পরদিন সকালে 'মেট্রো ক্রনিকল' অফিসে একটা থমথমে পরিবেশ। রঞ্জন বাবু সবটা শুনলেন। শুভর তোলা ছবিগুলো দেখলেন। তিনি চ্যাটার্জির সাথে ফোনে কথাও বললেন।
"অসম্ভব!" রঞ্জন বাবু বললেন। "অরিন্দম রায়... আমি ওঁর বাবার আমল থেকে ওঁকে চিনি। ওঁর বাবা অমল রায়ও কিংবদন্তী ভাস্কর ছিলেন। হ্যাঁ, ছেলেটা একটু অদ্ভুত, কিন্তু খুনি?"
"স্যার, আমরা খুনি বলছি না। আমরা বলছি, উনি রিয়ার নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে কিছু জানেন," অনন্যা বলল।
"দেখো অনন্যা, এই ছবি ছাপানো যাবে না। অরিন্দম রায় মানহানির মামলা করলে আমাদের কাগজ বন্ধ হয়ে যাবে। তোমার কাছে কোনো শক্ত প্রমাণ নেই। চ্যাটার্জি ঠিকই বলেছেন।"
"তাহলে আমাকে প্রমাণ জোগাড় করতে দিন, স্যার। আমাকে শুধু কয়েকটা দিন সময় দিন। আমি অরিন্দম রায়ের ওপর একটা ইনভেস্টিগেটিভ স্টোরি করতে চাই। ও পনেরো বছর কেন লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল, আমি সেটা খুঁজে বের করব।"
রঞ্জন বাবু কিছুক্ষণ ভাবলেন। তিনি অনন্যার চোখের দিকে তাকালেন। সেখানে শুধু বন্ধুর জন্য কষ্ট নয়, একটা সাংবাদিকের জেদও ছিল।
"ঠিক আছে। কিন্তু খুব সাবধানে। আইনি ঝামেলায় জড়াবে না। আর তোমার এই স্টোরির ব্যাপারে অফিসের কেউ জানবে না। শুধু তুমি, আমি আর শুভ। যাও, আমাদের আর্কাইভ ঘেঁটে দেখো। কিছু পেলে আমাকে জানাবে।"
অনন্যা আর শুভ লাইব্রেরিতে চলে এলো। কাগজের পুরনো আর্কাইভ। ধুলো আর পুরনো কাগজের গন্ধ।
"অরিন্দম রায়," অনন্যা কম্পিউটারে টাইপ করল।
বেশ কিছু আর্টিকেল বেরিয়ে এলো। পনেরো বছর আগেকার।
"খ্যাতনামা ভাস্কর অমল রায়ের সুযোগ্য পুত্র..."
"লন্ডন থেকে প্লাস্টিক সার্জারিতে গোল্ড মেডেল..."
"কলকাতার বুকে নতুন কসমেটিক ক্লিনিক 'কায়া'..."
"দাঁড়া," অনন্যা শুভকে থামাল। "ভাস্কর। প্লাস্টিক সার্জন। দুটোই।"
"তাতে কী? স্কাল্পটিং আর সার্জারি তো একই জিনিস। একটা মাটি দিয়ে, একটা মানুষের চামড়া দিয়ে," শুভ বলল।
"ঠিক। কিন্তু পনেরো বছর আগে ও লোকচক্ষুর আড়ালে কেন চলে গেল? একজন সফল প্লাস্টিক সার্জন... ভাস্কর্য তো শখ হতে পারে।"
অনন্যা আরও খুঁজতে লাগল। 'ক্লিনিক কায়া' দিয়ে সার্চ করল।
তারপর সে পেল। একটা ছোট, ভেতরের পাতার খবর। সতেরো বছর আগেকার।
"শহরের বিখ্যাত কসমেটিক সার্জন ডক্টর অরিন্দম রায়ের লাইসেন্স বাতিল।"
খবরের বিস্তারিততে লেখা, "এক উঠতি মডেল, তানিয়া দেশাই, তার রাইনoplasty (নাকের সার্জারি) করার সময় ডক্টর রায়ের ভুল চিকিৎসায় তার মুখে পার্মানেন্ট ড্যামেজ হয়। তানিয়া দেশাই কয়েকমাস পর তার ফ্ল্যাটে আত্মহত্যা করেন। ডক্টর রায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি নাকি 'নিখুঁত মুখ' তৈরি করার নামে রোগীর অমতেই তার মুখে একাধিক অপ্রয়োজনীয় সার্জারি করছিলেন। মেডিক্যাল কাউন্সিল তার লাইসেন্স বাতিল করে। ডক্টর রায় এরপর জনসমক্ষ থেকে অন্তরালে চলে যান।"
অনন্যা তার বাবা, অমল রায়ের ফাইলটাও খুলল। সেখানে একটা পুরনো ইন্টারভিউ। অমল রায় বলছেন, "আমার ছেলে অরিন্দম আমার থেকেও বড় শিল্পী হবে। কিন্তু ও বড্ড বেশি খুঁতখুঁতে। ও 'নিখুঁত'-এর পেছনে এমনভাবে ছোটে, যেন ওর ওপর কোনো অভিশাপ আছে। ও ডাক্তার হয়েছে, মানুষের মুখ 'ঠিক' করতে। আরে, যেটা ঈশ্বর তৈরি করেছেন, সেটা 'ঠিক' করার ও কে? আমার ভাস্কর্য নিখুঁত, কারণ তাতে কোনো ভুল নেই। ওর মা-ও ঠিক এইরকম ছিলেন, সব কিছু 'নিখুঁত' করতে চাইতেন।"
"ও মাই গড," অনন্যা বলল। "লোকটা তাহলে ডাক্তার ছিল। পাগল ডাক্তার। 'নিখুঁত মুখ'... এটা ওর বাবার থেকেই পাওয়া অবসেশন। ওর বাবা ওকে শিল্পী হিসেবে মেনে নেননি, তাই ও সার্জারি আর শিল্পকে মিলিয়ে একটা কিছু করার চেষ্টা করছিল।"
"আর ওই মডেলটি আত্মহত্যা করে," শুভ যোগ করল।
"অথবা তাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়," অনন্যার গলার স্বর ঠান্ডা। "আমাদের রিয়ার ডায়েরিটা খুঁজে বের করতে হবে, শুভ। এক্ষুনি।"
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion