অনির্বাণের পলায়ন ছিল আকস্মিক, কিন্তু ইরা বা তার 'বস'-এর পরিকল্পনা ছিল সুদূরপ্রসারী। কলকাতা থেকে প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার দূরে, বিলাসবহুল একটি ইয়াটে বসে বস খবরটি শুনলেন। তার নাম রণজিৎ চৌধুরী—আধুনিক বিশ্বের এক রহস্যময় শিল্পপতি এবং বহু পুরোনো জমিদার বংশের উত্তরসূরি। রণজিতের সাম্রাজ্য ছিল কেবল অর্থ আর প্রযুক্তির নয়, ছিল ক্ষমতার এক অন্ধকার জাল।
রণজিৎ চৌধুরী ছিলেন সেই তিন প্রভাবশালী দেশীয় জমিদারের একজন, যারা মীর কাসিমের পতনের জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে গোপনে চুক্তি করেছিলেন। তাদের বংশ পরম্পরায় সেই বিশ্বাসঘাতকতার গল্প আর নবাবের 'ধনভাণ্ডার'-এর সন্ধানের অভিশাপ বয়ে চলছিল। রণজিতের পূর্বপুরুষ মানসিংহ রায় ছিলেন সেই তিনজনের একজন, যিনি বিশ্বাস করতেন, শক্তিই ইতিহাস লেখে। রণজিৎ এই মন্ত্রে দীক্ষিত ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, নবাবের ফর্মুলা ব্যবহার করে বিশ্বের অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে দিতে পারলেই, তার বংশের অভিশাপ ঘুচবে এবং তিনি 'নব্য নবাব' হিসেবে বিশ্বের ভাগ্যনিয়ন্তা হতে পারবেন।
রণজিৎ তার ইয়াটের দেয়ালে টাঙানো একটি পুরোনো মানচিত্রের দিকে তাকালেন। মানচিত্রটি ছিল মুর্শিদাবাদ, মুঙ্গের এবং ঢাকার সংযোগস্থল, যা তার পূর্বপুরুষরা সঙ্কেত উদ্ধারের জন্য তৈরি করেছিলেন। মানচিত্রের কেন্দ্রে ছিল একটি জ্বলন্ত চোখের প্রতীক। রণজিতের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল জামাইল, তার দ্বিতীয়-ইন-কমান্ড এবং প্রধান নিরাপত্তা প্রধান—একজন প্রাক্তন সামরিক গোয়েন্দা, যার দৃষ্টি ছিল তীব্র এবং সন্দেহপ্রবণ। জামাইলের আনুগত্য ছিল কেবল অর্থের কাছে নয়, রণজিতের 'শৃঙ্খলা ও ক্ষমতা'র দর্শনের কাছে। রণজিৎ তাকে একসময় চরম আর্থিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেছিলেন, তাই জামাইল রণজিৎকে তার ত্রাণকর্তা মানত।
"ইরা," রণজিৎ শীতলভাবে আদেশ দিলেন। "অনির্বাণ রায়কে জীবিত ধরতেই হবে। সে হয়তো ধনভাণ্ডারের অবস্থান জানে না, কিন্তু তার কাছে 'রক্তের পথ' (আল-কুতুবের কৌটা) আছে। আর যদি তাকে জীবিত না ধরা যায়, তবে নিশ্চিত করো যেন সে মুর্শিদাবাদ পৌঁছানোর আগেই চিঠিটি ধ্বংস করে দেওয়া হয়।"
ইরা ছিল এক মেধাবী ক্রিপ্টোগ্রাফার এবং সামরিক কৌশলবিদ। তার বাবা ছিলেন রণজিতের একসময়কার ব্যবসায়িক সহযোগী, যিনি রণজিতের অন্ধকার জগতে প্রবেশ করতে অস্বীকার করায় রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন। ইরা রণজিতের জন্য কাজ করত, মূলত তার বাবার অন্তর্ধানের রহস্য জানার জন্য। তার ভেতরের নৈতিক দ্বন্দ্ব ছিল তীব্র: সে রণজিতের অর্থের জন্য কাজ করত, কিন্তু তার মন নবাবের এই ঐতিহাসিক সত্যের প্রতি এক ধরণের দুর্বলতা অনুভব করত। সে রণজিতের প্রযুক্তি আর জামাইলের সন্দেহ—দুটোর মাঝেই পিষ্ট হচ্ছিল।
পলায়ন: কলকাতা থেকে হাওড়া
অনির্বাণকে সেই বর্ষণমুখর রাতেই কলকাতায় লুকানো অসম্ভব ছিল। ইরা জানত, অনির্বাণ একজন গবেষক, তাই সে সরাসরি পুলিশের কাছে যাবে না। তার প্রথম গন্তব্য হবে ইতিহাসের কোনো স্থান। নহবতখানা।
অনির্বাণ গলিপথ ধরে ছুটতে লাগলেন। তার মনে পড়ল নবাবের চিঠির ভাষা: "পরাজয়ের কারণ তরবারি নয়, কলম।" এই কলম, এই চিঠি, আর এই সত্যই ছিল তার একমাত্র অস্ত্র।
তিনি একটি ট্যাক্সি নিলেন, কিন্তু হাওড়া ব্রিজের দিকে যাওয়ার সময়ই বুঝতে পারলেন, একটি কালো এসইউভি তাকে অনুসরণ করছে। ইরা একটি জিপিএস ট্র্যাকার ব্যবহার করছিল—যা অনির্বাণের সিন্দুক কেনার সময় তার ব্যাগে নীরবে স্থাপন করা হয়েছিল।
হাওড়া স্টেশনে পৌঁছানোর পর অনির্বাণ বুঝতে পারলেন, তার ট্র্যাকারটি নিষ্ক্রিয় করা প্রয়োজন। তিনি একটি জনাকীর্ণ চায়ের দোকানে ঢুকে পড়লেন। সেখানে একটি পুরোনো ভিএইচএফ রেডিও চালু ছিল। অনির্বাণ দ্রুত তার ব্যাগ থেকে ট্র্যাকারটি বের করে চায়ের দোকানের মালিকের কাছে থাকা পুরোনো ক্যাশ কাউন্টারের ধাতব বাক্সের নিচে আঠালো টেপ দিয়ে সেঁটে দিলেন। ধাতব বাক্সটি ট্র্যাকারটির সিগন্যালকে বাধা দেবে।
মুহূর্তের মধ্যে ইরা এবং জামাইল স্টেশনে প্রবেশ করল। তারা তাদের ট্র্যাকার অনুসরণ করে সোজা চায়ের দোকানের কাছে এলো। কিন্তু সিগন্যাল হারিয়ে গেল।
"নাহ," ইরা হতাশ হলো না। "সে জানে আমরা আসছি। সে একজন ঐতিহাসিক। তার পথ কেবল একটি—মুর্শিদাবাদগামী ট্রেন।"
জামাইল তীব্র চোখে ইরার দিকে তাকাল। "তুমি নিশ্চিত, ইরা? একজন গবেষক এত দ্রুত ট্র্যাকার শনাক্ত করে নিষ্ক্রিয় করতে পারে?" জামাইলের কথায় ছিল খোলাখুলি অবিশ্বাস।
"আমি প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ, জামাইল। তিনি হয়তো কোনো সহজ কৌশল ব্যবহার করেছেন," ইরা দৃঢ়ভাবে উত্তর দিল। সে জানত, জামাইল তাকে বিশ্বাস করে না।
অনির্বাণ তখন প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে ছিলেন, কিন্তু মুর্শিদাবাদগামী ট্রেন নয়, তিনি ধরলেন মালদহগামী একটি লোকাল ট্রেন। তিনি জানতেন, মুর্শিদাবাদে সরাসরি গেলে তিনি নিশ্চিত ধরা পড়বেন। তার কৌশল হলো মালদহে নেমে গঙ্গায় খেয়া পার হয়ে নদীপথে মুর্শিদাবাদে প্রবেশ করা, যা ইরা বা রণজিতের চক্রের কাছে অপ্রত্যাশিত হবে।
অনির্বাণ যখন মালদহের ট্রেন ধরলেন, তখন তিনি তার জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘ এবং বিপজ্জনক যাত্রার জন্য প্রস্তুত হলেন।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion