অরূপ তার একমাত্র বিশ্বস্ত সহযোগী আনোয়ারকে নিয়ে বের হলো। ধ্রুবর সংকেত এবং নগেন সাধুর কথা মিলিয়ে তারা সিদ্ধান্ত নিল, রহস্যের সূত্র লুকিয়ে আছে জাঙ্গালদের কোনো প্রাচীন ধর্মস্থানে, যা হয়তো জোয়ারের জলে তলিয়ে গেছে। জাঙ্গালরা তাদের পবিত্র বস্তুগুলিকে এইভাবেই প্রকৃতির কাছে লুকাতো।
আনোয়ার তার বাবার কাছে শোনা একটি কিংবদন্তির কথা মনে করল: "আমার বাবা বলতেন, গ্রামের কাছে একটি ছোট টিলা ছিল, যা অমাবস্যার জোয়ারে ডুবে যেত। সেই টিলার উপরে জাঙ্গালদের একটি 'ডুবো-মন্দির' ছিল। সেখানেই নাকি তারা তাদের পবিত্র জিনিসপত্র রাখত।"
অরূপ এবং আনোয়ার পরের অমাবস্যার রাতে সেই টিলার কাছে পৌঁছাল। জোয়ারের জল যখন নামতে শুরু করল, তখন মাটির নিচে একটি পাথরের কাঠামো আবছাভাবে দেখা গেল।
অরূপ এবং আনোয়ার দড়ি বেঁধে সেই ডুবো-মন্দিরের প্রবেশপথে প্রবেশ করল। ভেতরে জল থইথই করছে, আর শেওলায় ঢাকা। এখানকার বাতাস ছিল ভারী এবং মাটি ও লবণের তীব্র গন্ধ। টর্চের আলো ফেলে তারা দেখল, এটি আসলে গুহার মতো একটি ছোট মন্দির।
দেওয়াল জুড়ে প্রাচীন জাঙ্গাল লিপিতে কিছু ছবি আঁকা। ছবিগুলো ছিল ভয়ংকর এবং রহস্যময়।
১. প্রথম ছবি: একজন আদিম জাঙ্গাল নেতা (সম্ভবত ভবানীর পূর্বপুরুষ) গভীর জঙ্গলে দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে একটি অন্ধকার সত্তা যা দেখতে অনেকটা ধোঁয়ার মতো। সত্তাটি এক হাতে একটি আলোর দণ্ড তুলে দিচ্ছে। এর নিচে লেখা "জীবন শক্তির বিনিময়"। (চুক্তি)
২. দ্বিতীয় ছবি: দণ্ডটি ব্যবহার করে জাঙ্গাল নেতা সত্তাটিকে একটি পাথরের খাঁচার মধ্যে বন্দি করছে। খাঁচার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে জাঙ্গাল সম্প্রদায়ের নারীরা, তাদের হাতে তারা পাতার প্রতীক। (নিয়ন্ত্রণ)
৩. তৃতীয় ছবি (অসম্পূর্ণ): দণ্ডটি তিনটি টুকরোয় ভাঙা। একটি টুকরো নদীতে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। নিচে লেখা একটি শব্দ—"নিয়ম"। এই নিয়মটি ছিল: যদি দণ্ড জোড়া লাগে, তবে জাঙ্গালদের সব ধ্বংস হবে।
অরূপের মনে হলো, ভবানী যখন দণ্ডটি জোড়া লাগিয়েছিল, তখন সে কেবল ক্ষমতা চায়নি, সে চেয়েছিল সেই প্রাচীন সত্তাকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করে তার মেয়ের আত্মার কাছে পৌঁছাতে। কিন্তু জাঙ্গালরা নিজেরাই দণ্ডটি ভেঙে ফেলেছিল সেই সত্তাকে যেন আর কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে—এটাই ছিল তাদের 'নিয়ম'।
তারা গুহার ভেতরে খুঁজতে খুঁজতে একটি ছোট কাঠের সিন্দুক পেল, যা শ্যাওলা আর কাদার নিচে চাপা ছিল। সিন্দুকের ঢাকনা খোলা। ভেতরে কোনো জাদুদণ্ড নেই।
অরূপের বুক হতাশায় মুচড়ে উঠল। তৃতীয় টুকরোটি কেউ নিয়ে গেছে।
"ছোটবাবু," আনোয়ার হতাশ হয়ে বলল, "নগেন সাধু আমাদের সবটা বলেননি। এই রহস্য আরও গভীরে।"
অরূপ যখন বেরোনোর জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল, তখন তার টর্চের আলোয় একটি বিষয় চোখে পড়ল। সিন্দুকের ভেতর নয়, বরং সিন্দুকের ঢাকনার উল্টো দিকে, একটি নতুন করে খোদাই করা নাম: 'নরোত্তম'। খোদাইটা বেশ সাম্প্রতিক, যেন কোনো তীক্ষ্ণ যন্ত্র দিয়ে করা হয়েছে।
নরোত্তম! নামটি সম্পূর্ণ অপরিচিত। এই নরোত্তম কে? ভবানীর শিষ্য, নাকি অন্য কেউ? তার উদ্দেশ্য কী?
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion