অরূপের জীবনে স্বাভাবিকতা আর ফিরল না। ধ্রুব বেঁচে ফিরেছে, কিন্তু সে যেন এক অন্য জগতে বাস করছে। তার চোখ দুটো সবসময় উদাস, আর সে মাঝে মাঝে মৃদু ফিসফিস করে কথা বলে—"আলো... আলো নয়... অন্ধকার...।" ধ্রুবর ফটোগ্রাফির সরঞ্জাম ছুঁয়ে দেখলেও তার হাত কাঁপে।
এদিকে, বনবিভাগের অফিসিয়াল রিপোর্টে ধ্রুবর অন্তর্ধান ও প্রত্যাবর্তনকে 'অত্যন্ত বিরল বন্যপ্রাণী আক্রমণ ও মানসিক ট্রমা' হিসেবে উল্লেখ করা হলো। কিন্তু অরূপ জানত, এই গল্প কেউ বিশ্বাস করবে না।
এর চারদিন পর, অরূপের অফিসে এলেন এক নতুন অতিথি। সুঠাম দেহ, চোখে তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এবং মুখে কঠোরতা। তিনি হলেন রাজ্য গোয়েন্দা বিভাগের স্পেশাল ইউনিটের অফিসার অমল রায়। তার পরনে ছিল সাধারণ স্যুট, যা সুন্দরবনের আর্দ্রতার সঙ্গে একেবারেই বেমানান, কিন্তু তার উপস্থিতিই বুঝিয়ে দিচ্ছিল, তিনি এখানকার সাধারণ নিয়ম মানতে আসেননি।
"অরূপ সেন, আমার কাছে ডঃ মিতালী বসুর ফাইল আছে," অমল রায় সরাসরি টেবিলের ওপরে একটি ফাইল রেখে দিলেন। "মিতালী বসুর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাটা রহস্যজনক। আরও রহস্যজনক হলো আপনার দেওয়া প্রস্তরীভূত প্রাণী এবং গাছপালার ফরেনসিক রিপোর্ট। সেই পাথরগুলো কোনো পরিচিত উপাদান দিয়ে তৈরি নয়। রাসায়নিকভাবে এটি 'অজানা, দ্রুত ক্ষয়কারী সিলিকা'। এটি কোনো সাধারণ ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তন নয়, মিঃ সেন।"
অমল রায় অরূপের চোখে চোখ রেখে বললেন, "কিন্তু মিঃ সেন, আমার প্রশ্ন অন্য। এত বড় প্রাকৃতিক বা অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা ঘটল, আর আপনি আপনার ভাইকে নিয়ে ফিরে এলেন, কিন্তু জাদুকর ভবানীর মৃতদেহ বা তার জাদুদণ্ড কোথায়? আপনি কেবল দুটি ভাঙা কাঠের টুকরো জমা দিয়েছেন।" তার কণ্ঠস্বর ছিল ধীর, কিন্তু ইস্পাতের মতো ধারালো।
অরূপ বুঝতে পারল, অমল রায় কোনো সাধারণ অফিসার নন। তিনি কেবল নিয়ম মানতে আসেননি, এসেছেন সত্যের গভীরে যেতে। অরূপ তার যুক্তিবাদী মনকে সরিয়ে রেখে সত্যটা বলতে পারল না। জাদুকর, মৃত্যুপুরী, তারা পাতা—এসব বললে সে নিজেই পাগল প্রমাণিত হবে।
অরূপ শুধু বলল, "আমি আত্মরক্ষার জন্য গুলি চালিয়েছিলাম। যা হওয়ার হয়েছে, সবই প্রকৃতির খেয়াল। জঙ্গল সবকিছুকে তার ভেতরে টেনে নিয়েছে।"
"প্রকৃতির খেয়াল নয়," অমল রায় ফাইল থেকে একটি ছবি বের করলেন। ছবিটি ছিল ভবানীর জাদুদণ্ডের দুটি ভাঙা টুকরোর। "এই দণ্ডটি তিনটি টুকরোয় ভাঙা ছিল। তৃতীয় টুকরোটি কোথায়? আপনার মতে এটি কী ছিল? একটি ডাল, নাকি অস্ত্র?" অমল রায়ের চোখগুলো ছিল অত্যন্ত পর্যবেক্ষণশীল, যেন তিনি অরূপের মুখের প্রতিটি পেশীর নড়াচড়া দেখছেন।
অরূপ নীরব রইল। অমল রায় ধীরে ধীরে বললেন, "মিঃ সেন, আপনি এই বিষয়ে মুখ খুলতে রাজি না হলে, আমি ধরে নেব, আপনি কোনো গোপন অভিযানের তথ্য লুকাচ্ছেন। এই মুহুর্তে আপনাকে আপনার দায়িত্ব থেকে সাময়িক বরখাস্ত (Suspension) করা হলো। আপনি এই এলাকা ছেড়ে যেতে পারবেন না।"
অরূপের জগৎটা যেন আরও ছোট হয়ে গেল। এক হাতে কর্তৃপক্ষের চাপ, আর অন্য হাতে অজানা এক জাদুকরী বিপদের হাতছানি। সে বুঝতে পারল, তার লড়াইটা শেষ হয়নি, কেবল পটভূমি পাল্টেছে।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion