Episode 4625 words0 views

চতুর্থ অধ্যায়: পাথরের দেওয়াল

পার্ক স্ট্রিট থানা। ইন্সপেক্টর চ্যাটার্জির ঘর। রাত আটটা। অনন্যা আর শুভ তার টেবিলের সামনে বসে। শুভ তার ক্যামেরার স্ক্রিনে মুখোশের ছবিটা দেখাচ্ছে। চ্যাটার্জি বিরক্ত। তার সামনে চায়ের কাপ। "ম্যাডাম, আপনি আবার এসেছেন। আবার সেই এক কেস নিয়ে। এটা কী?" "দেখুন," অনন্যা নিজেকে যতটা সম্ভব শান্ত রেখে বলল। "এটা রিয়া সেনের মুখের প্লাস্টার কাস্ট। আজ বিকেলে আমরা এটা বিখ্যাত ভাস্কর ডক্টর অরিন্দম রায়ের স্টুডিওতে পেয়েছি। রিয়া নিখোঁজ হওয়ার পর এটা তৈরি হয়েছে।" চ্যাটার্জি ছবিটা জুম করে দেখলেন। "তো? এটা তো একটা মূর্তি। রিয়া সেন মডেলিং করতেন। হয়তো উনি ডক্টর রায়ের জন্য মডেলিং করতে গেছিলেন। তারপর হয়তো ঝগড়া করে পালিয়ে গেছেন। এটা কোনো প্রমাণ নয়।" "মডেলিং?" অনন্যা বলল, "এটা একটা প্লাস্টার কাস্ট, ইন্সপেক্টর। জীবন্ত মানুষের মুখ থেকে এটা নেওয়া হয়। রিয়া সতেরো দিন ধরে নিখোঁজ, আর এই কাস্টটা একদম নতুন। আপনি বুঝতে পারছেন না? অরিন্দম রায় রিয়ার ব্যাপারে কিছু একটা জানেন!" "আর উনি বললেন, এটা উনি কল্পনা থেকে বানিয়েছেন," শুভ যোগ করল। "কল্পনা!" অনন্যা আবার রেগে উঠল। চ্যাটার্জি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। "ডক্টর অরিন্দম রায়। আপনি জানেন উনি কে? শহরের সবথেকে প্রভাবশালী লোকজনের বন্ধু। ওঁর নামে একটাও কেস নেই। আর আপনি বলছেন, উনি আপনার বন্ধুকে কিডন্যাপ করে তার মুখের ছাঁচ নিচ্ছেন? কেন? ওঁর কি আর কোনো কাজ নেই?" "আমি জানি না কেন! কিন্তু এই মুখোশটাই প্রমাণ! আপনি ওঁর বাড়ি সার্চ করুন!" "এটা কোনো প্রমাণ নয়, অনন্যা দেবী। এটা একটা শিল্পকর্ম। আমি এই ছবি দেখিয়ে ওঁর বাড়িতে সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে যেতে পারি না। আদালত আমাকে পাগল বলবে। উপর থেকে আমার চাকরিটা নিয়ে টানাটানি শুরু হবে। উনি আপনাকে ভয় দেখানোর জন্য এটা বলতেই পারতেন, তাই না?" "তাহলে আপনি কিছুই করবেন না?" "আমরা খোঁজ নিচ্ছি। রিয়ার কল রেকর্ডস ট্র‍্যাক করা হচ্ছে। কিন্তু এই মূর্তির ব্যাপারে আমি কিছু করতে পারব না। আপনারা আসুন। আর ডক্টর রায়ের মতো লোকের পিছনে লাগার আগে দু'বার ভাববেন। গুড নাইট।" থানা থেকে বেরিয়ে অনন্যার কান্না পেল। পৃথিবীটা যেন তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। "কী করবি এবার?" শুভ জিজ্ঞাসা করল। সে একটা সিগারেট ধরাল। "আমি জানি না," অনন্যা ফুটপাথে বসে পড়ল। "কিন্তু আমি এটা ছাড়ব না। ওই লোকটা মিথ্যে কথা বলছে। ওর ওই শান্ত হাসিটা, ওই চোখ... ও একটা সাইকোপ্যাথ।" তার হঠাৎ মনে পড়ল, রিয়ার শেষদিকের মেসেজগুলো। নিখোঁজ হওয়ার ঠিক তিন দিন আগে। রিয়া ফোন করেছিল, অনন্যা তখন একটা আর্টিকেলের ডেডলাইনে ব্যস্ত। "অনু, একটা দারুণ খবর আছে, আবার একটু টেনশনও হচ্ছে," রিয়া বলেছিল। "আরে রাখ তো," অনন্যা খিটখিট করে উঠেছিল, "আমার এখন সময় নেই, পরে কথা বলব।" সেই 'পরে' আর আসেনি। একটা তীব্র অপরাধবোধ তার বুকটা চেপে ধরল। সে যদি সেদিন রিয়ার ফোনটা না কেটে লেখাটা নিয়ে বসে থাকত, তাহলে হয়তো আজ রিয়া নিখোঁজ হতো না। এই অপরাধবোধটা তার জেদকে আরও বাড়িয়ে দিল। "অনন্যা," শুভ ইতস্তত করে বলল, "আমার একটা কথা খটকা লাগছে। লোকটা বলল সে তোকে চেনে, তোর 'গঙ্গার ঘাটে সূর্যাস্ত' লেখা পড়েছে। কিন্তু তুই তো শুধু লাইফস্টাইল লিখিস। ও তোর লেখা পেল কোথায়? আর রঞ্জন বাবুকে তোর নাম করে ফোনই বা করল কেন?" অনন্যারও কথাটা মনে হলো। "ঠিক। ও আমার নাম করে রঞ্জন বাবুকে ফোন করেছিল। কেন? ও কি আগে থেকেই জানত আমি রিয়ার বন্ধু?" "হয়তো ও রিয়াকে আগে থেকেই চিনত। রিয়ার কাছ থেকেই তোর কথা জেনেছে। রিয়া হয়তো ওকে তোর কথা বলেছিল..." "আর ও আমাকে ডেকেছিল ওর শিল্পকর্ম দেখানোর জন্য? আমাকে ভয় পাইয়ে দেওয়ার জন্য? ও দেখাতে চেয়েছিল, দেখ, আমি তোর বন্ধুকে নিয়ে কী করেছি, আর তুই কিছুই করতে পারবি না?" "হতে পারে," শুভ বলল। "লোকটা নরমাল নয়। চল, কাল সকালে রঞ্জন বাবুকে সবটা বলি। উনি হয়তো কোনো রাস্তা বের করতে পারবেন।" ওরা চলে যাওয়ার পর, ইন্সপেক্টর চ্যাটার্জি ঘর অন্ধকার করে শুভর ক্যামেরায় তোলা ছবিটা আবার তার কম্পিউটারে খুললেন। "অরিন্দম রায়..." নামটা তার খসখস করছিল। "অমল রায়ের ছেলে।" তার মনে পড়ল, সতেরো-আঠারো বছর আগে একটা কেস এসেছিল। এক মডেলের রহস্যজনক আত্মহত্যা। ডক্টর অরিন্দম রায়ের ক্লিনিকের নাম জড়িয়েছিল। কিন্তু কেসটা ওপরের চাপে রাতারাতি বন্ধ হয়ে যায়। চ্যাটার্জি তখন জুনিয়র। তার বস, যিনি অমল রায়ের বন্ধু ছিলেন, তিনি ফাইলটা ধামাচাপা দিয়ে দেন। "বাবার ভক্ত..." চ্যাটার্জি বিড়বিড় করলেন। "বদমাইশ।"

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion