রিয়ার লেক গার্ডেনসের ভাড়াবাড়িটা পুলিশ সিল করে দিয়েছিল। অনন্যা চ্যাটার্জিকে ফোন করল।
"ইন্সপেক্টর, আমি রিয়ার কিছু ব্যক্তিগত জিনিস নিতে চাই। ওর ডায়েরি, ল্যাপটপ। তদন্তের জন্য দরকার।"
চ্যাটার্জি প্রথমে রাজি হচ্ছিলেন না। কিন্তু অনন্যা যখন বলল যে সে ডক্টর রায়ের অতীত কুকীর্তির কথা জেনে গেছে, এবং তানিয়া দেশাইয়ের কেসটা আবার ওপেন করার জন্য কাগজের তরফ থেকে চাপ সৃষ্টি করতে পারে, তখন তিনি কিছুটা নরম হলেন।
"ঠিক আছে। আধ ঘণ্টার জন্য। একজন কনস্টেবল আপনার সাথে থাকবে। কিন্তু কোনো কিছু সরাবেন না। শুধু দেখতে পারেন।"
রিয়ার ঘর। ছোট্ট, গোছানো। দেওয়ালে তার মডেলিং-এর ছবি। আর তাদের দুজনের একসাথে দার্জিলিং-এ তোলা একটা হাসিখুশি ছবি। অনন্যার বুকটা চিরে গেল। টেবিলের ওপর একটা গোলাপি রঙের ডায়েরি।
অনন্যা ডায়েরিটা খুলল। সাথে থাকা কনস্টেবল বিরক্ত মুখে ফোন ঘাটছিল।
অনন্যা শেষ পাতাগুলোয় চোখ বোলাতে লাগল। রিয়া তার সব কথা ডায়েরিতে লিখত।
শেষদিকের এন্ট্রিগুলো সবই তার মডেলিং, অডিশন আর হতাশা নিয়ে।
"আজও অডিশনে রিজেক্ট হলাম। বলল, আমার মুখটা 'কমার্শিয়াল' নয়। বড্ড বেশি 'এজি' (Edgy)। এই 'এজি' মুখ দিয়ে আমি কী করব?"
তারপর একটা নতুন এন্ট্রি। নিখোঁজ হওয়ার ঠিক দশ দিন আগে।
"আজ এক অদ্ভুত লোকের সাথে দেখা হলো। অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে। আমি তানিয়া দেশাইয়ের এগজিবিশন দেখতে গেছিলাম... কী ট্র্যাজিক! তখন উনি আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন। তারপর এসে বললেন, 'তোমার মুখটা নিখুঁত। কিন্তু একটা ছোট খুঁত আছে।' আমি রেগে গিয়েছিলাম। কিন্তু তারপর উনি কার্ড দিলেন। ডক্টর অরিন্দম রায়! বিখ্যাত ভাস্কর! উনি বললেন, উনি আমাকে ওঁর নতুন 'সিরিজ'-এর জন্য মডেল হিসেবে চান। 'দ্য পারফেক্ট ফেস' সিরিজ। আমি প্রথমে রাজি হইনি। লোকটা খুব অদ্ভুত। কিন্তু উনি অনেক টাকার অফার দিলেন। আর বললেন, এই কাজটা রিলিজ হলে আমি নাকি ইন্টারন্যাশনাল লেভেলে চলে যাব।"
অনন্যার হাত কাঁপছিল। সে পড়তে থাকল।
নিখোঁজ হওয়ার তিন দিন আগে:
"কাল অরিন্দম স্যারের স্টুডিওতে গিয়েছিলাম। বালিগঞ্জে। কী বিশাল বাড়ি! যেন একটা মিউজিয়াম। উনি আমার মুখের অনেক ছবি তুললেন। তারপর বললেন, 'তোমাকে নিখুঁত হতে হবে, রিয়া। মাটির মূর্তির জন্য নয়। জীবন্ত মূর্তির জন্য।' আমি ঠিক বুঝলাম না। উনি বললেন, ওঁর একটা 'বিশেষ' প্রজেক্ট আছে। উনি আমার মুখের ওই ছোট কাটা দাগটা... যেটা অনন্যা খুব ভালোবাসে... ওটা সারিয়ে দিতে চান। একটা মাইনর সার্জারি। আমি ভয় পেলাম। বললাম, আমি তো ভাস্কর ভেবে এসেছিলাম, সার্জন নয়। উনি হাসলেন। বললেন, 'শিল্পীর কাছে দুটোই এক। মাটির যেমন খুঁত সারাতে হয়, মানুষেরও তাই। তুমি আমার মাস্টারপিস হবে, রিয়া।' উনি আমাকে কাল আবার যেতে বলেছেন। ফাইনাল সিটিং। আমি যাব। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, এটাই আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট।"
এটাই শেষ এন্ট্রি।
অনন্যা ডায়েরিটা বুকে চেপে ধরে বসে পড়ল। তার চোখ দিয়ে জল পড়ছে না। তার চোখ জ্বলছে।
"টার্নিং পয়েন্ট," সে ফিসফিস করল। "শুভ, ও রিয়াকে ফাঁদে ফেলেছিল। ওই 'নিখুঁত মুখ' বানানোর নামে ও রিয়ার ওপর সার্জারি করতে চেয়েছিল।"
"কিন্তু রিয়া তো নিখোঁজ," শুভ বলল। "সার্জারি করতে চাইলে... সে তো হাসপাতালেও করতে পারত। বাড়িতে কেন?"
"কারণ ও যা করতে চলেছিল, তা বেআইনি," অনন্যা উঠে দাঁড়াল। "ও সতেরো বছর আগে যা করতে পারেনি, তা এখন রিয়ার ওপর করতে চেয়েছিল। আর আমার মনে হচ্ছে, রিয়ার সাথে যা হয়েছে, তা ওই সতেরo বছর আগেকার মডেল মেয়েটার থেকেও ভয়ঙ্কর।"
"মানে?"
"মানে, ওই লোকটা একটা পাগল। ও শুধু সার্জন বা ভাস্কর নয়। ও এই দুটোর মিশ্রণে নতুন কিছু একটা তৈরি করেছে। একটা দানব। আর রিয়ার মুখোশটা... ওটা ছিল ট্রায়াল। আসল জিনিসটা এখনও ওই বাড়ির ভেতরে আছে।"
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion