করিডোরের শেষে দুটো দরজা। একটাতে লেখা 'স্টোরেজ'। অন্যটাতে 'স্টুডিও'।
"স্টুডিওতে তো আমরা গেছিলাম," অনন্যা বলল।
"কিন্তু এটা বেসমেন্টের স্টুডিও। আসল জায়গা এটাই," শুভ 'স্টুডিও' লেখা দরজাটা ঠেলল।
দরজাটা লক করা ছিল না। খুলে গেল।
ভেতরের ঘরটা দেখে অনন্যা আর শুভ জমে গেল।
এটা একটা ল্যাবরেটরি। অথবা একটা অপারেশন থিয়েটার।
ঘরের মাঝখানে একটা সার্জিক্যাল টেবিল। তার ওপর উজ্জ্বল আলো। চারপাশে ট্রলিতে সাজানো ছুরি, কাঁচি, স্ক্যালপেল, ইলেকট্রিক স'। আর কাঁচের আলমারিতে থরে থরে সাজানো কেমিক্যালের বোতল।
আর সবথেকে ভয়ঙ্কর দৃশ্য ছিল অন্য।
ঘরের একটা দেওয়াল জুড়ে, ফ্লোর থেকে সিলিং, কাঁচের জারে, ফরমালিনের মধ্যে ভাসছে... মুখ।
মানুষের মুখ।
সদ্য কাটা, নিখুঁতভাবে সংরক্ষণ করা।
"ওহ গড," শুভর হাত থেকে ক্যামেরাটা পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো।
অনন্যা দেওয়ালের দিকে এগিয়ে গেল। দশ... বারো... পনেরোটা মুখ। কোনোটা যুবকের, কোনোটা যুবতীর। সবাই খুব সুন্দর। নিখুঁত। প্রতিটা জারের নিচে একটা ছোট প্লেটে নাম লেখা।
'তানিয়া দেশাই - ২০০৮'
'অমিত ভার্মা - ২০১০'
'প্রিয়া শর্মা - ২০১৪'
"ওরা সবাই নিখোঁজ," অনন্যা কাঁপতে কাঁপতে বলল। "গত সতেরো বছরে যারা যারা নিখোঁজ হয়েছে, যাদের কোনোদিন খোঁজ পাওয়া যায়নি... যাদের কেস পুলিশ বন্ধ করে দিয়েছে..."
তার চোখ একটা নির্দিষ্ট জারের ওপর আটকে গেল। সবথেকে নতুন।
কাঁচের ওপারে, ফরমালিনের মধ্যে, একজোড়া বোজা চোখ। শান্ত, সুন্দর।
'রিয়া সেন - ২০২৩'
অনন্যার বন্ধু রিয়া সেন।
তার 'নিখুঁত' মুখটা একটা কাঁচের জারে ভাসছে।
অনন্যা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। সে মেঝেতে বসে পড়ল। তার গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোলো না। একটা তীব্র, যন্ত্রণাদায়ক আর্তনাদ তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল, কিন্তু পারল না।
শুভ কোনোক্রমে রিয়ার জারের ছবিটা তুলল। তার নিজেরও চোখে জল।
"অনন্যা, ওঠ!" শুভ তাকে টেনে তুলল। "আমাদের বেরোতে হবে! এক্ষুনি! পুলিশকে জানাতে হবে!"
"দাঁড়া," অনন্যার চোখ পড়ল আর একটা দরজায়। তাতে লেখা 'প্রাইভেট স্টুডিও'।
"আসল জিনিসটা ওখানেই আছে," অনন্যা ফিসফিস করল।
সে দরজাটা ঠেলে খুলল।
ভেতরের ঘরটা অন্ধকার। শুধু একটা স্পটলাইট জ্বলছে। সেই আলোটা পড়েছে একটা মূর্তির ওপর।
এটা কোনো ব্রোঞ্জ বা মাটির মূর্তি নয়।
এটা... মানুষের দেহাংশ দিয়ে সেলাই করা একটা মূর্তি। একটা "নিখুঁত" মানব শরীর তৈরির চেষ্টা। তানিয়া দেশাইয়ের নিখুঁত হাত, অমিত ভার্মার সুগঠিত বুক... বিভিন্ন মানুষের "সেরা" অংশগুলো নিয়ে তৈরি একটা বীভৎস কোলাজ।
"মাস্টারপিস..." অনন্যা বিড়বিড় করল।
"বেরোবে?"
সেই শান্ত, পরিচিত গলা।
দরজায় ডক্টর অরিন্দম রায় দাঁড়িয়ে। তার পরনে সার্জিক্যাল স্ক্রাবস। তার হাতে একটা সিরিঞ্জ। তার পেছনে সেই প্লাস্টিক অ্যাপ্রন পরা লোকটা।
"আমি তো ভেবেছিলাম, তোমরা আসবে না। অনন্যা, তোমাকে আমার গ্যালারি কেমন লাগল? আর এটা... এটা আমার 'মাস্টারপিস'। আমার বাবা পাথর দিয়ে নিখুঁত মূর্তি গড়তেন। আমি গড়ি আসল মাংস দিয়ে। আমি ঈশ্বরের ভুলগুলো শুধরে দিই।"
"তুমি... তুমি একটা দানব!" অনন্যা চিৎকার করে উঠল।
"দানব? না," অরিন্দম রায় এগিয়ে এলেন। "আমি একজন শিল্পী। আমি সৌন্দর্যকে অমরত্ব দিই। এই মুখগুলো দেখেছো? প্রতিটা নিখুঁত। জীবন ওদের নষ্ট করে দিত। বলিরেখা, বয়স, অসুখ... আমি ওদেরকে সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়েছি। আমি ওদেরকে 'নিখুঁত' মুহূর্তে থামিয়ে দিয়েছি।"
"তুমি রিয়াকে খুন করেছ!"
"খুন? খুব স্থূল একটা শব্দ। আমি ওকে রূপান্তরিত করেছি। ওর মুখটা ছিল নিখুঁত। আমার 'মাস্টারপিস'-এর জন্য ঠিক যেমনটা দরকার ছিল।"
"পুলিশ আসছে," শুভ মরিয়া হয়ে বলল।
"পুলিশ?" অরিন্দম রায় হাসলেন। "তারা যখন আসবে, তখন অনেক দেরি হয়ে যাবে। তোমরা আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহ দেখে ফেলেছ। আমি তো তোমাদের আর বাইরে যেতে দিতে পারি না।"
তিনি অ্যাপ্রন পরা লোকটাকে ইশারা করলেন। "অরুণ, ওঁর ক্যামেরাটা নিয়ে নাও। আর ওঁর মুখটা আমার পছন্দ নয়। ওটা নষ্ট করে দাও।"
অরুণ শুভর দিকে এগিয়ে গেল। শুভ তার ক্যামেরা দিয়ে লোকটাকে মারার চেষ্টা করল, কিন্তু অরুণ একটা পেশাদার ঘুসিতে শুভকে অজ্ঞান করে ফেলল।
"শুভ!" অনন্যা ছুটে যেতে চাইল।
"আহা," অরিন্দম রায় অনন্যার পথ আটকালেন। "চিন্তা কোরো না। ওর জন্যও আমার একটা পরিকল্পনা আছে। কিন্তু তুমি..."
তিনি অনন্যার মুখের কাছে ঝুঁকে এলেন। তার চোখ দুটো জ্বলছে।
"তোমার মুখটা... রিয়ার মতো নিখুঁত নয়। অনেক খুঁত। কিন্তু তোমার চোখ... তোমার চোখে একটা আগুন আছে। একটা জীবন আছে। আমি ভাবছি, তোমার জন্য আমার কালেকশনে একটা বিশেষ জায়গা বানাতে হবে। তোমার চোখ দুটো আমি সংরক্ষণ করব।"
তিনি সিরিঞ্জটা অনন্যার গলার কাছে ধরলেন।
"ঘুমিয়ে পড়ো, অনন্যা। তোমার রূপান্তর শুরু হবে।"
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion