সেই রাতে, যখন পূর্ণিমার চাঁদ মেঘের আড়াল থেকে উঁকি মারছে, অরূপ সেই প্রস্তরীভূত অরণ্যে প্রবেশ করল। আলোর স্তম্ভটি এবার আরও বেশি সক্রিয়। কম্পনশীল আলো থেকে একটি মেয়ের কান্না বা অস্ফুট আহ্বান শোনা যাচ্ছে, যেন কেউ মুক্তি চাইছে। এই আহ্বান ছিল একাধারে করুণ এবং ভয়ঙ্কর, যা মনকে নরম করে আবার আঘাত করে।
অরূপ গাছের আড়াল থেকে উঁকি মারল। স্তম্ভের ঠিক সামনে, দাঁড়িয়ে আছে ভবানী। তার হাতে সেই লম্বা জাদু-দণ্ড। তার চোখ দুটো যেন আগুনের স্ফুলিঙ্গ, আর মুখ দিয়ে বিড়বিড় করে সে প্রাচীন মন্ত্র পাঠ করছে—সে এখন সম্পূর্ণ উন্মাদ। তার চোখে এখন কেবলই উন্মাদনা আর পিতার ব্যাকুলতা।
স্তম্ভের ডানদিকে পাথরের বেদিতে শুয়ে আছে ধ্রুব, জ্ঞানশূন্য অবস্থায়। ধ্রুবর শরীর থেকে রূপালি আলো বেরিয়ে এসে স্তম্ভের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এটি ধ্রুবর প্রাণশক্তির শেষ আভা। আর স্তম্ভের ভেতরে, সেই আলোর ঘূর্ণির মধ্যে, একটি মেয়ের আবছা মুখ ভেসে উঠছে—সেটাই হয়তো উর্মিলার আত্মা! তার মুখের অভিব্যক্তি ছিল বিভ্রান্ত এবং ব্যথিত।
"বাবা... আমি আসছি..." উর্মিলার ক্ষীণ কণ্ঠস্বর যেন পুরো জঙ্গলকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। ভবানী তার জাদু-দণ্ডটি স্তম্ভের দিকে তাক করে ধরতেই, আলোটি আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
অরূপের রাগ এবার করুণায় বদলে গেল, কিন্তু তার ভাইকে বাঁচাতে হবে। সে নিঃশব্দে ভবানীর পিছনে গিয়ে মহাবিষের লতাটি বের করল এবং আগুন ধরিয়ে দিল।
ঘন সবুজ ধোঁয়া ভবানীর দিকে এগিয়ে গেল। ধোঁয়া নাকে যেতেই ভবানী যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গিয়ে পিছনে তাকাল। তার উন্মত্ত চোখজোড়া মুহূর্তে যেন শান্ত হয়ে গেল, সেই সুযোগটা নিতে হবে।
"কে! আমার কন্যার প্রত্যাবর্তন কেউ আটকাতে পারবে না!" ভবানী তীব্র, চাপা গর্জন করে বলল।
অরূপ দ্রুত পকেট থেকে মহাপাড়ের তারা পাতা বের করে মন্ত্রের প্রতীকগুলোর ঠিক মাঝখানে ছুড়ে মারল।
পাতাটি ভূমিতে স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে স্তম্ভের আলোর মধ্যে একটা তীব্র আঁচড়ের শব্দ হলো। আলোর কম্পন সাময়িকভাবে থমকে গেল, আর উর্মিলার আবছা মুখটা যন্ত্রণায় অদৃশ্য হয়ে গেল।
এই সুযোগ! ভবানী বিভ্রান্ত হয়েছে।
অরূপ মনের সব শক্তি একত্রিত করে নগেন সাধুর শেখানো বন্ধনী মন্ত্রটি উচ্চারণ করল: "ওঁ কালানলস্য স্থিতং বন্ধনম!" (Ohm Kalanolasya Sthitam Bandhanam!)
নীল আভা সাপের মতো ভবানীর শরীর পেঁচিয়ে ধরল। ভবানী চিৎকার করে উঠল, কিন্তু তার জাদু-দণ্ডটি হাত থেকে পড়ে গেল না।
"আলোর স্তম্ভ, এবার এর জীবনশক্তি গ্রাস কর!" ভবানী উন্মত্তের মতো চিৎকার করল।
আলোটা এবার দ্বিধাহীনভাবে অরূপের দিকে ছুটে আসতে লাগল। অরূপের শরীর অসাড় হয়ে আসছে। সে বুঝতে পারল, মন্ত্র ভবানীকে ধরে রাখতে পারছে না। এই দরজা বন্ধ করতে হলে কেবল জাদুকরকে নয়, স্বয়ং প্রবেশদ্বারকেই আঘাত করতে হবে।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion