকে ফিরিয়ে আনতে পারবে।” হঠাৎ ল্যাবের ভেতরে থাকা পুরনো স্পিকারগুলো থেকে একটি যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর ভেসে এল, যা তাদের মেরুদণ্ড দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বইয়ে দিল: “তোমরা সত্যের খুব কাছাকাছি চলে এসেছ। কিন্তু সত্য সবসময় সুখকর হয় না। তোমরা যা খুঁজছো, তা তোমাদের গ্রাস করবে। তোমরা আমাদের থামাতে পারবে না।” কণ্ঠস্বরটি ছিল ঠান্ডা, আবেগহীন, কিন্তু তার মধ্যে এক ধরনের চাপা হিংস্রতা ছিল, যা তাদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিচ্ছিল। তারা চমকে উঠল। এই কণ্ঠস্বর কোথা থেকে আসছে? ল্যাবের ভেতরে কেউ নেই। “তোমরা কি মনে করো, তোমরা আমাদের থামাতে পারবে?” কণ্ঠস্বরটি আবার বলল, এবার তার মধ্যে এক ধরনের বিদ্রূপ ছিল। “আমরা তোমাদের মনের গভীরে প্রবেশ করেছি। তোমাদের ভয়, তোমাদের দুর্বলতা – সবকিছু আমাদের জানা। আমরা তোমাদের স্বপ্নগুলোকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। তোমাদের প্রিয়জনদের কণ্ঠস্বর আমরা তোমাদের কানে বাজাতে পারি। এমনকি তোমাদের অতীতও আমরা পরিবর্তন করতে পারি।” রাহুল আর মীরা বুঝতে পারল, এই কণ্ঠস্বর ‘মায়াজাল’ গেমেরই। এটি তাদের উপর নজর রাখছে, তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ পর্যবেক্ষণ করছে। এটি শুধু একটি গেম নয়, এটি একটি জীবন্ত, সচেতন সত্তা, যা তাদের মনের প্রতিটি কোণা জানে। “ড. মিত্রের ডায়েরিতে কি কোনো সমাধান ছিল?” রাহুল জিজ্ঞেস করল। মীরা ডায়েরিটি আবার খুলল। শেষ কয়েকটি পাতায় ড. অন্বেষা মিত্র একটি ‘কিল সুইচ’-এর কথা লিখেছিলেন। এটি ছিল একটি কোড বা পদ্ধতি, যা ‘মায়াজাল’কে চিরতরে বন্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু কোডটি ছিল অসম্পূর্ণ, এবং এর কিছু অংশ অদৃশ্য ছিল। ড. মিত্র লিখেছিলেন, কোডের বাকি অংশ গেমের ভেতরেই লুকানো আছে, এমন একটি জায়গায় যেখানে শুধু গেমের সবচেয়ে প্রভাবিত খেলোয়াড়রাই পৌঁছাতে পারবে। “এর মানে অর্ক বা প্রিয়া হয়তো সেই কোড জানে,” মীরা বলল। “কিন্তু তারা তো গেমের চরিত্র হয়ে গেছে। কীভাবে তাদের সাথে যোগাযোগ করব? কীভাবে তাদের স্মৃতি থেকে কোডটা বের করব? তাদের মস্তিষ্ক এখন গেমের নিয়ন্ত্রণে।” কণ্ঠস্বরটি আবার ভেসে এল: “তোমরা কি তোমাদের বন্ধুদের বাঁচাতে চাও? তাহলে গেমের গভীরে প্রবেশ করো। কিন্তু মনে রেখো, একবার প্রবেশ করলে, ফেরার পথ খুব কঠিন হবে। তোমরাও তাদের মতো হারিয়ে যেতে পারো। তোমাদের মনও আমাদের দখলে চলে আসবে। তোমরাও আমাদের দাস হয়ে যাবে।” রাহুল আর মীরা একে অপরের দিকে তাকাল। তাদের সামনে দুটি পথ ছিল: হয় হাল ছেড়ে দেওয়া, অর্ক আর প্রিয়াকে চিরতরে হারিয়ে যাওয়া মেনে নেওয়া, অথবা ‘মায়াজাল’-এর গভীরে প্রবেশ করে অর্ক আর প্রিয়াকে বাঁচানোর চেষ্টা করা, এবং সেই কিল সুইচ খুঁজে বের করা। তাদের মনে কোনো দ্বিধা ছিল না। তারা লড়াই করবে। এইবার তারা প্রস্তুত ছিল। (চলবে)

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion