Episode 3658 words0 views

তৃতীয় অধ্যায়: মুখোশ

ইন্টারভিউ প্রায় এক ঘণ্টা চলল। অরিন্দম রায় অনর্গল কথা বলে গেলেন—শিল্প, জীবন, মৃত্যু, আর তার দর্শনের কথা। তার প্রতিটি কথা ছিল ধারালো, গভীর, কিন্তু অনন্যার কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল। লোকটার চোখে চোখ রাখা যায় না। মনে হয়, তিনি যেন অনন্যার ভেতরটা এক্স-রে মেশিনের মতো দেখতে পাচ্ছেন। তার শান্ত ভাবটা কেমন যেন অস্বাভাবিক, যেন তৈরি করা। "শুভ, তুমি বরং ওই কোণ থেকে মূর্তির ডিটেলসগুলো নাও। আমি একটু স্টুডিওটা ঘুরে দেখছি," অনন্যা শুভকে ইশারা করল, এই সম্মোহনী পরিবেশ থেকে একটু মুক্তি পাওয়ার জন্য। অরিন্দম রায় মৃদু হাসলেন। "নিশ্চয়ই। আমার সৃষ্টিদের দেখুন। ওরা কথা বলতে পারে না, কিন্তু ওদের অনেক গল্প আছে।" অনন্যা স্টুডিওর পেছনের দিকে এগিয়ে গেল। এখানে আলো কম। জিনিসপত্র অগোছালো। একটা বড় টেবিলের ওপর মাটির তাল, প্লাস্টারের ছাঁচ, আর অদ্ভুত সব যন্ত্রপাতি—সার্জিক্যাল নাইফ, স্ক্যালপেল, ডেন্টাল ইকুইপমেন্টের মতো দেখতে সূক্ষ্ম সব যন্ত্র। অনন্যার বুকটা হঠাৎ ধড়াস করে উঠল। টেবিলের এক কোণে, একটা কাঠের স্ট্যান্ডের ওপর, একটা সদ্য তৈরি প্লাস্টার কাস্ট রাখা। একটা মুখের ছাঁচ। সাদা প্লাস্টারের একটা মুখোশ। অনন্যা সেটার দিকে এগিয়ে গেল। কেন সে এগিয়ে যাচ্ছে, সে জানে না। তার পা দুটো যেন অবশ হয়ে গেছে, কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য শক্তি তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কাছে গিয়ে সে স্পষ্ট দেখতে পেল। মুখটা শান্ত, চোখ বোজা। যেন ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু ওই ঠোঁটের কোণের সামান্য বাঁক, ওই চিবুকের তিল, ওই নাকের নিখুঁত খাড়াই—অনন্যা এই মুখ গত দশ বছর ধরে প্রতিদিন দেখে আসছে। এটা রিয়ার মুখ। রিয়া সেন। তার নিখোঁজ বন্ধু। অনন্যার মাথা ঘুরে গেল। তার মনে হলো সে এখুনি বমি করে ফেলবে। সে স্ট্যান্ডটা ধরে ফেলল। তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। এটা রিয়ার মুখের নিখুঁত প্রতিরূপ। এমনকি রিয়ার ডানদিকের ভুরুর ওপর ছোট কাটা দাগটাও—যেটা সে ছোটবেলায় সাইকেল চালাতে গিয়ে পেয়েছিল—সেটাও হুবহু এক। প্লাস্টার কাস্টে এত নিখুঁত ডিটেল! "এটা... এটা কী?" অনন্যার গলা দিয়ে স্বর বেরোলো না। "অনন্যা? তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে? মুখটা ফ্যাকাশে লাগছে কেন?" শুভ ক্যামেরা নামিয়ে এগিয়ে এলো। শুভও মুখোশটা দেখল। সে-ও রিয়াকে চিনত। অফিসের পার্টিতে, পিকনিকে রিয়া ছিল মধ্যমণি। "এটা তো... রিয়া! এখানে কী করে? ও কি তোর সাথে কথা না বলে এখানে মডেলিং করতে এসেছিল?" অনন্যার চিৎকারে অরিন্দম রায় আর মিসেস গোমেস ছুটে এলেন। অনন্যা লক্ষ্য করল, মিসেস গোমেসের হাতটা সামান্য কাঁপছে। তিনি যেন ইচ্ছে করেই অরিন্দম রায়ের পেছনে আড়াল নিচ্ছেন, অনন্যার সরাসরি দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছেন। অনন্যা তখন কাঁপছে। সে সমস্ত শক্তি এক করে অরিন্দম রায়ের দিকে আঙুল তুলল। "এটা রিয়ার মুখ। আমার বন্ধু রিয়া সেন। সে সতেরো দিন ধরে নিখোঁজ। বলুন! এটা এখানে কী করে এলো?" অরিন্দম রায়ের মুখের সেই শান্ত হাসিটা এক মুহূর্তের জন্যও বদলালো না। তিনি মুখোশটার দিকে তাকালেন, যেন প্রথমবার দেখছেন। "আশ্চর্য!" তিনি হাত বাড়িয়ে মুখোশটা স্পর্শ করলেন। "কী নিখুঁত! এই মুখটা আমি কয়েক সপ্তাহ আগে আমার স্বপ্নে দেখেছিলাম। একটা অদ্ভুত সুন্দর মুখ, যার মধ্যে জীবন আর মৃত্যুর একটা অদ্ভুত ছাপ। আমি আমার কল্পনা থেকে এটা তৈরি করেছি।" তিনি অনন্যার দিকে তাকালেন। "তোমার বন্ধুর মুখ? কী কাকতালীয়! তার মানে, আমার কল্পনা বাস্তবকে ছুঁতে পেরেছে। এটাই তো একজন শিল্পীর আসল সার্থকতা। আমি ধন্য।" "মিথ্যে কথা!" অনন্যা চিৎকার করে উঠল। "এটা কল্পনা নয়! এটা প্লাস্টার কাস্ট! এটা জীবন্ত মানুষ ছাড়া তৈরি সম্ভব নয়! আপনি রিয়াকে চেনেন! বলুন সে কোথায়?" "অনন্যা, শান্ত হও!" শুভ তাকে ধরার চেষ্টা করল। "স্যার, ও ঠিক বলতে চাইছে না..." "মিসেস গোমেস," অরিন্দম রায় শান্তভাবে নির্দেশ দিলেন, "ওঁদের বাইরে যাওয়ার রাস্তাটা দেখিয়ে দিন। আমার মনে হচ্ছে ইন্টারভিউ শেষ। অনন্যা দেবীর শরীরটা ভালো নেই।" "আপনি এভাবে যেতে পারেন না," অনন্যা মরিয়া হয়ে বলল। "আমি পুলিশ ডাকব! এক্ষুনি!" "নিশ্চয়ই ডাকবে," অরিন্দম রায় তার দিকে এক পা এগিয়ে এলেন। তার চোখ দুটো অন্ধকারে জ্বলছিল। "কিন্তু কী বলবে? বলবে, একজন শিল্পী তার কল্পনা থেকে একটা মুখ তৈরি করেছে, আর সেটা তোমার বন্ধুর মুখের মতো দেখতে? পুলিশ তোমাকে নিয়েই হাসাহাসি করবে, অনন্যা বোস। আর হ্যাঁ, ইন্সপেক্টর চ্যাটার্জিকে আমার নমস্কার জানিও। উনি আমার বাবার খুব ভক্ত ছিলেন। যাও।" মিসেস গোমেস প্রায় ধাক্কা দিয়েই অনন্যা আর শুভকে বাইরে বের করে দিলেন। লোহার গেটটা একটা বিকট শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেল। অনন্যা গেট ধরে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছিল। "শুভ," সে কাঁপতে কাঁপতে বলল, "তুই মুখোশটার ছবি তুলেছিস? প্লিজ বল তুই ছবি তুলেছিস।" শুভ তার ক্যামেরার ভিউফাইন্ডার চেক করল। তার হাতও কাঁপছিল। "হ্যাঁ। পেয়েছি। দুটো ক্লোজ-আপ। পরিষ্কার।" "চল। পুলিশ স্টেশনে। এক্ষুনি।"

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion